আশ্রয়প্রার্থীরা বিভিন্ন পথে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে থাকে৷ ছবি: পানাগিওটিস বালাসকাস/এপি/পিকচার-অ্যালায়েন্স৷
আশ্রয়প্রার্থীরা বিভিন্ন পথে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে থাকে৷ ছবি: পানাগিওটিস বালাসকাস/এপি/পিকচার-অ্যালায়েন্স৷

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে আসাদের অনেকেই রিফিউজি বা শরণার্থীর মর্যাদা বা সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের মর্যাদা পেয়ে থাকেন৷ ইউরোপের দেশ জার্মানি, ইটালি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে এ দুটি বিষয়ের মধ্যে কী পার্থক্য?দুটোই আসলে আশ্রয়প্রার্থীদেরকে দেওয়া আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মর্যাদা৷

একজন ব্যক্তি রিফিউজির মর্যাদা পেতে হলে, রিফিউজি কনভেনশন আইন ১৯৫১ অনুযায়ী রিফিউজির যে সংজ্ঞা তা পূরণ করতে হয়৷ আশ্রয় চাওয়া ব্যক্তিটির নিরাপত্তা এ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক৷ অর্থাৎ একজন ব্যক্তির আশ্রয় আবেদন নাকচ করে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হলে সেখানে তার নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা হুমকির মুখে কিনা তা এ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়৷

এদিকে সাবসিডিয়ারি প্রটেকশনের মূল ভিত্তি হলো মানবিক বিবেচনা৷ অর্থাৎ এটি এক ধরনের মানবিক সুরক্ষা৷ কোনো ব্যক্তি যদি রিফিউজি মর্যাদা পাবার শর্ত পূরণ না করে তখন তাকে এ মর্যাদা দেওয়া হতে পারে৷ শর্ত হলো, আশ্রয়প্রার্থীকে এটি প্রমাণ করতে হবে যে, দেশে ফেরত পাঠানো হলে তার মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এমন ঝুঁকি আছে৷ তবে এ ক্ষেত্রে নির্যাতনের জন্য ধর্ম, বর্ণ কিংবা রাজনৈতিক এমন কোনো কারণ হতে হবে না৷

এ দুই ধরনের আশ্রয়ের মর্যাদার মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো পরিবারের সদস্যদের সাথে পুনরায় একত্রিত হওয়ার সুযোগের বিষয়টি৷ অর্থাৎ আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তি যে দেশে অবস্থান করছেন তার পরিবারের সদস্যদেরকে সে দেশে আনতে পারবে কি না সে বিষয়টি৷



আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য এ সুযোগটি ইউরোপের একেক দেশে একেক রকমের৷ অর্থাৎ রিফিউজির মর্যাদাপ্রাপ্ত ও সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের মর্যাদাপ্রাপ্ত এমন দুজন ব্যক্তির পরিবারের সাথে পুনরায় একত্রিত হওয়ার বিষয়ে কী ধরনের সুযোগ পাবে তা ইউরোপের একেক দেশে একে রকম৷ যেমন, মালটা, গ্রিস ও জার্মানি সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের বেলায় তাদেরকে পরিবারের সাথে একত্রিত হওয়ার কোনো সুযোগ প্রদান করা না৷ অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইডেন ও হাঙ্গেরিতে পরিবারকে আনার বিষয়ে ব্যক্তির আয়, স্বাস্থ্যবীমা ও থাকার সুযোগসুবিধার নিয়মকানুন আরোপ করে৷ সুইডেনে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তি প্রথমে ১৩ মাস থাকার অনুমতি পায় যা দুই বছরের জন্য বাড়ানো যেতে পারে৷ তবে পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷

জার্মানি

নিজ দেশে বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা বা রাজনৈতিক কারণে যদি কেউ নির্যাতনের শিকার হন তাহলে জার্মানিতে তাদেরকে শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া হয়৷ কোনো ব্যক্তি যদি তৃতীয় কোনো দেশ থেকে জার্মানিতে প্রবেশ করে তাহলেও তাকে শরণার্থীর মর্যাদা দেওয়া হতে পারে৷ সে ব্যক্তিকে তখন তিন বছর দেশটিতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়৷ থাকার এ অনুমতি তিন বছরের জন্য বাড়ানো যেতে পারে যদি তার দেশের পরিস্থিতির উন্নতি না হয়৷ তিন থেকে পাঁচ বছর পর একজন শরণার্থী জার্মানিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতির আবেদন করতে পারবে৷ শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়া ব্যক্তিরা বিদেশে ভ্রমণ করতে পারবে৷ তবে নিজ দেশে ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে৷

শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়ার পর আশ্রয়প্রার্থী তার পরিবারের সদস্যদের জার্মানিতে আনার অধিকার পাবে৷ একইসাথে জার্মানিতে চাকরির ও চাকরি না থাকা অবস্থায় বেকার ভাতার জন্য উপযুক্ত হবেন৷ একই সাথে সে ব্যক্তি তার সন্তানদের জন্য ভাতা, পিতা-মাতা হিসেবে সুযোগ সুবিধা, দেশটিতে ইন্টিগ্রেশন কোর্সে অংশগ্রহণসহ পড়াশোনা বা ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন৷

এদিকে জার্মানিতে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশন তাদেরকেই দেওয়া হয় যারা শরণার্থী হিসেবে বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি৷ যেসকল আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তিগতভাবে নির্যাতনের শিকার না হলেও নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন তাদেরকে এ সুবিধা প্রদান করা হয়৷ যুদ্ধ কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘন যেমন মৃত্যুদণ্ড, নির্যাতন বা অমানবিক আচরণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন ব্যক্তিদের এ সুবিধা দেওয়া হয়৷

জার্মানিতে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের সুবিধাপ্রাপ্তদের এক বছরের থাকার অনুমতি দেওয়া হয়৷ থাকার এ সুবিধা দুই বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য বাড়ানো যেতে পারে যদি তার নিজ দেশের পরিস্থিতির উন্নতি না হয়৷ শরণার্থীদের মতোই তারা দেশটিতে স্থায়ীভাবে থাকার সুবিধার আবেদন করতে পারবে৷

সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি জার্মানিতে কাজের সুযোগ এবং কাজ না থাকা অবস্থায় বেকার ভাতা এবং চাকরি খুঁজে পেতে সহযোগিতা পাবেন৷ একই সাথে সে ব্যক্তি তার শিশুদের জন্য ভাতা, পিতা-মাতা হিসেবে সুযোগ-সুবিধা, দেশটিতে ইন্টিগ্রেশন কোর্সে অংশগ্রহণসহ পড়াশোনা বা ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন৷

তবে শরণার্থীদের মতো ভ্রমণের সুযোগ পাবে না এ ব্যক্তি৷ এ দিকে ২০১৮ সালে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশন সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেলায় পরিবারের সদস্যদের দেশটিতে আনার আইন বাতিল করে৷ তবে প্রতিবছর সর্বোচ্চ এক হাজার ব্যক্তিকে জার্মানিতে প্রবেশের সুযোগ দেয়৷

যুক্তরাজ্য

যুক্তরাজ্যে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনকে বলা হয় হিউমেনিটারিয়ান প্রোটেকশন৷ দেশটিতে শরণার্থীর মর্যাদা আর সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের মর্যাদার বিষয়গুলো প্রায় একই রকমের৷ দুই শ্রেনীর লোকেরাই পাঁচ বছর থাকার অনুমতি পায়৷ এরপর তারা দেশটিতে স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতির আবেদন করার জন্য উপযুক্ত হন৷




তবে ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশন বিষয়ক আইনের কোন পরিবর্তন আসেনি৷ ভবিষ্যতে পরিবর্তন আসতে পারে৷


জার্মানির মতো, যুক্তরাজ্যেও শরণার্থীর মর্যাদাপ্রাপ্তরা অন্য দেশে ভ্রমণের অনুমতি পায়৷ তবে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের এ সুবিধা দেওয়া হয় না৷ যুক্তরাজ্যে ইমিগ্রেশন বিষয়ক আইনজীবী জন ভাসিলিউ দেশটিতে আশ্রয় বিষয়ক আইন-কানুন নিয়ে কাজ করছেন৷ তিনি জানান, যুক্তরাজ্যে কোনো ব্যক্তির শরণার্থীর মর্যাদা বাতিল হয়ে গেলে তা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংন্থা ইউএইচসিআরকে বিবেচানর জন্য সুযোগ দেওয়া হয৷ তবে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের বেলায় এ শর্ত প্রযোজ্য নয়৷

তিনি জানান, শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গীরা যদি পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন তাহলে তারা যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসবাসের আবেদন করতে পারবেন৷ তবে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গীরা এমন আবেদন করতে পারবেন না৷

তাছাড়া শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়া ও সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিরা পরিবারের সাথে পুনর্মিলনের জন্য আবেদন করতে পারবেন৷ স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও তারা পাবেন৷

ইটালি

ইটালিতে শরণার্থীর মর্যাদাধারী ও সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিরা পাঁচ বছরের জন্য থাকার অনুমতি পায়৷ থাকার মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ আছে৷ উভয় শ্রেণীর লোকেরাই ভিসা ছাড়া শেঙ্গেনভুক্ত দেশগুলো ভ্রমণ করতে পারেন৷ তারা তিন মাসের জন্য এ দেশগুলোতে ভ্রমণ করতে পারেন কিন্তু সেখানে চাকরি কিংবা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেন না৷ বাকি দেশগুলোর মতো ইটালিতে শরণার্থী ও সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের মর্যাদা পাওয়া ব্যক্তিরা নিজ দেশে ভ্রমণ করতে পারবে না৷ 



এদিকে, শরণার্থীর মর্যাদাধারী ব্যক্তিদের মতোই সাবসিডিয়ারি প্রোটোকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিরা শরণার্থীদের জন্য নির্মিত বাসস্থানে থাকতে পারে৷ দেশটিতে কাজের সুযোগ পান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন৷ দশ বছর থাকার পর তারা দেশটিতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন৷ সেই সাথে ইটালিতে পাঁচ বছর থাকার পর ইউরোপের অন্য দেশে কাজ করার ও শিক্ষার জন্য অনুমতির শর্ত সাপেক্ষে আবেদন করতে পারেন৷ শরণার্থীর মর্যাদাধারী ব্যক্তিদের মতোই সাবসিডিয়ারি প্রোটোকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিরা পরিবারের সদস্যদের সাথে পুনর্মিলনের আবেদন করতে পারেন৷

ফ্রান্স

শরণার্থী মর্যাদাধারী ও সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের ফ্রান্সে পাওয়া সুযোগসুবিধা ইউরোপের অন্যদেশের তুলনায় অনেক পার্থক্য রয়েছে৷



শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়া ব্যক্তিরা ফ্রান্সে দশ বছরের জন্য থাকার অনুমতি পায়৷ যা পরবর্তীতে নিজে থেকেই বাড়তে থাকে৷  একই সাথে সে ব্যক্তি দেশটিতে কাজ করারও অনুমতি পেয়ে থাকে৷ তবে সাবসিডিয়ারি প্রোটেকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিদেরকে দেশটিতে এক বছর থাকার অনুমতি দেওয়া হয়৷ থাকার অনুমতি তখনই বাড়ানো হয় যদি তার নিজ দেশের পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্য উন্নতি না ঘটে৷ এ সময় তার কাজের অনুমতিও থাকে৷

এদিকে পরিবারের সদস্যদের আনার বিষয়ে শরণার্থী মর্যাদাধারী ও সাবসিডিয়ারি প্রোটোকশনের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের উভয়েরই সমান সুযোগ রয়েছে৷  শরণার্থী কিংবা সাবসিডিয়ারি প্রোটোকশনের আওতায় আসার পরপরই তারা এর জন্য আবেদন করতে পারে৷  

মারিওন ম্যাকগ্রেগর/আরআর


 

অন্যান্য প্রতিবেদন