লিবিয়ায় আটক থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ছবি ফেসবুকে খুঁজে পায় ইটালির একটি সংবাদপত্র। সাংবাদিকদের মতে, এই ছবি দেখে কেউ হয়তো আটক অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মুক্তিপণ দিয়ে দেবে।
কয়েকজন অভিবাসনপ্রত্যাশীর ছবি ফেসবুকের বিভিন্ন পাতায় খুঁজে পেয়েছেন ইটালির সংবাদপত্র ইল ফাত্তো কুওতিদিয়ানো সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, অভিবাসনপ্রত্যাশীদের হাতে ধরা কাগজে লেখা নম্বর। সাংবাদিকদের ধারণা, এইসব ছবির পোস্ট যত বেশি করে ছড়িয়ে পড়বে, তত বেশি সুযোগ রয়েছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পরিচিতদের নজরে আসার। আর তা যদি হয়, সেক্ষেত্র আটক অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মুক্তিপণের টাকা আদায় করতে পারবে দালালরা, ধারণা সংবাদপত্রটি।
এমনই একটি ফেসবুক পোস্টে লেখা ছিল, "এই ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের বাবা-মা বহু বছর এদের কোনো খোঁজ পাননি। কেউ এদের চিনতে পারলে অবিলম্বে তাদের পরিবারকে জানান।"
এই ধরনের সুপরিকল্পিত ব্ল্যাকমেইলের উদ্দেশ্যই হচ্ছে পরিবারের মানুষদের উদ্বিগ্ন করে তোলা, যাতে করে তারা বছরের পর বছর ধরে আটকে থাকা পরিজনদের মুক্তির জন্য টাকা নির্দ্বিধায় দিয়ে দেন।
ছবিতে থাকা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে অনেকেরই পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বা অনেকের ধারণা, 'তাদের জন্য আর কেউ অপেক্ষা করে নেই'। তাদের চোখে মুখে ভয় ও ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট ধরা পড়ছে। ইল ফাত্তো কুওতিদিয়ানোর মতে, "কোনো কোনো অভিবাসনপ্রত্যাশীর মুখ-চোখ ফোলা, আছে আঘাতের চিহ্ন"।
যে ফেসবুক পোস্টের কথা বলছে এই সংবাদপত্রটি, তা দেখলে মনে হবে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা বাজারে বিক্রির পণ্য, বা থানায় অভিযুক্তদের মতো সার বেঁধে দাঁড়ানো। এদের বেশিরভাগই সাব-সাহারান আফ্রিকার মানুষ বলে জানাচ্ছে পত্রিকাটি।
মানুষ যখন এটিএম
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংগঠন ইউএনএইচসিআরের লিবিয়া কার্যালয়ের ক্যারোলিন গ্লুকের মতে, এমন জিনিস তার অভিজ্ঞতায় প্রথম। ইল ফাত্তো কুওতিদিয়ানোকে তিনি বলেন যে, "টাকা আদায় করতে অভিবাসীদের আটক করা ও অত্যাচার করার বিষয়টি দুর্ভাগ্যবশত অত্যন্ত সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
ইল ফাত্তো কুওতিদিয়ানোকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নাইজেরিয়ান অভিবাসনপ্রত্যাশী বলেন, "লিবিয়ায় অপরাধীরা সময় নষ্ট করে না বলেই মানুষকে শুধু একটা এটিএম বা টাকা তোলার মেশিনের মতো দেখে।"
তিনি আরো বলেন, "এই ব্যবস্থা খুব একটা জটিল নয়। নাইজের, আলজেরিয়া, শাদ ও সুদানের মতো দেশের সাথে থাকা লিবিয়ার সীমান্তে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের থামায় ও ত্রিপলি পর্যন্ত নিয়ে যাবার মিথ্যা আশ্বাস দেয়। এর জন্য আগে থেকে তাদের টাকা দিতে হয়।"
কিন্তু অভিবাসীরা কখনোই জানতে পারেন না যে আদৌ তারা ত্রিপলি পৌঁছাতে পারবেন, নাকি তাদেরকে বিভিন্ন দালালচক্রের হাতে তুলে দেওয়া হবে, যারা ভূমধ্যসাগর পার করাবার কাজ করে থাকে। এখান থেকে কাহিনির সূত্রপাত।
'টাকা ছাড়া মুক্তি নেই'
২০১১ সালে গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর থেকেই লিবিয়া হয়ে উঠেছে ইউরোপগামী অভিবাসনের কেন্দ্র। কিন্তু ইউরোপের দিকে যাওয়ার আগে লিবিয়ায় জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। এর থেকে মুক্তির পথ একটাই৷ আর তা হলো টাকা।
জাউইয়ার কাছে একটি গোপন কারাগারে বন্দি থাকা আসানে (নাম পরিবর্তিত) ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, "আমার কোনো প্রয়োজন তাদের কাছে একটা সময়ে ছিল না। তাই টাকার বদলে তারা আমাকে অন্য একজনকে দিয়ে দেয়। এরপর আমার এক বন্ধু টাকা দিলে আমি মুক্তি পাই।"
আরেক অভিবাসী দাউদা (নাম পরিবর্তিত) একই পন্থা অবলম্বন করতে চান। কিন্তু তার বোনের মতে, "আমাদের বাবা টাকা জোগাড় করলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।"
কারাগার থেকে পালাতে গিয়ে রক্ষীদের গুলিতে মারা যায় দাউদা।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে তিনবার ব্যর্থ হওয়া সালিফ (নাম পরিবর্তিত) বলে, "অভিবাসীদের লিবিয়ার তটে ফেরত পাঠাবার পরই আবার আটককেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বেরোতে অন্তত তিন হাজার লিবিয়ান দিনার (সাড়ে পাঁচশ ইউরোর সমান) টাকা দিতে হয়। রক্ষীরা আমাদের প্রথমেই জিজ্ঞেস করে নেয় যে, এখান থেকে বের হবার টাকা আমাদের মধ্যে কার কাছে আছে।"
এসএস/আরআর