ফ্রান্সে অবস্থানরত অনেক বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, প্রথম দফায় আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়ার পর আদালতে আপিল করা হলেও তা শুনানি ছাড়াই প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন ফরাসি জাতীয় আদালত (সিএনডিএ)। ফরাসি আইনি পরিভাষায় ‘অরদোনোন্স’ হিসেবে পরিচিত এসব স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখানে বেশ উদ্বিগ্ন আশ্রয় আদালতে লড়াই করা আইনজীবীদের একটি বড় অংশ।
২৭ বছর বয়সি মুজাক্কির তার স্ত্রীসহ ২০২০ সালে সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সে আসেন। পরবর্তীতে এখানে তার একটি সন্তানের জন্ম হয়।
তিনি বলেন, "আমি যদি সিএনডিএ-তে অন্ততপক্ষে শুনানিতে যাওয়ার সুযোগ পেতাম তবে আমি নিশ্চিত যে বিচারককে [আমাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য] রাজি করাতে পারতাম। আমার কাছে আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ এবং নথিপত্র রয়েছে যা প্রমাণ করে আমি আশ্রয় পেতে যোগ্য।”
২০২১ সালের বসন্তে আশ্রয় আবেদন করার জন্য অফপ্রায় তার সাক্ষাত্কারের পরে তার সুরক্ষা আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। অফপ্রার সাক্ষাৎকার চলাকালে তিনি সেখানে উপস্থিত দোভাষী নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কথা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "দোভাষী [আমার স্ত্রীর] উচ্চারণ এবং স্থানীয় শব্দগুলো বুঝতে পারেনি।"
তবুও মুজাক্কির হাল ছাড়েননি। আইন অনুযায়ী, তিনি শেষবারের মতো আপিল আবেদন করেন আশ্রয় বিষয়ক ফরাসি জাতীয় আদালত (সিএনডিএ)। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে বিচারক তাকে শুনানিতে ডাকলে তার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি ভালোভাবে বোঝাতে পারবেন।
কিন্তু এই বহুল প্রতীক্ষিত শুনানিতে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ তিনি আর কখনোই পাবেন না। তিনি বলেন, "শুনানিতে উপস্থিত হওয়ার নোটিশ ছাড়াই আমি একটি স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান পত্র পেয়েছি।"
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে সিএনডিএ এর পাঠানো এই চিঠির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, আদালত মুজাক্কিরের আপিল আবেদন একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে খারিজ করে দিয়েছে। অর্থাৎ আশ্রয় আদালতের বিচারক এই বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীর কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেননি। যেকারণে তার আশ্রয় আবেদন আবারও খারিজ হয়ে যায়।
মুজাক্কির দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “বিচারকের সামনে শুনানিতে উপস্থিত হওয়া ছাড়াও যে আদালত আবেদন প্রত্যাখান করতে পারে সেটি আমার জানা ছিল না। আমি বিচারকের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম, তাকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলাম কেন আমি এখানে এসেছি। আমি আশাবাদী ছিলাম ..."
চলতি বছর আদালতের আদেশের মাধ্যমে খারিজ হওয়া আশ্রয় আবেদনের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি নিয়ে বেশ কয়েকজন আইনজীবী উদ্বেগ জানিয়েছেন। কারণ স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান সাধারণত ফরাসি আশ্রয় আইন অনুযায়ী যেসব দেশ আশ্রয় আবেদনের বিশেষ তালিকায় "নিরাপদ" দেশ হিসেবে নথিভুক্ত তাদের ক্ষেত্রে প্রদান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ফরাসি সরকারের নিরাপদ দেশগুলোর তালিকায় নেই।
"২০ বছরের আইন পেশায় বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত পাইনি"
সিএনডিএ তাদের ব্যাখ্যায় জানায়, অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে কারো আশ্রয় আবেদন অফপ্রা থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে এবং সেই আশ্রয় আবেদনে নির্দিষ্ট ও গুরুতর কোনো তথ্য ও উপাদান খুঁজে পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে শুনানি তে ডাকা ছাড়াই আদালত একটি অর্দোনোন্স বা প্রত্যাখ্যান জারি করে থাকে।
আইনজীবীদের কাছে আদালতের এই ব্যাখ্যাটি বোধগম্য নয়। বৃহত্তর প্যারিস অঞ্চলের আওতাধীন হউ-দ্য-সেইন বা ৯২ ডিপার্টমেন্টের বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্ত আইনজীবি সুহিলা নাদুর বলেন, "আমরা দেখতে পাচ্ছি দীর্ঘ আইনি সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে এ সকল অপব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। একজন ব্যক্তির বক্তব্য না শুনেই রায় দেয়ার নীতিটি আমাদের হতবাক করেছে কারণ সেই ব্যক্তিকে ন্যায্য বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে আশ্রয় আইনে সুরক্ষার অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে।"
বেশ কয়েকজন আইনজীবী সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে দেয়া স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান আদেশ বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।
"সিএনডিএ-তে আমি ২০ বছর ধরে আশ্রয়প্রার্থীদের হয়ে লড়ছি, আমি কখনই একজন বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীকে শুনানি ছাড়া রায় বা অর্দোনোন্স পেতে দেখি নি,’’ বলেন তিনি৷
‘‘২০২১ এর শুরু থেকে আমি সহ আমার অন্যান্য আইনজীবী সহকর্মীরা বাংলাদেশিদের আবেদনের ক্ষেত্রে গণহারে অর্দোনোন্স আদেশ পেয়েছি," যোগ করেন এই আইনজীবী৷
একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রত্যাখ্যাত আশ্রয় আবেদনের সংখ্যা পূরণ করতে আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হচ্ছে বলে দাবি করে আইনজীবী সুহিলা নাদুর যোগ করেন, “যদিও ২০২১ সাল এখনো শেষ হয়নি এর মধ্যেই বাংলাদেশিদের ফাইল প্রত্যাখ্যানের সংখ্যা ১৪০০-এরও বেশি ছাড়িয়েছে। আইনজীবীদের ধর্মঘট ও কোভিড ১৯ জনিত লকডাউন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে বারবার আদালত বন্ধ থাকায় পূর্ণ ক্ষমতায় স্বাভাবিক গতিতে আদালতের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয় নি।"
এ ব্যাপারটি নিয়ে আরেক আইনজীবী উদ রিমেইলহোর ক্ষোভ অনেকটা একই রকম। বিদেশিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা এই বিশেষজ্ঞ আইনজীবী বলেন, "এর আগে আমার চেম্বারে আমি খুব কমই এ জাতীয় রায় প্রাপ্ত আবেদনকারীদের পেয়েছি। কিন্তু এই গ্রীষ্মে আমি বেশ কয়েকটি ফাইল পেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে আমার চেম্বারে মাসে তিন থেকে চারটি আবেদন শুনানি ছাড়াই প্রত্যাখ্যান হচ্ছে। যা সংখ্যায় অনেক! এর আগে বাংলাদেশিদের সাধারণত অর্দোনন্স বা স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান করা হতো না, এখন সেগুলি শত শত আবেদনকারীদের দেয়া হচ্ছে।"
শুধু বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে কোনো বিশেষ রায় দেয়া হচ্ছেনা: সিএনডিএ
ফরাসি জাতীয় আশ্রয় আদালত (সিএনডিএ)-র ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইসাবেল ডেলি আইনজীবীদের উত্থাপন করা পরিসংখ্যান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে ইনফোমাইগ্রেন্টস বলেন, "আমাদের কাছে এখনো এই বছরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান নেই।”
কিন্তু, মোট সিদ্ধান্তের বিপরীতে আদালতের স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যান বা অর্দোনন্স দেয়ার হার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক হারে বেড়েছে। যেমন ২০১৮ সালে ৩৪%, ২০১৯ সালে ৩৩.৫% এবং ২০২০ সালে ৩২% ছিল। ২০২১ শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত এটি ৩০%। অর্থাৎ বছরের শেষে এই সংখ্যায় তেমন বড় কোনো রদবদল হবে না।
আমি নিজেও জানি না আমার দোষ কী?
সিএনডিএ কি তাহলে বাংলাদেশিদের বিষয়ে বিচারকদের বিশেষ কোনো নির্দেশনা দিয়েছে? উত্তরে ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজাবেল ডেলি বলেন, ‘‘না, একেবারেই না। বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীদের "লক্ষ্যবস্তু" বানানোর মতো কোন উদ্দেশ্য সিএনডিএ’র নেই।’’
তাহলে আইনজীবীদের উত্থাপন করা সংখ্যাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? ইনফোমাইগ্রেন্টসের এই প্রশ্নের জবাবে ইজাবেল ডেলি বলেন, "সম্ভবত অতীতের অভিজ্ঞতায় বিচারকদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে।"
রিফাত* নামে ২৬ বছর বয়সি এক বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীও স্বয়ংক্রিয় প্রত্যাখ্যানের খবরে হতাশ হয়ে পড়েছেন৷
অন্য অনেকের মত তিনিও ইনফোমাইগ্রেন্টসের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি বলেন, “চলতি মাসে আমি জানতে পারি বিচারক শুনানিতে তলব না করেই আমার আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। আদালতের চিঠি হাতে পেয়ে আমি খুব মর্মাহত হয়েছিলাম।’’
রিফাত বলেন, “চিঠিতে লিখা আমার ফাইলে কোনো গুরুতর উপাদান নেই বলে বলা হচ্ছে৷ এটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত ব্যাপার, কারণ অতীতে আমি রাজনৈতিক কারণে এক মাস জেলে ছিলাম।”
তিনি যোগ করেন, ‘‘আমি যে রাজনৈতিক কারণে ভুক্তভোগী তা প্রমাণ করার জন্য আমার কাছে যথেষ্ট নথি আছে। কিন্তু আমি আমার সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাইনি। এমনকি আমি জানি না আমার দোষগুলো কী। বিচারক আমাকে কেন শুনানিতে ডাকনে নি?’’
"বিচারকের সামনে উপস্থিত হতে পারা একজন আশ্রয়প্রার্থীর জন্য অপরিহার্য"
সিএনডিএ জানায়, প্রাপ্ত আপিল আবেদনগুলির কোনটিই আসলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয় না। সমস্ত আবেদনগুলি অন্তত আদালতের একজন পর্যবেক্ষককে দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়, তারপরে সেটি একজন স্থায়ী বিচারক মূল্যায়ন করেন। অর্থাৎ সবসময় একজন বিচারক আপিল আবেদন মূল্যায়ন করে থাকেন।"
তবে বিদেশিদের অধিকার বিষয়ক আইনজীবী উদ রিমেইলহোর বিবেচনায় ব্যাখ্যাটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি বলেন, "এটি অগ্রহণযোগ্য। একজন সিএনডিএ বিচারকের সাথে কথা বলতে সক্ষম হওয়া একজন আশ্রয়প্রার্থীর জন্য অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ।"
তার মতে, অফপ্রায় আশ্রয় প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায়ে সাধারণত তারাই ব্যর্থ হন যারা বুঝে উঠতে পারেন না কিভাবে তার সমস্যা তুলে ধরবেন। অনেকের আবার দোভাষীর সাথে ভালোভাবে সাক্ষাৎকার চালিয়ে যেতে পারেন না। কারণ সব দোভাষী সব আঞ্চলিক উচ্চারণ জানেন না বা দক্ষ নয়।"
তিনি যোগ করেন, এ সমস্ত উদাহরণগুলি প্রমাণ করে যে অফপ্রাতে ব্যর্থ হওয়া প্রত্যেক আশ্রয় প্রার্থীর জন্য সিএনডিএ শুনানি অপরিহার্য।"
রিফাত, মুজাক্কির এবং আরো অনেক বাংলাদেশির জন্য শীত ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে আসছে। কারণ একবার আদালত থেকে আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যান হলে সাধারণত আশ্রয় প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত বিশেষ বাসা এক মাসের মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়।
উদ্বিগ্ন রিফাত বলেন, ‘‘আমি জানি না আমি এখন কী করবো। আমাকে ১৭ নভেম্বরের আগে আমার বাসস্থান ছেড়ে যেতে হবে। অর্থাৎ সিএনডিএ থেকে চিঠি পাওয়ার এক মাসের মধ্যে।"
অন্যদিকে, মুজাক্কির ইতোমধ্যে তার কাদা বা আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করেছেন। তিনি বলেন, "জীবন খুব জটিল হয়ে উঠছে। আমি এখন ইল-দ্যো-ফ্রান্স বা বৃহত্তর প্যারিস অঞ্চলে একজন পরিচিত ব্যক্তির বাসায় আছি। কিন্তু এখানে আমি বেশিদিন থাকতে পারবো না।”
সম্ভবত থাকার জায়গা পেতে আমি জরুরি সরকারি আবাসন বিষয়ক দপ্তর বা ১১৫ নাম্বারে ফোন দেয়া শুরু করবো। আমার মেয়ের বয়স এখন নয় মাস। সুতরাং বাসা ছাড়া আমার জন্য বাইরে থাকা খুব কঠিন হবে।"
এমএইউ/এআই