অফি'র সহায়তায় নিজ দেশে ফেরত যেতে প্যারিসের শার্ল-দ্যো-গল বিমানবন্দরে অপেক্ষমান এক অভিবাসী। ছবি: রয়টার্স
অফি'র সহায়তায় নিজ দেশে ফেরত যেতে প্যারিসের শার্ল-দ্যো-গল বিমানবন্দরে অপেক্ষমান এক অভিবাসী। ছবি: রয়টার্স

ফ্রান্সে অনুষ্ঠিতব্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ২০২২-এ ডানপন্থী এবং অতি-ডানপন্থী রাষ্ট্রপতি প্রার্থীরা তাদের প্রচারণার ফ্রান্সে বসবাসকারী অনথিভুক্ত ব্যক্তিদের বহিষ্কারের কথা বলছেন। অনিয়মিত অভিবাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এই যুক্তিটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা বিশ্লেষণ করেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস।

আসন্ন ফরাসি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনী প্রচারণার অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় অভিবাসন। অনিয়মিত অভিবাসন ও কথিত অভিবাসন সংকট সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর মধ্যে এবার আলোচনায় উঠে এসেছে অনিয়মিত বা বৈধ কাগজহীন অভিবাসীদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া। 

ডানপন্থি ও কট্টর ডানপন্থি প্রার্থীরা নানাভাবে যুক্তি দিয়ে অনথিভুক্তদের ফেরত পাঠানোর কথা বলছেন। তবে এই বিষয়য়টি ইতিমধ্যে ফরাসি সংসদ সদস্যরা কয়েকবার বিশ্লেষণ করেছেন৷ ফরাসি আইন প্রণেতাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং পরিপূর্ণ নয়।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের লড়তে যাওয়া কট্টর অভিবাসনবিরোধী প্রার্থী এরিক জেমুর গত বছরের এপ্রিলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, “আমি অবৈধ অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেব। এখানে লুকিয়ে থাকা সব অনিয়মিত বিদেশি ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে বহিষ্কার করা হবে।”

ন্যাশনাল র‍্যালি দল থেকে নির্বাচনে লড়া রাষ্ট্রপতি প্রার্থী মারিন লো পেনও অনিয়মিত পরিস্থিতিতে ফ্রান্সে বসবাসকারী বিদেশীদেরকে পদ্ধতিগতভাবে বহিষ্কার কর‍তে চান। যারা অবৈধভাবে ফ্রান্সে এসেছেন তাদের নিয়মিতকরণ বা বৈধতা প্রদানের যে কোনো সম্ভাবনার বিরুদ্ধে তার অবস্থান।

ডানপন্থি রাজনৈতিক দল লে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ভালেরি পেক্রেস বলেন, “অবৈধ অভিবাসীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত। যাতে করে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসগুলো তাদের নাগরিকদের চিহ্নিত করে দ্রুত পাসপোর্ট দিতে বাধ্য হয়।”

নথিপত্রবিহীন ব্যক্তিদের তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে একটি মেয়াদযুক্ত বৈধ পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় বিভিন্ন দেশের কনস্যুলার ও দূতাবাসগুলো কোন পাসপোর্ট বা ভ্রমণপাস ইস্যু করতে অপারগতা জানায়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য ভালেরি পেক্রেস উপরোক্ত প্রস্তাবনা দিয়েছেন।

বহিষ্কার প্রয়োগের প্রথামিক সমস্যা

অনথিভুক্ত অভিবাসীদের পদ্ধতিগতভাবে বহিষ্কারের নীতি বাস্তবায়নে আইনি, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক বাধা রয়েছে।

প্রথমত, একজন অনথিভুক্ত ব্যক্তিকে বহিষ্কারের জন্য তাদের গ্রেফতার, ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখা এবং তারপর বিমানযোগে তাদের পরিবহণ করে পাঠানো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। 

ফ্রান্সে বসবাসকারী অনথিভুক্ত অভিবাসীদের মোট সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে বলা প্রায় অসম্ভব। এ নিয়ে কোন সরকারি সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ধারণা করা হয় ফ্রান্সে চার লাখ থেকে ছয় লাখ কাগজহীন অভিবাসী বাস করেন। 

ফ্রান্সে বসবাসকারী সমস্ত অনথিভুক্ত লোকদের ধরে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ তাই অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া। 

উল্লেখ্য, অনিয়মিতদের মধ্যে বড় একটি সংখ্যক লোকেদের ডিটেনশন সেন্টারে না রাখার আইনি বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে। যেমন, অসুস্থ ব্যক্তি, নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধিদের।  

শিশুদের ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখার জন্য ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস (ইসিএইচআর) এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার সরকারের নিন্দা জানিয়েছে৷

আইনি মারপ্যাঁচ

কখনো কখনো অনিয়মিত উপায়ে থাকা ব্যক্তিদের তাদের নিজ দেশের পরিস্থিতির কারণ তাদেরকে বহিষ্কার করা সম্ভব হয় না। 

ইউরোপীয় আইনে অভিবাসীদের এমন কোন দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না যেখানে তাদের জীবন বা নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

এ ব্যাপারে ইউরোপীয় আইন বিশেষজ্ঞ তানিয়া রাচো ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘নিজ দেশে সমস্যা থাকা দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান অন্যতম।”

এছাড়া কিছু দেশের সাথে ফ্রান্সের সাথে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ দেশগুলো তাদের অনথিভুক্ত নাগরিকদের কনস্যুলার পাস ইস্যু করতে অস্বীকার করতে পারে। আলজেরিয়া এমন একটি দেশ।  

চলতি বছরের জানুয়ারিতে আলজেরীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠিতে দেখা যায়, দেশটি ফ্রান্সে তাদের সব কনস্যুলারকে নির্দেশ দিয়েছে ‘‘যাতে আর কোন শুনানি নিশ্চিত করা না হয় এবং কোন ভ্রমণ পাস ইস্যু করা না হয়।” 

ফরাসি অনুসন্ধানী সংবাদ মাধ্যম মিডিয়াপার্টে এবং স্ট্রিট প্রেসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। এসব দেশের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে ভালেরি পেক্রেস ভিসা প্রদান বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। 

ব্যয়বহুল এবং অকার্যকর বহিষ্কার

এছাড়া একজন ব্যক্তিকে কার্যকরভাবে বহিষ্কার করতে ফরাসি কর্তৃপক্ষের ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়।  

২০১৯ সালে ফরাসি জাতীয় অর্থ কমিটি এই জোরপূর্বক প্রস্থানের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। সেখানে দেখা যায়, লোকেদের গ্রেপ্তার, আটকে রাখা এবং প্রশাসনিক ও আইনি বিরোধের ব্যবস্থাগুলি প্রয়োগের জন্য একজন ব্যক্তির পেছনে ১৪ হাজার ইউরো পর্যন্ত খরচ হয়। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বহিষ্কার নীতির জন্য ফ্রান্সের খরচ হয়েছে ৪৬৮.৭৮ মিলিয়ন ইউরো। 

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য জোরপূর্বক বহিষ্কারের তুলনায় স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়ারকে অগ্রাধিকারযোগ্য বলে মনে করেন। 


এমএইউ/আরআর


 

অন্যান্য প্রতিবেদন