২০২০ সালে আবহাওয়ার অবনতি ও সহিংসতার ফলে ঘরছাড়া হয়েছেন চার কোটি মানুষ। একইসাথে, এবছর থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরো চরম হচ্ছে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব।
২০২০ সালে ঝড়, বন্যা, দাবানল ও খরার কারণে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তিন কোটি মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একারণেই আবহাওয়ার এমন চরম রূপ, জানাচ্ছে বৃহস্পতিবার প্রকাশ হওয়া একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ইন্টার্নাল ডিসপ্লেসেমেন্ট মনিটরিং সেন্টার বা আইডিএমসি।
আইডিএমসি'র মতে, যুদ্ধ ও সংশ্লিষ্ট সহিংসতার কারণে গৃহহীন হয়েছেন বিশ্বের প্রায় এক কোটি নাগরিক। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনগত কারণের ফলে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে চার কোটি। জেনেভায় অবস্থিত এই গবেষণা সংস্থাটির ধারণা, চলটি বছরের মধ্যে তা রেকর্ড ভেঙে সাড়ে পাঁচ কোটিতে দাঁড়াবে। বহু মানুষকে ছাড়তে হবে নিজ দেশ।
এই সংখ্যা বর্তমান বিশ্বের শরণার্থী জনসংখ্যার দ্বিগুণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন জীবাশ্ম জ্বালানির বাড়ন্ত ব্যবহার আবহাওয়াকে উষ্ণ করে তুলছে, যার কারণে বাড়ছে বিরুপ প্রভাব। এর ফলে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ অপ্রত্যাশিত বন্যা বা ঝড়ের কারণে ঘর ছাড়তে বাধ্য হবেন৷ পাশাপাশি, ফসলের ক্ষতি ও খরার মতো কারণও এই ধারাকে আরো প্রকট করে তুলছে৷ ধনী দেশগুলির রাজনীতিকরা অন্যান্য দেশ থেকে পরিবেশ শরণার্থীদের আসার কারণে তাদের দেশের অবকাঠামোর ওপর বাড়তি চাপের আশঙ্কা করছেন৷
কিন্তু আইডিএমসির প্রকল্প প্রধান বীণা দেসাইয়ের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গণহারে অভিবাসনের আলোচনা মূল আলোচনাকে বিভ্রান্ত করছে৷ তিনি বলেন, ‘‘সীমান্তে মানুষের ভিড় জমার চেয়ে দুনিয়ার মানুষ যে যেখানে আছেন, তাদের সেখানে আরো উন্নতভাবে থাকতে সাহায্য করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব৷’’
পরিবেশের কারণে উৎখাত
বার্ষিক এই প্রতিবেদনটির ২০২০ সালের সংস্করণ বলছে, সেবছরে উৎখাত হওয়া মানুষের ৮০ শতাংশই এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বাসিন্দা৷
এশিয়ায় পরিবশগত কারণে উৎখাত হওয়া মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি৷ চীন, ভারত, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে লাখ লাখ মানুষ নীচু তটবর্তী অঞ্চলে বা ব-দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় থাকেন৷ সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের ফলে আরো বেশি করে মানুষ বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন৷ এর সাথে যুক্ত হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠ দ্রুতগতিতে বাড়ার দিকটিও৷
গত দুই দশকের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সোমবার আছড়ে পড়ে ভারতে, যার কারণে ইতোমধ্যে ঘরছাড়া হয়েছেন গুজরাটের দুই লাখ বাসিন্দা৷ যদিও নানা ধরনের পূর্বাভাস প্রযুক্তির কারণে আগের তুলনায় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উৎখাত হওয়া মানুষদের ঝড়ের পরে ফিরে যাওয়ার জন্য বাসস্থান অবশিষ্ট থাকে না৷ গত বছর আমফান ঘূর্ণিঝড়ের কবলে বাংলাদেশের বিশ লাখেরও বেশি মানুষ ঘরছাড়া হন৷ এর মধ্যে ৫৫ হাজার ৫০০জনের ঘর ধ্বংস হয়, বলছে এই প্রতিবেদন৷ ঘরছাড়া মানুষের মধ্যে প্রায় দশ শতাংশেরই ফিরে যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না৷
আফ্রিকায় ২০২০ সালে বেশির ভাগ মানুষের উৎখাত হয়েছেন যুদ্ধের কারণে৷ বুরকিনা ফাসো বা মোজাম্বিকের মতো দেশে ক্রমাগত সহিংসতা বাধ্য করেছে মানুষকে দেশ ছাড়তে৷ অন্যদিকে, ইথিওপিয়ায় নতুন করে জন্ম নিয়েছে সহিংস পরিবেশ৷ আইডিএমসির মতে, গত বছরের শেষ পর্যন্ত ইথিওপিয়ার টিগ্রে অঞ্চলে হানাহানি থেকে বাঁচতে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পালিয়ে যান৷ এরপর থেকে এই সংখ্যা দশ লাখ ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ৷
কোনো কোনো অঞ্চলে যুদ্ধের সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে এসে জুড়েছে প্রবল বৃষ্টি ও বন্যা, যার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোমালিয়া, সুদান, সাউথ সুদান ও নাইজেরের মতো দেশ থেকে অস্বাভাবিক রকমের ভারি বর্ষণের ফলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অনেকে৷ আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে এসব কারণেই ২০২০ সালে ঘরছাড়া হয়েছেন ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ৷ বছর শেষ হওয়া পর্যন্ত এদের প্রায় অর্ধেকেরই জোটেনি কোনো স্থায়ী আশ্রয়৷
গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে আসা অভিবাসীদের প্রায়ই একরকম ‘বাধ্য হয়ে অনিরাপদ ও বন্যার ঝুঁকিগ্রস্ত জায়গায় থাকতে হয়’, জানাচ্ছেন জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম-এর কেনিয়া দপ্তরের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ লিসা লিম আহ কেন৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেক কিছু করার জায়গা রয়েছে৷ শুরু করতে হবে এটা ঠেকানো দিয়েই৷’’
জলবায়ুর কারণে অভিবাসন
গবেষকদের মত, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিবাসনের সম্পর্ক এখনও ভালোভাবে না বোঝার কারণে অনেক ক্ষেত্রে এর প্রভাবকে বাড়িয়ে বলা হয়৷ যদিও আইডিএমসির তথ্য মূলত বন্যা বা ঝড়ের ফলে অভ্যন্তরীণ উৎপাটন বা ইন্টার্নাল ডিসপ্লেসমেন্টের ওপর ভিত্তি করেই সংগৃহীত। দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়া তাপমাত্রা বা সমুদ্রপৃষ্ঠের কারণে ঘরছাড়া হওয়া মানুষ বিষয়ক পর্যাপ্ত পরিসংখ্যান তাদের হাতে নেই৷
তবুও, একটি আংশিক বিশ্লেষণ যা মার্চ মাসে পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইকোনমিক পলিসি অ্যানালাইসিস প্রকাশ করে বলছে যে, যে ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হয় (যেমন তাপপ্রবাহ বা খরা), সেই সব দুর্যোগের কারণে বেশি মানুষ অভিবাসনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হন৷ তুলনায়, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব অভিবাসনের ওপর ততটা নয়৷ গবেষকদের ধারণা, এর পেছনে রয়েছে অভিবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের বিষয়টি, যা আকস্মিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে ততটা প্রযোজ্য নয়৷ এই সব কারণে মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে অল্প দূরত্বে গিয়েই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেয়৷
যাদের দুর্যোগে নষ্ট হয়ে যাওয়া ঘর নতুন করে গড়ার সামর্থ্য নেই বা যারা দুর্যোগের কারণে তাদের জীবিকায় ফিরে যেতে পারছেন না, তারা বারবার চরম আবহাওয়ার কবলে থাকার ঝুঁকিতে থাকেন৷ এই কারণের পাশাপাশি আরো অন্যান্য কারণেও দুর্যোগ কবলিত অঞ্চলেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন কেউ কেউ৷
পটসডামের ইন্সটিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চে পরিবেশ ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করা অর্থনীতিবিদ বারবারা সেডোভা এই প্রতিবেদনের সহ-লেখক৷ তিনি বলেন, ‘‘অভিবাসন করতে চাইলে তার বাস্তবায়নে কিছু পুঁজি বা উপায় থাকা দরকার৷ এই আলোচনায় যা উঠে আসে না তা হচ্ছে এইসব দুর্যোগপ্রবণ জায়গায় আটকে থাকা মানুষের অভিবাসন করতে পারার ক্ষমতার বিষয়টি৷’’
আরো চরম হচ্ছে আবহাওয়া
জলবায়ু পরিবর্তন ধনী দেশগুলিতে চরম আবহাওয়াকে আরো চরম করে তুলছে৷
মার্চমাসে ন্যাচারাল হ্যাজার্ডস অ্যান্ড আর্থ সিস্টেমস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা জানায় যে ২০১৯-২০২০ সালের অস্ট্রেলিয়ান দাবানলের সময় ব্যাপক অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি ছিল৷ এই ঝুঁকিকে আরো ৩০ শতাংশ বেশি বাড়িয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া বদলে যাওয়াও৷ সেই আগুনে ধ্বংস হয় হাজার হাজার মানুষের ঘর, প্রাণ হারান ৩৪জন৷
মঙ্গলবার নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা জানাচ্ছে যে, ২০১২ সালে নিউ ইয়র্কে আছড়ে পড়া স্যান্ড ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ক্ষয়ক্ষতির ১৩ শতাংশই হয়েছিল বেড়ে যাওয়া সমুদ্রপৃষ্ঠের কারণে৷ গবেষণা বলছে, যদি বিশ্বের তাপমাত্রা মানুষের কারণে এতটা না বাড়তো এবং অন্যান্য সূচকও আগের মতোই থাকতো, সেক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী বন্যায় অন্তত ৭০হাজার মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যেত৷
জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিবাসন নিয়ে কর্মরত গবেষকরা বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান করেছেন অবিলম্বে তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে৷ সাথে, পরিবর্তিত পরিভেশের সাথে মানিয়ে নিতে ও উৎপাটিত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতেও আহ্বান জানিয়েছেন তারা৷
বারবারা সেডোভা বলেন, ‘‘আমরা যদি শহরের মধ্যেই এইসব উৎপাটিত মানুষদের জন্য কাজ, বাসস্থান ও সম্মানসহ একটি জীবনের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারি, তাহলে অভিবাসন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি হয়ে উঠবে না৷ অভিবাসনকে ভালোভাবে সংগঠিত করতে পারলে তা দেশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে৷’’
এসএস/এফএস