কালে উপকূলে নাটকীয় নৌকাডুবিতে নারী ও শিশুসহ ২৭ জন অভিবাসীর মৃত্যুর ঘটনায় মানব পাচারের সাথে জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার পর তদন্ত চলছে, উপকূল ছেড়ে যাওয়া নৌকাটি ফ্রান্সের উত্তরের ডানকের্ক থেকে যাত্রা করে ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন করেছিল বলে জানা গেছে।
চ্যানেলের ফরাসি উপকূলে নৌকাডুবিতে ২৭ অভিবাসীর ভয়াবহ মৃত্যুর ঘটনায় প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পাচারকারী সন্দেহে পাঁচ ব্যাক্তিকে আটক করা হয়েছে।
গতকাল রাত থেকে এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত পাচারকারী সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরা দারমানা’র মতে, রাতে গ্রেপ্তার হওয়া পঞ্চম ব্যাক্তির কাছে গাড়িতে ব্যবহৃত "একটি জার্মান নাম্বার প্লেট" পাওয়া গেছে। তিনি জার্মানি থেকে বিশেষ জোডিয়াক জেট-স্কি সদৃশ নৌকা কিনেছিলেন।"
ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও যোগ করেন, “এই মুহূর্তে এই ঘটনা সম্পর্কে তার কাছে বিশদ বিবরণ নেই৷”

এদিকে ঘটনার পর নিহতদের ব্যাপারে প্রাথমিক তথ্য আসা শুরু হয়েছে। একটি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, “ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ১৭ জন পুরুষ ও সাতজন নারীর পাশাপাশি কিশোর ও শিশুও রয়েছে।”
বৃহস্পতিবার সকালে ফরাসি রেডিও আরটিএল-এ ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “নৌকা ডুবিতে বেঁচে যাওয়া দুই অভিবাসী এখন সুস্থ আছেন। যদিও গতকাল তারা গুরুতর হাইপোথার্মিয়াতে আক্রান্ত ছিল তবে এখন তারা সুস্থ আছেন।”
ঘটনার বিস্তারিত জানতে দ্রুত তাদের বক্তব্য শোনা হবে বলে জানান মন্ত্রী।
নৌকাটি ডানকের্ক উপকূল থেকে ছেড়েছিল
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি মূলত একটি "লম্বা নৌকায়" ঘটেছিল। এটি ছিল একটি ভঙ্গুর ভাসমান নৌকা যার পাটাতন অত্যন্ত হালকা। এ নৌকাগুলো মূলত বিভিন্ন সৈকতে জেট-স্কি হিসেবে ব্যবহার করা হয় কিংবা লেক বা জলাশয়ে সর্বোচ্চ ১০ জন ব্যক্তির প্রমোদ ভ্রমণে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ বছরের গ্রীষ্মের পর থেকেই পাচারকারীরা সমুদ্র পাড়ি দিতে ব্যাপক হারে এ ধরনের নৌকা ব্যবহার করা শুরু করেছে।
ঘটনার সাথে পরিচিত একটি সূত্র জানিয়েছে, ডুবে যাওয়া নৌকাটি কালে অঞ্চলের ডানকের্ক উপকূল থেকে ছেড়েছিল। ডুবে যাওয়া নৌকাটির ধ্বংসাবশেষ জব্দ করা হয়েছে।
ঘটনার কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট হতে এগুলো পরীক্ষা করা হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় পাবলিক প্রসিকিউটর বলেছেন।
বুলোন-সুর-মের অঞ্চলের উদ্ধার কার্যক্রম কর্তৃপক্ষ বা এসএনএসএম স্টেশনের প্রেসিডেন্ট বার্নার্ড ব্যারন ফরাসি দৈনিক ওয়েস্ট-ফ্রান্সকে বলেন, "অভিবাসন সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা এই বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছি। অভিবাসীরা এখন এ ধরনের ভাসমান হাল্কা নৌকায় সমুদ্রে পাড়ি দিতে রওনা দিচ্ছে যেটিকে আমরা আইআরবি বলি। এসব হল ভাসমান ব্যাগ সদৃশ নৌকায় সর্বোচ্চ দশ জন লোককে পরিবহন করা যায়। তবে পাচার কাজে এর চেয়ে অনেক বেশি লোককে নৌকায় তুলে অত্যধিক ভারী করে ফেলা হয় সেটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়"।
এই মর্মান্তিক ঘটনার পরে অভিবাসীদের অবৈধ প্রবেশ ও পাচারে অভিযুক্ত থাকাসহ অভিবাসীদের ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার অভিযোগে বিচারিক তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে লিলের বিশেষায়িত আন্তঃআঞ্চলিক বিচার আদালত (জিরস)। তদন্তে সীমান্ত পুলিশ (পিএএফ) ও মেরিটাইম জেন্ডারমেরির পাশাপাশি অনিয়মিত অভিবাসন দমন ও নথিহীন অভিবাসীদের উপর সহিংসতা রোধে গঠিত কেন্দ্রীয় দপ্তর (অক্রিয়েস্ট) এর সহায়তা নেয়া হবে বলে জানা গেছে।
"বছরের শুরু থেকে গ্রেফতার ১,৫০০পাচারকারী"
ফরাসি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় মাতিনিও থেকে জানানো হইয়েছে, চ্যানেলে মর্মান্তিক নৌকাডুবির পরে অভিবাসী পারাপার ইস্যু নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে জরুরী আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছেন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জঁ কাস্টেক্স। এই বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরা দারমানা, বিচার বিষয়ক মন্ত্রী এরিক ডুপো মোরেত্তি, সশস্ত্র বাহিনী মন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লি, পররাষ্ট্র মন্ত্রী জঁ ইভ-লো-দ্রিও এবং ইউরোপের বিষয়ক মুখপাত্র ক্লেমো বিউন সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার অতীত রেকর্ড তুলে ধরে বলেছেন, “১ জানুয়ারি থেকে আমরা ১,৫০০ পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছি। পাচারকারীরা "মাফিয়া সংগঠন" হিসাবে কাজ করে। তারা বিশেষ টেলিফোন ব্যবহার করে যাতে করে তাদের গতিবিধি ধরা না যায়। এগুলো সংগঠিত অপরাধের আওতায় পড়ে"।
২০২১ সালেই ইতিমধ্যে ২৪ জনের মৃত্যু
বুধবারের ঘটনার আগে ১২ নভেম্বর, ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর চেষ্টা করে তিনজন মারা যান। যেখানে নিখোঁজ রয়েছেন আরও চারজন। এইভাবে চলতি বছর মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ এ । ২০২০ সালে, ছয় অভিবাসী সমুদ্রে মারা গিয়েছিল এবং আরও তিনজন নিখোঁজ হয়েছিল। ২০১৯ সালে চারজন ব্যক্তির মৃত্যু নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
কয়েক মাস ধরে, ইংল্যান্ডে অভিবাসীদের পারাপার প্রতিরোধ করতে ফ্রান্সের উত্তর উপকূলকে ব্যাপক সামরিকীকরণ করা হয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও চ্যানেল পাড়ি দেয়ার চেষ্টা বাড়ছে। এমনকি গত তিন মাসে অতীতের তুলনায় চ্যানেল ক্রসিং দ্বিগুণ হয়েছেন। চ্যানেল এবং উত্তর সাগর বিষয় ম্যারিটাইম প্রেফেকচুরের প্রধান ফিলিপ দুত্রিও গত শুক্রবার চ্যানেলে অভিবাসন সংকট নিয়ে সতর্ক করেছিলেন।
এর আগে জেরা দারমানা সোমবার ঘোষণা করেছিলেন, উপকূলে অবৈধ পারাপার প্রতিরোধ করার জন্য অতিরিক্ত উপায় হিসেবে উপকুলে অত্যাধুনিক ক্যামেরা সহ বিভিন্ন প্রযুক্তি স্থাপন করা হবে।
২০২১ সালের শুরু থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩১,৫০০ অভিবাসী উপকূল ছেড়েছে এবং ৭,৮০০ অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফিলিপ দুত্রিও। শীতের আগমনে তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও চ্যানেল ক্রসিং কমছে না।
এমএইউ/এসএস