"চিন্তা,দুঃস্বপ্ন এবং সুন্দর ভবিষ্যতের কোনও সম্ভাবনা নেই": এটি এক তরুণ আফগান আশ্রয়প্রার্থীর উপর গ্রিসের সর্বেশেষ অভিবাসন নীতির একটি প্রভাবের। জুন মাসে পাস হওয়া নতুন আইনের কারণে এই তরুণের মতো হাজারও আশ্রয়প্রার্থী আশ্রয় মর্যাদা পেতে ব্যর্থ হয়ে গৃহহীন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। আবার অনেক আশ্রয়প্রার্থীকে তুরস্কে ফেরত পাঠানোর অপেক্ষায় আটক রাখা হয়েছে।
গত মাসে গ্রিক সরকারের একটি সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে দেশটিতে থাকা আশ্রয়প্রার্থীদের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। জুন মাসে এথেন্স একতরফাভাবে ঘোষণা করে, সিরিয়া, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের আবার তুরস্কে ফেরত পাঠানো হতে পারে কারণ গ্রিস মনে করে তুরস্ক একটি "নিরাপদ তৃতীয় দেশ।"
অর্থাৎ, এখন থেকে গ্রিসে আসা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয় আবেদন গ্রিসে প্রবেশের কয়েকদিনের মধ্যেই মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী হওয়া সাক্ষাৎকারের পরে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে।
বুধবার (১৪ জুলাই) গ্রিসের আশ্রয় বিষয়ক সংস্থাগুলির একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে আসা এক তরুণ আশ্রয়প্রার্থী এ.বি. বলেন, “আশ্রয়প্রার্থীদের আরও মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।”
এ বি বলেন, "সাক্ষাৎকারে আমার কাছে তুরস্ক সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার পর থেকে আমার চোখে ঘুম নেই, আমি ঘুমাতে পারছি না। তারা আমার আশ্রয় আবেদনের উপর কি সিদ্ধান্ত নেবে সেটি ভাবতেই আমার ভয় হচ্ছে। তারা কখন, কিভাবে আমা্কে সিদ্ধান্ত দেবে তাও জানানো হয় নি I এই নতুন আইনটি আশ্রয় শিবিরে থাকা প্রত্যেকের জীবনেই অনেক প্রভাব ফেলেছে।"
এ বি আরও যোগ করেন, "আইন তৈরি করা সহজ। আপনি যদি সত্যিই জানতে চান এই নতুন আইনটি কিভাবে শরণার্থীদের প্রভাবিত করছে তাহলে আপনি দয়া করে আশ্রয় শিবিরে এসে একদিনের জন্য আশ্রয়প্রার্থী হয়ে দেখুন।"

এই সিদ্ধান্তটি একটি কালো বাক্সে
"নিরাপদ তৃতীয় দেশ" নীতিতে অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি দেশের নাগরিকদের আশ্রয় আবেদন যতই গ্রহণযোগ্য আর যুক্তিযুক্ত হোক তা আর গ্রিক কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করছে না। প্রত্যেকের আবেদনের একটি নির্দিষ্ট সূত্র অনুসারে বিবেচনা করা হচ্ছে। আশ্রয়পার্থীদের কেবল তুরস্কে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে কিন্তু তারা কি কারণে তাদের দেশ ত্যাগ করল বা তারা কোন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করা হয় না।
গ্রিক কাউন্সিল ফর রিফিউজিস এর সদস্য আলেকজান্দ্রোস কনস্টান্টিনো ব্যাখ্যা করেন, নতুন নীতিমালার একটি প্রভাব হলো আশ্রয়ের পক্ষে একজন ব্যক্তির যত শক্তিশালী ভিত্তি থাকুক না কেন এর উপর কাউকে গ্রিসে সুরক্ষা দেওয়ার কোনও প্রভাব থাকবে না। এরকম ঘটেছে সিরিয়ানদের ক্ষেত্রে, ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তুরস্কের মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়ান দের জন্য তুরস্ক একটি নিরাপদ তৃতীয় দেশে সুতরাং তাদের জন্যও এটি প্রযোজ্য। গত বছর গ্রিসে সুরক্ষার জন্য আবেদন করা সোমালিয়ানদের স্বীকৃতির হার ছিল ৯৯% অপরদিকে আফগানদের জন্য এটি ছিল ৬৬%।”
এজিয়ান রিফিউজি সাপোর্ট সংস্থার আইনজীবী মারিয়ানা টেজেফেরাকু বলেন, গ্রিক কর্তৃপক্ষের তুরস্ককে নিরাপদ তৃতীয় দেশে হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আরো ৫টি দেশের নাম তালিকায় যোগ করাটা একটি কালো বাক্সের মতো। কারণ এটি প্রণয়নের কারণ ও পদ্ধতিটি তারা নিজে কাছে রেখে দিয়েছেন।"

এজেনিয়ান বোট রিপোর্ট নামে একটি এনজিও অভিযোগ করেছে এই ছবিতে এজিয়ান সাগরে গ্রিক কোস্টগার্ড অভিবাসীদের পুশব্যাক করছে। ছবিঃ এজিয়ান বোট রিপোর্ট
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট
গ্রিসের অধিকার সংস্থাগুলি বলছে, নতুন নীতিটি কিছু বৃহত্তর চিত্রের মিলে যায় যেমন, শরণার্থীদের পুশব্যাক, গ্রিক দ্বীপপুঞ্জে আশ্রয় শিবির, মূলভূমিতে থাকা তথাকথিত নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্র এবং নতুন আরও আটক কেন্দ্রের সৃষ্টি ইত্যাদি।
এই সপ্তাহে, গ্রিক কোস্ট গার্ডের বিরুদ্ধে পুশব্যাকের আরও কিছু অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনায় একজন কোস্টগার্ড সদস্যকে আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় দেখা গেছে এবং তারা দ্বীপের দিকে আসা একটি অভিবাসী নৌকাকে তুরস্কের জলসীমার দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিলেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি গ্রিসের তুরস্কের দিকে জোরপূর্বক পুশব্যাকের বিষয়টিকে "ডি ফ্যাক্টো" সীমান্ত নীতি হিসাবে বর্ণনা করেছে। তবে গ্রিক সরকার এসব অভিযোগ সবসময় অস্বীকার করে আসছে।

তুরস্ক নিরাপদ দেশ নয়
মানবাধিকার এবং শরণার্থী আইনজীবিরাও জোর দিয়ে বলেছিলেন, শরণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় ব্যবস্থা বা অভ্যর্থনা শর্ত না থাকায় তুরস্ক নিরাপদ দেশ নয়। আইনজীবি তজারফেরাকু বলেন, তুরস্কে থাকা শরণার্থীরা অবৈধ আটক, অপসারণ ও জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোসহ অনেক সমস্যর শিকার হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
৩৫ বছর বয়সী আশ্রয়প্রার্থী এইচ.সি. যিনি পাঁচ বছর ধরে গ্রিসে ছিলেন, “তিনি এই প্রক্রিয়াটিতে হতাশা প্রকাশ করেন। তারা শরণার্থীদের নিয়ে রাজনীতি করছে। আমার কাছে নিজেকে একটি খেলার বলের মতো মন হচ্ছে যেমন, গ্রিস তুরস্কের দিকে গুলি চালাচ্ছে আবার অপরদিকে তুরস্ক আমাকে ব্যবহার করে গ্রিসের দিকে গুলি করছে। শরণার্থীরা সবাই এই পরিস্থিতিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।"

মানব পাচারকারীদের জন্য বাড়তি সুবিধা
এই সিদ্ধান্তটি শরণার্থীদের জন্য মারাত্মক নেতিবাচক পরিণতি ডেকে আনবে উল্লেখে করে, গত মাসে ৩৮ টি সংস্থা গ্রিক সরকার এবং ইইউ সংস্থাগুলিকে চিঠি দিয়েছে।
প্রো আসিলের ইউরোপীয় আইন বিষয়ক পরিচালক কার্ল কুপ সতর্ক করে বলেন, এটি আইনের শাসনের পাশাপাশি এবং আশ্রয়প্রার্থীদের অধিকারের জন্য হুমকি এবং উদ্বেগজনক। গ্রিক সরকারের নীতিটি চোরাচালানকারী ও মানব পাচারকারীদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, যারা তুরস্কে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছেন তারা সম্ভবত বল্কান অঞ্চলে থাকা পাচারকারীদের মাধ্যমে উত্তর ইউরোপে "অবৈধভাবে" পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন। যার ফলে পাচারকারীদের মুনাফা বৃদ্ধি পাবে এবং শরণার্থীদের দুর্ভোগ ও শোষণও বাড়বে।"
কার্ল কুপ জার্মানি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় সরকারকে গ্রিসকে তার নীতিমালা পরিবর্তনের জন্য চাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, "এটি নিয়ে বার্লিন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় রাজধানীগুলি একটি নীরব ভূমিকা পালন করছে।"।
আশ্রয়প্রার্থী এ.বি. বলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ যে গ্রিস সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে নীরবতা ভেঙ্গ কথা বলা উচিত। এক হাত তালি দেওয়া যায় না। শরণার্থীরা একটি হাতের মতো এবং এর সাথে অন্য অন্য হাতকে একত্রিত করার জন্য সবাইকে নীরবতা ভেঙ্গে শব্দ তৈরি করতে হবে।"
বিঃদ্রঃ এ বি ও বি সি সাক্ষাৎকার দেওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
এমএইউ/এসএস