অভিবাসীদের আটক বন্ধ ও অধিকারের দাবিতে শনিবার এথেন্সে বিক্ষোভ করেছেন বাংলাদেশিরা৷ ছবি: মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম
অভিবাসীদের আটক বন্ধ ও অধিকারের দাবিতে শনিবার এথেন্সে বিক্ষোভ করেছেন বাংলাদেশিরা৷ ছবি: মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম

গ্রিসে অনিয়মিত বাংলাদেশিদের গণহারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সেখানে বসবাসরত প্রবাসীরা৷ গ্রিক কর্তৃপক্ষ জোর করে তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠাতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা৷

সাম্প্রতিক সময়ে এথেন্সে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে গ্রিক পুলিশ৷ এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশিরা৷ সেখানে বাংলাদেশি অভিবাসীদের গণহারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের৷ এমন অবস্থায় অনেকে ভয়ে ঘরে বন্দি জীবনযাপন করছেন৷ অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ অভিবাসীদের থাকার জায়গাগুলোতেও হানা দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন৷ তবে বাংলাদেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অনিয়মিত অভিবাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযোন পরিচালনার কোনো তথ্য তারা পাননি৷ 

‘ফেরত গেলে মৃত্যু ছাড়া উপায় থাকবে না’

গ্রেপ্তারের ভয়ে এথেন্সে আরো কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি রয়েছেন সম্রাট৷ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তিনি বলেন, ‘‘আমার আদালতের অনুমতিপত্র আছে৷ মেয়াদ চার মাস থাকলেও আমি ভয়ে বের হচ্ছি না৷ শুনেছি তারা সবাইকে ধরছে৷ আমার কাগজ এমনিতেই দুর্বল৷ তাই ছয়-সাত দিন ঘরবন্দি হয়ে আছি৷ কাজেও যেতে পারছি না৷ আমাদের মতো যারা আছে, তারা সবাই গৃহবন্দি৷ পুলিশ এমনকি মেসে, রুমেও রেইড দিচ্ছে৷’’

২০১৯ এর শেষ দিকে ইরাক থেকে তুরস্ক হয়ে অনিয়মিত পথে গ্রিসে আসেন তিনি৷ প্রথমদিকে এথেন্সের বাইরে একটি জেলায় কৃষি খামারে কাজ করতেন৷ সেখানে বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন পেতেন বলে জানান৷ এর মধ্যে আশ্রয় আবেদনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পরে আদালত থেকে এক বছরের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করেন৷ এথেন্সে এসে কাজ নেন রেস্তরাঁয়৷ সেখানকার বেতন থেকে মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা দেশে পাঠাতেন৷ কিন্তু ধরপাকড়ের খবরে সামনের সময় অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে তার জন্যে৷ সম্রাট বলেন, ‘‘দেশে ১৪-১৫ লাখ টাকা ঋণ হয়ে গেছে৷ এখন ঋণ শোধ না করে বাড়ি যেতে হলে কী জবাব দিব৷ আমার মৃত্যু ছাড়া উপায় থাকবে না৷ বাড়িতে জমিজমাও নেই যে বিক্রি করে ঋণ শোধ করব৷ যতদিন অভিযান বন্ধ না হয় ততদিন এভাবেই থাকতে হবে৷’’

শুধু সম্রাট নন এথেন্সে অনিবন্ধিত বাংলাদেশিদের অনেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন৷ বাংলাদেশি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘এই মাসের ১৩ তারিখ থেকে অভিযান শুরু হয়েছে৷ আমরা শুনেছি পুলিশ অভিবাসীদের গণহারে গ্রেপ্তার করে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিচ্ছে৷ কারো রেসিডেন্স পারমিট (বসবাসের অনুমতি) থাকলে তা পরীক্ষা করে পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে৷ বাকিদের রেখে দেয়া হচ্ছে৷’’ ‘এথেন্স বিডি টোয়েন্টি ফোর ডটকম’ নামের একটি সংবাদ পোর্টালের এই সাংবাদিক দাবি করেন, ‘‘এথেন্স থেকে তিন শতাধিক অভিবাসীকে এখন পর্যন্ত আটক করা হয়েছে৷ গতকাল (সোমবার) বিকালে একটি মেস থেকেও প্রায় ৩০ জন বাংলাদেশিকে আটক করার খবর শুনেছি আমরা৷’’

বাংলাদেশি অভিবাসীদের গণহারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ প্রবাসীদের৷ ছবি: মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম
বাংলাদেশি অভিবাসীদের গণহারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ প্রবাসীদের৷ ছবি: মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম

বাংলাদেশিদের উদ্বেগ যে কারণে

গত ডিসেম্বরে একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ১৯ বাংলাদেশিকে ঢাকায় ফেরত পাঠায় এথেন্স৷ সেসময় গ্রিসের অভিবাসী ও শরণার্থী বিষয়ক মন্ত্রী নোতিস মিতারাচি জানান, বাংলাদেশের সরকারের সহযোগিতায় পাঁচ বছর পর অনিয়মিত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে দেশটি৷ গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক সুরক্ষার আওতায় যারা নেই তাদেরকে ফেরত পাঠাচ্ছে গ্রিস৷’’ অনিয়মিত অভিবাসী ফেরত নিতে ঢাকা সহযোগিতা করায় বৈধপথে বাংলাদেশ থেকে গ্রিসে মৌসুমি কর্মী আনার সুযোগ তৈরি হবে বলেও জানান তিনি৷ 

পরবর্তীতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নোতিস মিতারাচির ঢাকা সফরে দুই দেশের সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়৷ গ্রিসের অভিবাসী ও শরণার্থী মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এর মধ্য দিয়ে বছরে চার হাজার বাংলাদেশিকে মৌসুমি কাজের ভিসা দেবে গ্রিস৷

বর্তমানে দেশটিতে বসবাস করছেন এমন ১৫ হাজার বাংলাদেশিকেও দেয়া হবে সাময়িক কাজের অনুমতি৷ পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘‘অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে লড়াই ও অবৈধভাবে যারা বসবাস করছে তাদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে৷’’

এই চুক্তির কারণে বাংলাদেশিরা উদ্বেগে রয়েছেন বলে জানান মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম৷ গ্রিসের প্রবাসীদের ধারণা ফেরত পাঠানোর জন্যই এখন এমন ধরপাকড় শুরু করেছে দেশটির আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী৷ এ নিয়ে তারা গত শনিবার এথেন্সে একটি বিক্ষোভেরও আয়োজন করেন৷ বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ গ্রিসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘গ্রিস সরকারের নিশ্চয়ই একটা টার্গেট আছে, সেটা কী আমরা বুঝতে পারছি না৷’’

পড়ুন: গ্রিসে বাংলাদেশিদের বৈধ অভিবাসনের সুযোগ

কেন অভিযান চালাচ্ছে গ্রিস

‘সংগঠিত অপরাধের’ বিরুদ্ধে এথেন্সে পুলিশ বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে বলে খবর প্রকাশ করেছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো৷ সংবাদমাধ্যম দ্য টিওসি গত রোববার প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলমান অভিযানে ৬০০ পুলিশ সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন৷ 

অভিযানে প্রয়োজনীয় নথিবিহীন ৩৬১ জন অভিবাসী, বিদেশিকে ‘আটক কেন্দ্রে’ পাঠানো হয়েছে৷ ১৪ জনকে মাদক, নয় জনকে মানবপাচার, দুই জনকে ভুয়া কাগজের জন্য গ্রেপ্তারের করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷ 

যোগাযোগ করা হলে এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশি অভিবাসীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে তারা কোনো তথ্য পাননি৷ একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা যতটুকু খবর পেয়েছি গ্রিক সরকারের পুলিশ এখানে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালাচ্ছে৷ এ ধরনের কার্যক্রমে বাংলাদেশিদের সংশ্লেষ নাই, কাজেই তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই৷ তবে যেহেতু বাংলাদেশি অনেক অনিয়মিত অভিবাসী গ্রিসে থাকেন, তাদের কেউ হয়ত এই ধরপাকড়ের মধ্যে পড়েও যেতে পারেন৷’’

দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, গ্রিসে মোট ৩০-৩৫ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন৷ এরমধ্যে বৈধভাবে অনুমতি নিয়ে বসবাস করছেন এমন সংখ্যা সাড়ে বারো হাজার৷ দূতাবাসের এই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘প্রায় ২৩ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশির মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রিস ফেরত পাঠিয়েছে৷ এটা প্রতীকী৷ ওরাও চায় না বাংলাদেশের অবৈধদের ফেরত পাঠাতে৷ কারণ এখানে অনানুষ্ঠানিক খাতে বিদেশি শ্রমিকের একটা চাহিদা রয়েছে৷ ওদের বছরে ১৫ হাজার শ্রমিক লাগে৷ তার মধ্যে চার হাজার বাংলাদেশ থেকে নেবে এমন চুক্তি হয়েছে৷ এপ্রিলে সংসদে অনুমোদিত হলে এর প্রক্রিয়া শুরু হবে৷ বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকেও অনুরোধ করা হয়েছে, যেসব বাংলাদেশি অবৈধ হয়েছে তাদেরকে পর্যায়ক্রমে নিয়মিত করার জন্য৷ ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে গ্রিসের মন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন৷ এই বিষয়ে দূতাবাস নিবিড়ভাবে গ্রিস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে৷ কিন্তু সংখ্যাটা এখানে এত বেশি যে তার ব্যবস্থাপনাটা অনেক জটিল৷’’

পড়ুন: এক বছরে শতাধিক বাংলাদেশিকে জোর করে ফেরত পাঠালো জার্মানি

 

অন্যান্য প্রতিবেদন