২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চালু হওয়া সামোস দ্বীপের অতি সুরক্ষিত শরণার্থী শিবির। ছবি: এমএসএফ
২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চালু হওয়া সামোস দ্বীপের অতি সুরক্ষিত শরণার্থী শিবির। ছবি: এমএসএফ

২০২২ সালে ফ্রান্সের নির্বাচনে ডানপন্থী এলআর দলের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ভালেরি পেক্রেস এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরা দারমানাসহ বেশ কয়েকজন ফরাসি রাজনীতিবিদ গ্রিসের অভিবাসন ব্যবস্থাপনাকে মডেল হিসেবে দেখছেন৷ যদিও গ্রিসের এসব শরণার্থী শিবিরকে এরইমধ্যে ‘উন্মুক্ত কারাগার’ বলে আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ ও এনজিওগুলো৷ অভিবাসন নীতির ক্ষেত্রে গ্রিসকে মডেল দেশ হিসেবে উল্লেখ করা এই বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস৷

চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এথেন্স এবং সামোস দ্বীপ সফরকালে ডানপন্থী লে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ভালেরি পেক্রেস বলেন, ‘‘সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গ্রিসের অবস্থান সম্পূর্ণ অনুকরণীয়৷’’

২০২২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়তে যাওয়া এই প্রার্থী গ্রিসে অভিবাসীদের জন্য বন্ধ শরণার্থী শিবিরের ‘মডেল’ এর প্রশংসা করেছেন। তার মতে, “এসব বন্দি বা শৃঙ্খলাবদ্ধ শরণার্থী শিবিরের মাধ্যমে সীমান্তে উপস্থিত সব আশ্রয়প্রার্থীকে মর্যাদাকর পরিবেশ দেয়া সম্ভব হচ্ছে৷”

২২ ফেব্রুয়ারি ফরাসি রেড়িও ফ্রন্সঁ ইন্টারে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আবারো গ্রিসের অভিবাসন নীতির পক্ষে তার সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷



এর কয়েক মাস আগে ফ্রান্সের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরা দারমানাও গ্রিসের সামোস দ্বীপ সফরে যান৷ ভালেরি পেক্রেসের মতো তিনিও গ্রিসের শরণার্থী শিবিরের ‘মডেল’ এর প্রশংসা করেন৷ 

সামোস সফরকালে তিনি আরও দাবি করেছিলেন, ইটালি, স্পেন ও মাল্টার মতো অন্যান্য ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতেও এই মডেল প্রয়োগ করা উচিত৷

এমানুয়েল ম্যাক্রঁর এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, “যদি সমস্ত দেশ বহিঃসীমান্ত নিয়ন্ত্রণে গ্রিসের মতো কাজ করে, তবে ইউরোপের অভিবাসন ব্যবস্থাপনার সমস্যা কবে আসবে।”



গ্রিসের বন্ধ বা অতি সুরক্ষিত শিবিরগুলোর অবস্থা 

২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এজিয়ান সাগরের দ্বীপ সামোসে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য গ্রিস প্রথম এ ধরনের শিবির উদ্ধোধন করে৷ গত বছরের নভেম্বরের শেষে দেশটির কোস এবং লেরোস দ্বীপেও একই কাঠামোর আরেকটি শিবির চালু করা হয়৷ সাম্প্রতিক সময়ে এথেন্স লেসবোস এবং চিওস দ্বীপেও দুইটি নতুন শিবির খোলার পরিকল্পনা করছে।

এসব শিবিরে অভিবাসীদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়ছে৷ চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া, নজরদারি ক্যামেরা এবং নতুন প্রযুক্তির সুরক্ষা ফটকও স্থাপন করা হয়েছে৷

এসব শিবিরে অভিবাসীদের প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়সীমা সকাল ৮ টা থেকে রাত 8 টার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ অভিবাসীদের জন্য এথেন্সের উত্তরে অবস্থিত রিটসোনায় এবং মেসিডোনিয়ান সীমান্তের কাছে কাভালায় খোলা শরণার্থী শিবিরেও একই কৌশল নিতে দেখা গেছে৷  

এথেন্সে কর্তৃপক্ষের মতে, “অভিবাসীদের সুরক্ষিত করতে শরণার্থী শিবিরগুলোতে এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে৷’’

অনিয়মিত পথে গ্রিসে আসা অভিবাসীদের থাকার ব্যবস্থাসহ তাদের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে ২০১৫ সালে থেকে ২৭ কোটি ৬০ লাখ ইউরো বিনিয়োগ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ এর মধ্যে সামোস দ্বীপের অবকাঠামোর জন্য বরাদ্দ করা হয় চার কোটি ৩০ লাখ ইউরো৷ 

কেন গ্রিসের অভিবাসন নীতি মডেল নয়? 

ভালেরি পেক্রেস এবং জেরা দারমানার কাছে প্রশংশিত এই অতি-সুরক্ষিত আশ্রয় কেন্দ্রগুলিকে ‘উন্মুক্ত কারাগার’ হিসাবে উল্লেখ করে গ্রিসের কঠোর সমালোচনা করে আসছে অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলো।  

নতুন শরণার্থী শিবিরগুলো খোলার পরপর এমন ৪৫টি সংস্থা ও সংগঠন ইইউ ও গ্রিক সরকারের কাছে সেগুলো দ্রুত বন্ধের আহ্বান জানায়৷

তাদের মতে, শিবিরগুলো অরক্ষিত ব্যক্তিদের শনাক্ত ও সুরক্ষায় বাধা দিবে৷ আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য পরিষেবা এবং সহায়তা সুবিধা সীমিত করবে৷ 

২০২১ সালের অক্টোবরে, একটি শক্তিশালী ঝড়ে সামোসের একটি ‘মডেল ক্যাম্প’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ অনেক কক্ষে পানি ঢুকে পড়ে৷ 

সামোস অ্যাডভোকেসি কালেক্টিভের একটি সূত্র জানায়, কেন্দ্রটি একটি উপত্যকার নীচে তৈরি করা হয়েছে যার কারণে পানি উঁচু এলাকা থেকে সেখানে প্রবাহিত হয়৷ ভারী বৃষ্টিপাতের জন্যও দ্বীপটি পরিচিত৷

গ্রিসের অন্যান্য শিবিরগুলির অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়৷ সেখানে অবস্থানরত অভিবাসীরা বছরের পর বছর সিদ্ধান্তহীন পরিস্থিতিতে দিন পার করছেন৷




শিবিরে বদ্ধ পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাটানোর কারণে অভিবাসীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে৷

নেয়া কাভালা শিবিরে অবস্থানরত কঙ্গো থেকে আসা একজন আশ্রয়প্রার্থী ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছিলেন, “আমি জানি না কেন৷ মনে হচ্ছে গ্রিক কর্তৃপক্ষ চায় না আমরা অভিবাসীরা একসাথে থাকি৷ আমরা শিবির থেকে বের হয়ে যেদিকেই তাকাই এই প্রাচীর দেখতে পাই৷’’

রিটসোনা শিবিরে অবস্থানরত এক আফগান শরণার্থী বলেন, “এই শীতে অভিবাসী শিশু ও কিশোরদের জন্য বিদ্যালয় তৈরি করুন, দেয়াল নয়৷’’

গত সপ্তাহে ফরাসি, জার্মান ও ব্রিটিশ মিডিয়ার তদন্তে উঠে এসেছে, গ্রিক উপকূলরক্ষীরা গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিন অভিবাসীকে জীবনরক্ষাকারী কোন জ্যাকেট ও নৌকা ছাড়াই মারধর করে সমুদ্রে ফেলে দেয়৷ তাদের মধ্যে দুইজন অভিবাসী সমুদ্রে ডুবে মারা যাযন৷ গ্রিস উপকূলে একই পরিণতি ভোগ করে জানুয়ারির শেষ দিক থেকে নিখোঁজ রয়েছেন আরও একজন অভিবাসী৷

আশ্রয় শিবির এবং সীমান্তে গ্রিস কর্তৃপক্ষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন সংস্থা৷ 


এমএইউ/এফএস
















 

অন্যান্য প্রতিবেদন