(ফাইল ছবি) মরক্কো থেকে স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা অভিবাসন প্রত্যাশীদের একটি বোট। ছবি: রয়টার্স
(ফাইল ছবি) মরক্কো থেকে স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা অভিবাসন প্রত্যাশীদের একটি বোট। ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশ থেকে আলজেরিয়া, মরক্কো হয়ে বারবার ‘গেম’ মেরে ব্যর্থ হয়ে দীর্ঘ আড়াই বছর বিভিন্ন রুটে থাকার পর অবশেষে ৯ নভেম্বর স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছেন অভিবাসন প্রত্যাশী জামাল (ছদ্মনাম)। ইনফোমাইগ্রেন্টসের পাঠকদের জন্য জামালের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সরাসরি তার প্রত্যক্ষ বর্ণনায় তুলে ধরা হলো।

বিদেশে ভাগ্য পরিবর্তন খুব সহজ। সহজে চাকুরি পাওয়া যায়, অনেক টাকা! এ ধরনের চমকপ্রদ তথ্যের ফাদেঁ পরে বিদেশ পাড়ি দিতে ইচ্ছুক হয়ে উঠেন বাংলাদেশের নাগরিক জামাল*। বিভিন্নভাবে বিদেশে যাবার জন্য চেষ্টা করে নিরব নামের এক ব্যক্তির সাক্ষাৎ পান তিনি। 

কিন্তু এই ব্যক্তি যে মানবপাচার চক্রের একজন সদস্য তা বুঝতে না পেরে ইউরোপে প্রবেশের উদ্দেশ্যে প্রথম দফায় বাংলাদেশ থেকে আলজেরিয়া আসতে ৪ লাখ টাকায় জামালসহ আরও তিনজন চুক্তিবদ্ধ হন। 

চুক্তি অনুযায়ী জামালসহ আরও চার ব্যক্তি ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু করেন ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা। 

বাংলাদেশ থেকে আলজেরিয়া

দালালের দেখানো পথ অনুসারে ইউরোপে আসার প্রথম রুট হিসেবে জামাল বেঁছে নেন আলজেরিয়াকে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে সরাসরি বিমানযোগে তিনি পৌঁছান আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে। 

রাজধানীর একটি জায়গায় তাদেরকে প্রায় এক সপ্তাহ রাখার পরে তাদেরকে মরক্কো প্রবেশ করানোর উদ্দেশ্যে সীমান্তের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। 

জামাল বলেন, “দালাল নিরব আমাদের ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে মরক্কোতে গেম করে দেয়ার কথা বললে আমরা রাজী হই। আমরা একসাথে প্রায় ২০ জন বাংলাদেশি সেখানে ছিলাম। তবে টাকার পরিমাণ একেক জনের কাছ থেকে একেক রকম হতে পারে।”

সেখানে বাংলাদেশিরা ছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের আরও ৪০ জনের মতো লোক ছিল বলে নিশ্চিত করেন জামাল। 

প্রথমবারের মতো তারা সবাই মরক্কোতে প্রবেশের চেষ্টাকালে ধরা পড়ে যান আলজেরীয় সীমান্ত পুলিশের হাতে। পুলিশ তাদের গ্রেফতারের পরে এক জায়গায় আটকে রাখে। তাদের সাথে বিপুল পরিমাণ আফ্রিকান অধিবাসী থাকায় তাদের সাথেই বাস যোগে বাংলাদেশিদের ডিপোর্ট করা হয় আফ্রিকান দেশে ‘নাইজারে’। প্রায় ২ রাত ৩ দিন বাসে চড়ার পরে বন্দুক তাক করে তাদের সবাইকে নাইজারে প্রবেশ করিয়ে দেয় আলজেরীয় পুলিশ। বিষয়টি তাদের কাছে ছিল মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। কারণ এটি তাদের কল্পনাতেও ছিল না। সেখানে থাকা বাংলাদেশিরা এর আগে কখনো এই দেশটির নাম শুনেননি। 

আবারো আলজেরিয়া প্রবেশের চেষ্টা

নাইজারে তাদের দিন কাটতে শুরু করে খেয়ে না খেয়ে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না জামাল এবং তার সাথে থাকা বাংলাদেশিরা। তারা বারবার পাচারকারী নিরবের সাথে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন। এক সময় নিরব জানান, ২ লাখ টাকা করে দিলে তাদেরকে আবারো আলজেরিয়া ঢুকিয়ে দেয়া হবে। 

উপায়ন্তর না দেখে জামালসহ অন্যরা রাজী হয়ে যান। সেখানে তাদের অবস্থা খুব খারাপ ছিল৷ তাই দালালের একাউন্টে বাংলাদেশে থাকা জামালের ভাই দ্রুত টাকা জমা দেবে জানিয়ে দ্রুত তাদেরকে সেখান থেকে বের করার অনুরোধ করেন।

অবশেষে নাইজারে থাকার প্রায় ১০ দিন পরে তারা আবারো আলজেরিয়ায় আসতে সক্ষম হন। 

প্রসঙ্গত, এসব প্রবেশের প্রত্যেকবারে নিরব আলজেরিয়া, মরক্কো, নাইজারসহ সব দেশে থাকা পাচার চক্রের স্থানীয় প্রতিনিধির সাথে কথা বলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ফোনের জিপিএস পাঠাতে বলত। পরবর্তীতে ম্যাপ অনুযায়ী সেখান থেকে পাচারকারীরা তাদেরকে গাড়িতে সীমান্তের দিকে নিয়ে যেত। 

বারবার মরক্কোর জালে আটকে যাওয়া

আলজেরিয়ায় আসার পর জামালসহ অন্যদের অন্তিম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মরক্কো যাওয়া। কারণ একমাত্র মরক্কো থেকেই তাদের জন্য ইউরোপে প্রবেশ সহজ হবে। তারা আবারও নিরবের সাথে কথা বলা শুরু করেন। 

“আমি বারবার নিরবকে বলি ভাই আপনি আমাদেরকে দ্রুত মরক্কোতে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সে এবার উলটে যায়। সে জানায় তাকে যা টাকা দেয়া হয়েছে তা সব বড় বড় নেটওয়ার্ককে দিতে দিতে শেষ। তোমরা আরো টাকা যোগাড় করো, এই কথা বলে ফোন কেটে দেয়,” যোগ করেন জামাল। 

পরবর্তীতে আবারও তারা মরক্কোর উদ্দেশ্যে গেম মারার চেষ্টা করে ধরা পড়েন। তারপর আবারও কিছুদিন তারা সেখানে অবস্থান করেন। সর্বশেষ তৃতীয়বার গেমে মরক্কো তে প্রবেশ করতে সক্ষম হন জামাল। 

চূড়ান্ত লক্ষ্য স্পেন

মরক্কোতে আসলেও জামালসহ অন্যান্য অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সেখানে থাকার ইচ্ছে নেই। তাদের লক্ষ্য স্পেনের ভূখণ্ডে প্রবেশ করা। মরক্কো থেকে স্পেনে প্রবেশের বেশ কয়েকটি পথ আছে। একটি হলো মরক্কো থেকে স্পেনের সেওটা দ্বীপে আসা। অন্যটি হচ্ছে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে আসা। সাম্প্রতিক অভিবাসন ইস্যুতে সেওটা দ্বীপের সীমান্ত বেশ কড়াকড়ি হওয়ার খবর পৌছায় বাংলাদেশি, আফ্রিকানসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের কানে। এ কারণে তারা ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছানোর পথ খুঁজতে থাকেন। 

“মরক্কোতে আমি অত্যন্ত মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আমি অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় ৯ মাস আমি মরক্কো অপেক্ষা করছিলাম। দেশ থেকে বারবার টাকা আনতে আনতে আমি প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম,” বলেন জামাল। 

কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এবার তিনি ধরা পড়েন মরক্কো পুলিশের হাতে। পুলিশ ১৫ দিন জেলে রেখে তাকে আবারও আলজেরিয়াতে পাঠিয়ে দেয়। দুঃখের দিন আর জামালের শেষ হয় না! 

“আলজেরিয়াতে বেশ কিছু মাস থেকে নিরবকে আবারো দুই লাখ টাকা দিয়ে মরক্কো আসি। তবে এবার আমি নিরবের সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেই কারণ সে আমাকে স্পেনে পৌঁছে দিতে আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে।”

সেখানে থাকা অন্যান্য অভিবাসীদের মাধ্যমে তিনি হুমায়ুন নামের বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার এক নাগরিকের খোঁজ পান যিনি মরক্কোতে বসবাস করেন। হুমায়ুনের সাথে জামালসহ অন্যান্য অভিবাসীদের জনপ্রতি ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা চুক্তি হয় স্পেনে পৌঁছে দিতে। 

জামাল ব্যাখ্যা করেন, “আসলে দালালদের চক্রটি বিশাল একটি নেটওয়ার্ক। তারা আমাদেরকে মরক্কোর উপকূলবর্তী একটি শহরে নিয়ে আসে। তারা প্রত্যেক যাত্রার জন্য একটি বোটে দুইজন বোট চালাতে পারে এমন লোককে বাছাই করেন যারা সাধারনত আফ্রিকান হয়ে থাকে। সম্ভবত তাদের কাছ থেকে তেমন টাকা নেয়া হয় না।”

যাত্রার ঘটনা স্মরণ করে জামাল বলেন, “অবশেষে ৯ নভেম্বর ২০২১ তারিখে আমাদের যাত্রার দিন নির্ধারন করা হয়। আমরা ৫২ জন ছিলাম একটি বোটে। যেখানে প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন বাংলাদেশি, বাকিরা সবাই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের লোক। টানা কয়েকঘন্টা বোট চলার পরে আমরা বোট থেকে বারবার আওয়াজ করলে স্প্যানিশ বর্ডার গার্ডের বড় একটি জাহাজে আমাদের উদ্ধার করে ক্যানারি দ্বীপে নিয়ে আসা হয়।”

ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে আসার পরে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সবাইকে বাধ্যতামূলক কোভিড পরীক্ষা এবং ১৪ দিনের কোয়ারান্টাইনে রাখা হয়। কোয়ারান্টাইন শেষে জামাল এখন একটি ক্যাম্পে আছেন যেখানে তার সাথে আরও ৬ জন বাংলাদেশি আছেন। 

এভাবেই পাচারকারী চক্রের পাতা ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন হাজারো অভিবাসনপ্রত্যাশী। মিথ্যা আশ্বাস, অবাস্তব রঙিন স্বপ্নে জীবন হারাচ্ছেন বহু নাগরিক। এরকম আরও হাজারো জামাল এখনো মরক্কো, আলজেরিয়া কিংবা লিবিয়ার বিভিন্ন শহরে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।



এমএইউ/এআই


 

অন্যান্য প্রতিবেদন