ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মোঁপোলিয়েতে গত কয়েক বছরে প্রায় ৪০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক আশ্রয়প্রার্থীকে সাজা দেওয়া হয়েছে৷ কর্তৃপক্ষের দাবি, এসকল আশ্রয়প্রার্থী অপ্রাপ্তাবয়স্ক না হয়েও বয়স কম দেখিয়েছে৷
কিন্তু বিভিন্ন সংস্থা ও সমিতির সহায়তায় জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তারা তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ বয়স বিষয়ে তাদের দাবি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়৷
সে হিসেবে, দাবি অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও তাদেরকে সাজা ভোগ করতে হয়েছে৷ জানা গেছে, এ তরুণদের বেশিরভাগকে তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়া হয়।
নাবালকদের বিরুদ্ধে দেয়া এসব কারাদণ্ডকে ‘কলঙ্কজনক এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছে অভিবাসন সংস্থা লা সিমাদের৷
সুরক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে সুন্দর জীবন গড়ার স্বপ্নে এসব অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক তরুণেরা ফ্রান্সে এসেছিলেন।
২০১৬ সাল থেকে, মিথ্যা প্রশাসনিক নথি প্রদানের মাধ্যমে ‘জালিয়াতির অভিযোগে’ দক্ষিণ ফ্রান্সের মোঁপোলিয়ে শহরের হেরাল্ট ডিপার্টমেন্টাল কাউন্সিল বেশ কয়েকজন বিদেশি নাবালককে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।
আদালত তাদেরকে বয়স সম্পর্কে মিথ্যা বলা ও জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।
লা সিমাদের মতে, “২০১৬ সাল থেকে কমপক্ষে ৪০ তরুণ এ ধরনের সাজার ভুক্তভোগি হয়েছেন।”
ফ্রান্সে পৌঁছানোর পর এসব তরুণেরা নিয়ম অনুযায়ী নিজেদেরকে নাবালক হিসাবে উপস্থাপনের জন্য মোঁপোলিয়ে শহরের শিশু সহয়াতা দপ্তর (এএসই) তে হাজির হয়েছিলেন। নাবালক হিসেবে চূড়ান্ত স্বীকৃতির সিদ্ধান্তের জন্য তাদেরকে এএসই’র আওতায় বিশেষ নিরাপত্তায় রাখা হয়েছিল।
এই অপেক্ষমান সময়ে চলমান তদন্তের শেষে বলা হয়েছিল, নাবালকদের উপস্থাপিত পরিচয়পত্র ও নথিগুলো জাল ছিল।
“আমার সাথে অপরাধীর মতো আচরণ করা হয়েছিল”
লা সিমাদ মোঁপোলিয়ে শাখার সহ-সভাপতি থিয়েরি লার্চ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “আফ্রিকা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অনেকেরই ব্যক্তিগত পরিচয়পত্রগুলো ফ্রান্সের মতো একই মানের হয় না। যার ফলে ফরাসি সীমান্ত পুলিশ (পিএফএফ) প্রায়শই এসব নথিগুলো মিথ্যা সাব্যস্ত করে থাকে। পিএএফের এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে একটি হাড় পরীক্ষা করা হয় যেখানে প্রমাণিত হয় এসব তরুণেরা নাবালক নয়।”
“কিন্তু এই মেডিকেল পরীক্ষাগুলি বেশ বিতর্কিত হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছে কারণ কয়েক বছর ধরে এসব হাড় পরীক্ষা নির্ভরযোগ্য এবং সুনির্দিষ্ট ফলাফল দিচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রে হাড় পরীক্ষায় প্রদত্ত ফলাফল ক্রুটিপূর্ণ হিসেবে উঠে এসেছে”, যোগ করেন থিয়েরি লার্চ।
অনলাইন মিডিয়া স্ট্রিটপ্রেসে গত নভেম্বরে এই বিষয়ে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। সমীক্ষা অনুযায়ী অনেক তরুণকে মোঁপোলিয়ে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে বিশেষ বয়স পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
অনেক তরুণ ও তরুণীকে হাসপাতালের ডাক্তারদের সামনে নগ্ন হতে হয়েছিল। ডাক্তাররা অনেকের দাঁত পরীক্ষা করলেও কিছু তরুণীদের স্তন এবং ছেলেদের অন্ডকোষও পরীক্ষা করেন। ২০১৬ সাল থেকে চলা এই বেআইনি অনুশীলনটি অধিকারকর্মীদের আইনি হস্তক্ষেপে ২০২০ সালে বন্ধ হয়।
থিয়েরি লার্চ বলেন, “প্রশাসন তাদের তদন্ত এবং পরীক্ষার পরে তরুণদের প্রাপ্তবয়স্ক গণ্য করার সাথে সাথেই তাদেরকে অবিলম্বে আদালতে হাজির হয়। আদালতে অভিযুক্ত তরুণদের বেশিরভাগকে তিন থেকে চার মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়া হয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ ১২ মাস পর্যন্ত সাজা দিতে দেখেছি।”
২০১৬ সালে তিন মাসের কারাদন্ডপ্রাপ্ত একজন আইভরিকস্টের নাগরিক গত ডিসেম্বরে ফ্রান্স ব্লু হেরাল্টকে বলেন, “আমার সাথে একজন অপরাধীর মতো আচরণ করা হয়েছিল। আমি কারাগারে দাগী আসামীদের সাথে একই সেলে ছিলাম।"
কারাগার উত্তরণ এসব অভিবাসন লিবিয়ার কারাগার হয়ে আসা ভুক্তভোগীদের মানসিক বিষন্নতা আরও বাড়িয়ে তোলে। মোঁপোলিয়ে কারাগারে সাজা ভোগ করা তরুণ বন্দী কুয়াদিও স্ট্রিটপ্রেসকে জানান, ‘‘লিবিয়ায় আমি যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম এটিও এই অভিজ্ঞতার মতোই ছিউল। আমি সেখানে নড়াচড়া করতে পারছিলাম না এবং বারবার, আমি জ্ঞান হারাচ্ছিলাম।”
আইভরিকোস্টের আরেকজন তরুণ যুবক বলেন, ‘‘আমি কারাবাসের ঘটনা কখনই ভুলতে পারব না। কারাগারে প্রথম রাত আমি কাঁদতে কাদঁতে কাটিয়েছিলাম।”
‘ঔপনিবেশিক আইন’
অভিযুক্ত তরুণদের আটকের পাশাপাশি তাদের আর্থিক জরিমানা করা হয়েছিল।
অভিবাসন সংস্থা এবং এনজিও লা সিমাদের মতে, এসব সাজা কলঙ্কজনক এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ। যখন কারো নাবালকত্ব বা বয়স নিয়ে সন্দেহ করা সেক্ষত্রে মূলত সন্দেহকেই প্রাধান্য দেয়া হয়।
থিয়েরি লার্চ বলেন, “মোঁপোলিয়ের আদালত আইনকে সম্মান করে না এবং ঔপনিবেশিক আমলের বিচার অনুশীলন করে। আফ্রিকান তরুণদের শুধুমাত্র আফ্রিকান হওয়ার কারণে সাজা দেয়া হয়। এমনকি কেউ যদি মিথ্যা বলেও তাহলে কি এটি কারাদন্ডের যোগ্য? ফ্রান্সে স্কুলে যেতে চাওয়া কি অপরাধ?”
লা সিমাদ আরও জানায়, বিশেষ করে হেরাল্টের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া তরুণদের বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থা ও সমিতির সহায়তায় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের নাবালকত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদেরকে ফ্রান্সে বৈধভাবে থাকার অনুমতি দিয়ে স্কুলগুলিতে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।”
অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত হওয়া তরুণদের মধ্যে অনেকেই রায় বাতিল এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আদালতে পুনরায় মামলা দায়ের করেছেন। কারণ কারাবাসের কারণে প্রাপ্ত ফরাসি ভূখন্ড ছেড়ে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা (ওকিউটিএফ) আদেশের কারণে বসবাসের অনুমতি বা রেসিডেন্ট কার্ড পাওয়া জটিল হয়ে পড়ে। যদিও এই আদেশ থাকলে যে রেসিডেন্ট কার্ড পাওয়া একেবারে অসম্ভব সেটি নয় তবে এটি প্রতিবন্ধিকতা সৃষ্টি করে।
এমএইউ/আরআর