আলবেনিয়া ও ইইউ পতাকা। ছবিঃ ডয়েচে ভেলে
আলবেনিয়া ও ইইউ পতাকা। ছবিঃ ডয়েচে ভেলে

গ্রিস এবং তুরস্কে ব্যাপক বিধিনিষেধের পর বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করাতে পাচারকারীরা এখন আলবেনিয়া রুটকে,বেছে নিয়েছে। সরাসরি বাংলাদেশ থেকে আসার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত বৈধ প্রবাসীরাও এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন।

বাংলাদেশি নাগরিকদের অবৈধ পথে ইউরোপে প্রবেশের ঘটনা নতুন নয়। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিক ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া নিয়ে টানপোড়েন চলছে বাংলাদেশ সরকার এবং ইউরোপীয় কমিশনের সাথে।

গ্রিস ও তুরস্কে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে মানব পাচারকারীরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রুটের সন্ধানে থাকে। এবার তাদের টার্গেট মানুষকে ইউরোপ মহাদেশের দরিদ্র দেশ আলবেনিয়া হয়ে শেঙ্গেন অঞ্চলে প্রবেশ করানোর মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়া। 

২০২০ সাল থেকে শুরু হওয়া চলমান করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপমুখী অভিবাসন প্রবাহে ভাঁটা পড়লেও ২০২১ সালের গ্রীষ্ম থেকে তা আবার শুরু হয়েছে। 

প্রায় বন্ধ তুরস্ক-গ্রিস রুট

তুরস্ক ইরানের সাথে সীমান্ত দেয়াল সম্প্রসারণের পাশাপাশি দেশজুড়ে ব্যাপক ভাবে অনিয়মিত অভিবাসীদের গ্রেফতার শুরু করেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে অনেক পাচারকারীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। 

অপরদিকে গ্রিসের নতুন অত্যাধুনিক সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে কারিগরি নজরদারি বাড়ানো এবং এজিয়ান সাগরে তুর্কির দিকে অভিবাসীদের পুশব্যাকের কারণে এখন আর তুরস্ক-গ্রিস পথকে ব্যবহার করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ নেয় পাচারকারীদের হাতে। 

২০২০ ও ২০২১ সালে তুরস্ক ও গ্রিস হয়ে বাংলাদেশিদ্র ইউরোপে প্রবেশের সংখ্যা উল্লেখজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। 

লিবিয়া-ইটালি রুট

বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ লিবিয়া থেকে সমুদ্র পথে ইটালির লাম্পেদুসা, সিসিলি সহ বিভিন্ন দ্বীপে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করে থাকেন। এদের মধ্যে মূলত লিবিয়া প্রবাসীদের বড় একটি অংশ এই পথ ব্যবহার করে থাকে। 

লিবিয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেখানে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া এবং দালালদের খপ্পরে পড়ে ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হয়েছে বহু বাংলাদেশি নাগরিকের। নতুন করে লিবিয়ায় অভিবাসী না যাওয়াতে এবং প্রতিনিয়ত ইনফোমাইগ্রেন্টসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীদের প্রাণ হারানোর সংবাদ প্রচার হওয়াতে বেশ বড় অংশ না হলেও জনসাধারণের মধ্যে একটি ধারণা এ ব্যাপারে তৈরী হয়েছে। 

দালালদের নতুন ফাঁদ আলবেনিয়া  

প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অভিবাসন রুট কঠিন হয়ে যাওয়ায় দালালরা এখন সাধারণ বাংলাদেশি এবং মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রবাসীদের টার্গেট করে আলবেনিয়া হয়ে ইউরোপে ঢুকানোর নতুন ফাঁদ পেতেছে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টিকটকে ব্যাপক প্রচার লক্ষ্য করা গেছে। নানান লোভনীয় প্রলোভন দিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে সয়লাভ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। 

এরকম একজন পাচারকারীদের মধ্যস্থতাকারীর সাথে গ্রাহক সেজে কথা বলে ইনফোমাইগ্রেন্টস। যিনি নিজেই দুবাই থেকে আলবেনিয়া হয়ে বর্তমানে ইটালির একটি ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। 

তিনি আমাদের জানান, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি টুরিস্ট ভিসা আলবেনিয়া আসা যাবে পরবর্তীতে শেঙ্গেন অঞ্চলে প্রবেশে সহায়তা করা হবে। এর জন্য তিনি বলেন নতুন পাসপোর্ট হলে ৮ লাখ টাকা আর বিগত দিনে কোনো দেশ ভ্রমণ করা থাকলে সেক্ষেত্রে ৬/৭ লাখ টাকা আলোচনা সাপেক্ষে পরিশোধ করতে হবে। 

অন্যদিকে কেউ সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব সহ বেসব দেশ থেকে আসতে চাইলে তাদের জন্য বিশেষ দিবেন বলে আমাদের জানান। 

ইনফোমাইগ্রেন্টস জিজ্ঞেস করে আলবেনিয়ার সাথে তো কোনো শেঙ্গেন দেশের সরাসরি কোন সীমান্ত নেই সেক্ষেত্রে এরকম ভয়ংকর পথ কিভাবে পাড়ি দেয়া যাবে। জবাবে উক্ত ব্যক্তি বলেন, সেখানে এসে অনেকের সাথে পরিচয় হয়ে যাবে কোন সমস্যা নেই। 

অনিশ্চিত গন্তব্য

প্রকৃতপক্ষে ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে দেখা গেছে তারা যেই টাকার পরিমাণ বলে সেটি মূলত আলবেনিয়া পর্যন্ত। আলবেনিয়া থেকে কসোভো, সার্বিয়া, বসনিয়াসহ বিভিন্ন দেশ পার হয়ে ইউরোপের শেঙ্গেন অঞ্চলে প্রবেশ করা বর্তমানে এক প্রকার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার শামিল। তার পাশাপাশি আরও অতিরিক্ত ২/৩ লাখ টকার খরচ। 

অনিয়মিত অভিবাসনের প্রতিটি ফাঁদে দালালরা এমনভাবে প্রস্তাব ও টাকার পরিমাণ বলে থাকে যা শুনলে একজন সাধারণ মানুষের মনে হবে ইউরোপে প্রবেশ খুব সহজ।

পাচারকারীরা কখনো পুরো টাকার কথা বলে না। বিভিন্ন ধাপে গিয়ে তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তখন বাধ্য হয়ে মাঝপথে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা নতুন দালাল ধরে যে কোনো মূল্যে ইউরোপে প্রবেশ করতে চান। 

আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন ট্রানজিট দেশের জঙ্গলে আটক রেখে মারধর করে টাকা আদায়। এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় অত্যন্ত নির্দয়ভাবে নির্যাতন করা হয়ে থাকে। অনেকে অভিবাসনপ্রত্যাশী লিবিয়া, তুরস্ক, বসনিয়ায় পাচারকারীদের নির্যাতনের আঘাতে পঙ্গুত্ব পর্যন্ত বরণ করেছে।

এমতাবস্থায় জীবনের নিরাপত্তা, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের লক্ষ্যে প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলার আগে ভালোভাবে চিন্তা করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনে বাংলাদেশিসহ সকল দেশের নাগরিকদের মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে পারে সচেতনতা। একটি সচেতন সিদ্ধান্তই পারে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং দেশকে রক্ষা করতে। 



এমএইউ/এসএস


 

অন্যান্য প্রতিবেদন