সিরিয়া, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শরণার্থীরা ফ্রান্সে রেস্তরাঁয় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছেন। তাদের অনেকে ইউরোপে আসার আগ অবধি জীবনে কখনো রান্নাঘরের ছুরিও স্পর্শ করেননি। তাসত্ত্বেও রন্ধনশিল্প নিয়ে আগ্রহী এই শরণার্থীরা এখন ফ্রান্সের ব্রোতাইন অঞ্চলের রেনে শহরে ভবিষ্যত ‘শেফ’ হতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন৷
ফরাসি সরকার স্বীকৃত ‘সেজাম’ নামক একটি পেশাদার প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তরুণ শরণার্থী শিক্ষার্থীরা এই কোর্সে অংশগ্রহণ করছে।
মাইকেল যখন ছয় বছর আগে ফ্রান্সের কালে শহরে পা রেখেছিলেন, তখন তার পরিষ্কার লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডে পৌঁছানো। কিন্তু কালে "জঙ্গলের" ভয়াবহ জীবনযাত্রার অবস্থা, অত্যধিক ঠান্ডা এবং নিরাপত্তাহীনতা তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। মাইকেল বলেন, "কালেতে প্রতিটি দিন এত কঠিন ছিল, আমি নিজেকে নিজে বলছিলাম আমি এখানে বেশি দিন থাকতে পারব না।"
এই তরুণ ইরিত্রিয়ান পরবর্তীতে ফ্রান্সে তার আশ্রয়ের আবেদন করে উত্তরের একটি শহরে ফরাসি ভাষা শিখতে শুরু করেন। বর্তমানে তিনি তার স্ত্রী এবং তিন সন্তানসহ একটি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আবারো তার জীবন গড়ে তুলছেন। বেশ কয়েক বছর কার্টুন সংগ্রহের কাজ করার পর বর্তমানে রেন শহরে রেস্তোরাঁ শিল্পে ক্যারিয়ার গড়ে তুলে জীবনকে এগিয়ে নিতে চান এই শরণার্থী।

অক্টোবর মাসের আজকের সকালটি বৃষ্টিস্নাত। ব্রোতাইন অঞ্চলের রাজধানী রেন শহরের পশ্চিমে অবস্থিত শিল্প এলাকাটির ধূসর রং হালকা বৃষ্টিপাতের ফলে সতেজ হয়ে উঠেছে। ধূসরতা দূর করে জীবন্ত অনুপ্রেরণা নিয়ে ট্রেনিং সেন্টারের বড় হলে দিনের সূচনা করছেন মাইকেল এবং তার আট সহপাঠী। দিনের শুরুতে তারা আজকে একটি "সিরিয়ান" ফুলকপির মেন্যু তৈরিতে ব্যস্ত। এটি দই ও শসার সস দিয়ে তৈরি করে লেটুস পাতা, টমেটো এবং পেঁয়াজের সমন্বয়ে তৈরি একটি সালাদ দিয়ে পরিবেশন করা হয়। শিক্ষানবিশদের মধ্যে সুহাইল এবং হাসান ফুলকপিগুলিকে কাটছেন। কিজান এবং মাইকেল শসার খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত এবং অন্যরা পার্সলে এবং টমেটো কেটে টুকরো করছেন।

প্রেরণা, প্রধান পূর্বশর্ত
এই সহকারী শেফ প্রশিক্ষণ কোর্সটি মূলত ফরাসি ইমিগ্রেশন বিষয়ক দপ্তর অফি, চাকুরিদাতা সংস্থা পোল অপ্লোয়া এবং বিভিন্ন পেশাদারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় সরাক্রির অর্থায়নে আয়োজন করা হয়ে থাকে। ফ্রান্সে শরণার্থী এবং আন্তর্জাতিক সুরক্ষা মর্যাদাপ্রাপ্ত সকল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এই কোর্সটি উন্মুক্ত। সাড়ে পাঁচ মাস মেয়াদী এই কোর্সটিতে শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক রান্নার ক্লাসে উপস্থিত হয়ে ক্যাটারিংয়ের প্রাথমিক বিষয়গুলি শিখে থাকেন। পাশাপাশি তাদেরকে ফরাসি ভাষার পাঠও দেয়া হয়ে থাকে। কোর্স সম্পন্ন হলে রন্ধন শিল্পের পাশাপাশি তাদেরকে ‘এটু’ স্তর সমমানের ফরাসি ভাষার সনদও প্রদান করা হয়।
প্রশিক্ষণের সময় শিক্ষার্থীরা যেকোনো একটি চুক্তিবদ্ধ রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে দুই সপ্তাহের "লাইভ" ইন্টার্নশিপও সম্পন্ন করার সুযোগ পায়। তবে এই দুই সপ্তাহের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের দক্ষতা সম্পর্কে বিচার করা হয় না, কারণ কারও কারও ক্ষেত্রে এই সেক্টরে কাজ করা সম্পূর্ণ নতুন।র
রিফিউজি ফুড নামক সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী জুলিয়া গুয়েজনিগার বলেন, “মনোযোগী ও রন্ধন শিল্পে অনুপ্রাণিত হওয়া এই প্রশিক্ষণে আবেদনের প্রধান শর্ত। কেউ যদি জীবনে রান্নাঘরের ছুরিও স্পর্শ করে না থাকে সেটিও বড় বিষয় নয়। মূলত আমরা তাদেরকে বলি তারা যেন শেষ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে কোর্স সম্পন্ন করে তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে।"
নিবন্ধনের জন্য প্রতিটি প্রার্থীকে এ১ স্তরের ফরাসি ভাষার দক্ষতার পরীক্ষা ও সাথে কিছু সাধারণ প্রশ্নোত্তর যেখানে যুক্তি এবং দক্ষতার বিচার করা যায়, এরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এছাড়া প্রশিক্ষণ সহকারী ভেরোনিক কুইবেলের সাথে একটি সাক্ষাত্কার দিতে হয়।
সম্প্রতি সেজামের ৩ নম্বর সেশনের দশজন শিক্ষার্থী সবাই পাস করে কোর্স সম্পন্ন করেছে। কোর্সে অংশগ্রহণ করা একজন শিক্ষার্থী রাদ বলেন, ‘‘সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছিল যখন আমাদেরকে ফরাসি গ্যাস্ট্রোনমির কৌশল শিখতে হয়েছিল। কারণ এখানে রন্ধনপ্রণালী বেশ জটিল এবং সবকিছুই আলাদা। ২০১৮ সালে ফ্রান্সে আসার আগে ২২ বছর বয়সি এই ইরাকি তার বাবার সাথে মাঝেমধ্যে রান্না করেতেন। তিনি যোগ করেন, “আমার সেই রান্নার সাথে এখানে যা শিখেছি তার কোনো সম্পর্ক নেই৷" কিন্তু তিনি একইভাবে একটি মহান আবিষ্কার করেছিলেন: "ফয়ে গ্রাস", তিনি হাসলেন।

শ্রমিক সংকটময় একটি খাত
সফলভাবে কোর্স সমাপ্তির পর শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান খোঁজার জন্য অতিরিক্ত দুই মাস পূর্ণ সমর্থন দিয়ে সহায়তা করা হয়। জুলিয়া গুয়েজনিগার বলেন, "সিভি তৈরি এবং চাকরির সাক্ষাৎকারের প্রস্তুতি নিতে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এছাড়া রেস্টুরেন্ট শিল্পে কাজের অধিকার সম্পর্কে জানার শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।"
এই বছর করোনা মহামারিজনিত কারণে বর্তমানে ফ্রান্সে এ খাতটি বড় ধরনের শ্রমিক সংকটে ভুগছে। ফরাসি গবেষণা, অধ্যয়ন ও পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের (ডিএআরইএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের বসন্ত পর্যন্ত এখনো ২ লাখ ৪০ হাজার পদ খালি রয়ে গেছে।
বর্তমানে কর্মরত শিক্ষানবিশদের মধ্যে তিনজন ইতিমধ্যে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ থেকে চাকরির প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। সুহাইল, যার দামেস্কে নিজস্ব একটি রেস্তোরাঁ ছিল, ইতিমধ্যেই জানেন যে, চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে রেন শহরের কেন্দ্রে লুপ নামে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করবেন তিনি।
সুহাইল গর্ব করে বলেন, "আমার রান্না করা গরুর মাংসের মেন্যু ভালো লাগায় একদিন বেশ কিছু গ্রাহক আমাকে অভিনন্দন জানাতে সরাসরি রান্নাঘরে প্রবেশ করেন। সেদিন প্রধান শেফ এবং আমি খুব খুশি ছিলাম।"
সুহাইল ইন্টার্নশিপ করার পর থেকেই লুপ রেস্তোরাঁটি তাদের মেন্যুতে বেশ কিছু খাবার যোগ করেছে। যেমন মধ্যপ্রাচ্যের মেন্যু হমুস এখন ফরাসি খাবার রেস্তোরাঁর মেন্যুতে অন্তর্ভুক্ত যেটি সুহাইল কাজ করার আগে এই রেস্তোরায় বিক্রি হতো না।
এমএইউ/এআই