ইরিত্রিয়ান পাচারকারী কিদান জাকারিয়া এবং তেওলদে গোইটমকে লিবিয়ায় কয়েক হাজার অভিবাসীকে অনাহারে রাখা ও নির্যাতনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে ইথিওপিয়ার একটি আদালত। প্রথম ব্যক্তি কিদান জাকারিয়াকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে যদিও বিচার প্রক্রিয়ার মাঝামাঝি সময়ে তিনি পালিয়ে যান। দ্বিতীয় ব্যক্তি ওয়ালিদকে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
লিবিয়ার গোপন কারাগারে অভিবাসীদের অনাহার, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ইরিত্রিয়ান পাচারকারী কিদান জাকারিয়াকে ১৬ জুন ইথিওপিয়ার একটি আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে। উল্লেখ্য, অভিযুক্ত কিদান চার মাস আগে বিচারকার্য চলাকালীন সময়ে আদালত থেকে পালিয়ে যায়।
কয়েক বছর ধরে মানব পাচার ও চাঁদাবাজির পরে চরম ধনী হয়ে ওঠা কিদান জাকারিয়া কয়েক হাজার আফ্রিকান অভিবাসীকে ইউরোপে যাওয়ার পথে লিবিয়ার একটি গোপন কারাগারে আটক করে রেখেছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রত্যেক ব্যক্তি থেকে কয়েক হাজার ডলারের করে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
২০২০ সালে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফুয়াদ বেদরু নামে এক ইথিওপিয়ান ভুক্তভোগী রাস্তায় তাকে চিনতে পেরে সাথে সাথে পুলিশকে জানালে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
কিদানকে কয়েক হাজার ডলার দিয়ে মুক্তি পাওয়া ফুয়াদ বলেন, "কিদানের গ্রেফতারে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলাম। তবে আমার কাছে এটি একটি কল্পিত ন্যায়বিচার কারণ সে এখন আটক নেই৷" রায়ে কারাদণ্ডের পাশাপাশি কিদানকে প্রায় ২৩ হাজার মার্কিন ডলার সমমানের জরিমানারও করা হয়েছে।
আরও পড়ুন>>>লিবিয়া থেকে দেশে ফিরতে ১৬০ বাংলাদেশিকে সহায়তা করলো আইওএম
এক বছর বিচার প্রক্রিয়া চলার পরে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে এই পাচারকারী আদ্দিস আবাবার একটি আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পালিয়ে যায়। তার পালিয়ে যাওয়া নিয়ে বর্তমানে তদন্ত চলছে তবে তাকে গ্রেফতারে এখনও অভিযান চলছে। কিদান পালিয়ে যাওয়ার পর ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবার ন্যায়বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছে।
দণ্ডিত আরেক পাচারকারী
এর দু'দিন আগে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে লিবিয়ার বনি ওয়ালিদ অঞ্চলে অভিবাসীদের নির্যাতন করা আরেক ইরিত্রিয়ান পাচারকারী তেওলদে গোইটমকে আদ্দিস আবাবার আদালত সাজা প্রদান করে। উক্ত পাচারকারী "ওয়ালিদ" নামে বেশ পরিচিত, তাকে ১৮ বছরের কারাদণ্ড এবং ৪৫০০ মার্কিন ডলার সমমূল্যের অর্থদণ্ড দেয়া হয়।

এ দুটি বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণকারী ইরিত্রিয়ান সাংবাদিক মেরন এস্তেফানোস জানান, কিদান জাকারিয়া এবং ওয়ালিদ এর উপর আরোপিত দণ্ড ও জরিমানার পরিমান হাস্যকর। তার মতে, “এই রায়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থদের অপমান করা হয়েছে।” ২০১৪ থেকে টানা কয়েকবছর ওয়ালিদ অত্যন্ত লাভজনক এবং নির্মম ব্যবসা চালিয়েছিল। বিভিন্ন ভুক্তভোগীর মতে, ওয়ালিদও কিদানের ন্যায় হাজার হাজার অভিবাসীকে লিবিয়ায় বন্দী রেখে নির্যাতন এবং মুক্তিপণ আদায় করেছিলেন।
একাধিক ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত
তেওলদে গোইটমের হাতে আটক থাকা প্রাক্তন অনেক বন্দি তার হাতে শারীরিক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের পাশাশাপি যত্ন, খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে অনাহারে অনেক অভিবাসীর করুণ মৃত্যু হয়েছিল বলে বর্ণনা করেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আটক কেন্দ্রে একাধিক ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের অভিযোগও রয়েছে।
আইরিশ টাইমস পত্রিকার বরাত দিয়ে এক সাক্ষী বলেন, “আমি বিচার চলাকালীন সময়ে শুনানিতে হাজির হয়েছিলাম। তেওলদে গোইটমে আটক কেন্দ্রে এক মহিলা বন্দিকে সবার সামনে ধর্ষণ এবং কঠোর শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সে ঘটনা আদালতকে জানায়।”
আরও পড়ুন>>মানব পাচারকারী বিজা শয়তানের চেয়েও খারাপ: লিবিয়া থেকে আসা শরণার্থীরা
লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বনি ওয়ালিদ নামক অঞ্চলটি কুখ্যাত পাচারকারীদের প্রভাবে অভিবাসীদের জন্য অন্যতম ভয়ঙ্কর ট্রানজিট স্থান হিসাবে পরিচিত। পাচারকারীরা নিয়মিতভাবে সবার সামনে অভিবাসীদের নানা নির্যাতন আর দুর্ব্যবহার করে থাকে।
কয়েক বছর ধরে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন শহর এবং আটক কেন্দ্র পার হয়েছেন এমন অনেক অভিবাসী তাদের অভিজ্ঞতা ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছেন। যেমন ২০১৭ সালে ইসা নামের একজন ক্যামেরুনের নাগরিক ব্যাখ্যা করেছিলেন, আমি প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম যেন বনি ওয়ালিদের কোন আটক কেন্দ্রে আমাকে বিক্রী করা না হয়৷" গতবছরের জানুয়ারী মাসে সেনেগালের নাগরিক ইব্রাহিম জানিয়েছিলেন, বনি ওয়ালিদ এই গ্রহের সবচেয়ে খারাপ জায়গা।
আরও পড়ুন>>লিবিয়া উপকূলে ১১ অভিবাসীর মৃত্যু, ১২ জন জীবিত উদ্ধার
২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনের পতনের পরে ইউরোপে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কয়েক হাজার অভিবাসী বিশৃঙ্খল লিবিয়াকে পছন্দের অভিবাসন পথ হিসেবে বেছে নেয়। চোরাচালানকারী ও পাচারকারীদের নির্যাতনে অনেকে অভিবাসী দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় লিবিয়ায় আটকা পড়ে আছেন।
এমএইউ/এআই