রাশিয়ার হামলার পর কয়েক হাজার শরণার্থী গ্রিসে এসেছেন৷ তারা আন্তর্জাতিক সুরক্ষা আইনের সুবিধা পেলেও ইউক্রেনের বাইরের নাগরিকদের জন্য পরিস্থিতি হতাশাজনক৷
বিমান হামলা ও সংঘাতের মুখে নিজের বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন ইউক্রেনের খারকিভের বাসিন্দা সোফিয়া মালিনোভস্কায়া৷ এক বন্ধুসহ গাড়িতে ১৭০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছেন স্লোভাকিয়া সীমান্তে৷ সেখান থেকে স্বেচ্ছাসেবীদের সহায়তায় পোল্যান্ডের ক্রাকোফ, ওয়ারশ হয়ে আসেন গ্রিক শহর থেসালনিকিতে৷ আপাতত সেখানে নিরাপদ বোধ করলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ মালিনোভস্কায়া৷ ‘‘আমার শহর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, সেখানে আর ফিরে যাওয়ার জায়গা নেই৷ একটা ভবনও অবশিষ্ট নেই৷ এই অবস্থায় এরপরে কী হবে, কেমন করে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে তা আমার জানা নেই,’’ বলেন তিনি৷
তবে মালিনাভাস্কায় অন্তত জানতেন যে গ্রিসে তার ঠাঁই হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু রয়েছে৷ আমি তার সঙ্গে থাকতে পারব৷’’ গ্রিসের বিরুদ্ধে অভিবাসী, শরণার্থীদের ‘পুশব্যাক’ এবং হেনস্থার যে অভিযোগ রয়েছেমালিনোভস্কায়া তা শোনেননি আগে৷ দেশটিতে এমন পরিস্থিতির মধ্যে অবশ্য তাকে পড়তেও হয়নি৷
ইউক্রেনীয়দের জন্য বিশেষ সুবিধা
থেসালনিকিতে ইউক্রেনের কনস্যুল জেনারেল ভাদিম সাবলুক জানিয়েছেন, গত বুধবার ১০ হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় সীমান্ত পেরিয়েছেন৷ যুদ্ধপীড়িত দেশ থেকে পালিয়ে আসা ইউক্রেনীয়দের প্রবেশ করতে দেয়ায় গ্রিসের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি৷ বায়োমেট্রিক পাসপোর্টধারী যে কোনো ইউক্রেনীয় দেশটিতে আসতে পারছেন৷ এছাড়াও জন্ম নিবন্ধনসহ অন্য কাগজ নিয়ে যারা আসছে তাদের জন্য গ্রিক-বুলগেরিয়া সীমান্তে একটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে৷ সেখানে পুলিশের মাধ্যমে আবেদনপত্র পূরণ করে তারা নিকটস্থ অভিবাসী কার্যালয়ে তা জমা দিতে পারবেন৷
এছাড়াও ২৮ মার্চ থেকে ইউক্রেনীয়দের জন্য অনলাইন আবেদনেরও ব্যবস্থা চালু হচ্ছে বলে জানান সাবলুক৷ এর মাধ্যমে আবেদনকারীরা সাময়িক আশ্রয়ের অনুমতি পাবেন যা তিন বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেক মানুষ কনস্যুলেটে আসছেন এবং তাদের অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ি এবং কক্ষ ইউক্রেনীয়দের জন্য ছেড়ে দিতে চাইছেন৷’’

পড়ুন: ফেরত পাঠানোর শঙ্কায় গ্রিসের অনিয়মিত বাংলাদেশিরা
ভালো শরণার্থী, খারাপ শরণার্থী
থেসালনিকি সিটি হলের ভিতরে ইউক্রেনে পাঠানোর জন্য খাদ্য, জামাকাপড় ও ঔষধ প্যাকেটজাত করতে ব্যস্ত গ্রিকরা৷ অন্যদিকে এথেন্সের রাস্তায় ‘স্কুপা অভিযান’ পরিচালনা করছে চার শতাধিক গ্রিক পুলিশ৷ এই অভিযানে যথাযথ অনুমতিপত্র না অভিবাসী, শরণার্থীদের আটক করছে পুলিশ৷ ‘‘আমি বাইরে যেতেও ভয় পাচ্ছি,’’ বলেন একজন আফগান৷ তার আশ্রয় আবেদন দুইবার বাতিল হয়েছে বলে জানান তিনি৷
এই আফগান নতুন করে আবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন না৷ স্কাইপি মেসেঞ্জার সার্ভিস ব্যবহার করে নিবন্ধনের যে প্রক্রিয়া রয়েছে তা ঘণ্টার পর ঘণ্টার চেষ্টা করেও পারেননি তিনি৷ এখন অন্য একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্রে আবেদনের জন্য দেশটির ভিন্ন প্রান্তের শহর এভ্রোসে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন৷ তবে গ্রিক কর্তৃপক্ষের উপর তিনি কোনো আস্থা রাখতে পারছেন না বলে জানান৷ তুরস্ক থেকে গ্রিসে প্রবেশ করতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতন ও অবৈধ ‘পুশব্যাক’-এর ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন বলেও জানান৷
গ্রিসে ইউক্রেনের শরণার্থীদের সঙ্গে ইতিবাচক আচরণ ও নিজের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা তুলনা করে ক্ষুব্ধ এই আফগান৷ ‘‘তারা নতুন এসেছে, তাদেরও অন্য শরণার্থীদের মতো একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত,’’ বলেন তিনি৷
আইনের বরখেলাপ
শরণার্থীদের সঙ্গে গ্রিস সরকারের আচরণ নিয়ে আগে থেকে সমালোচনা করে আসছেন মানবাধিকারকর্মীরা৷ অন্যদিকে গ্রিক সরকার তুরস্ককে নিরাপদ তৃতীয় দেশ হিসেবে ঘোষণা করে বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার এসব শরণার্থী, অভিবাসীদের নেই৷ সম্প্রতি পার্লামেন্টে দেয়া ভাষণে গ্রিক অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক মন্ত্রী নোতিস মিতারাচি ইউক্রেনীয়দের ‘প্রকৃত শরণার্থী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন৷ অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক নেতারা মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে আগতদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন৷
ইউরোপের অভিবাসী নীতি বিশেষজ্ঞ নেডা নোরাই-কিয়া শরণার্থীদের প্রতি গ্রিক সরকারের অসম আচরণের সমালোচনা করে বলেন দেশটির বিরুদ্ধে এমনিতে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে৷ অবৈধভাবে ফেরত পাঠানো, মৌলিক বিধানের অভাব, অভিবাসীদের আত্তিকরণের ঘাটতিসহ তালিকাটি দীর্ঘ বলে মন্তব্য করেন তিনি৷ দেশটির আইনের বরখেলাপ নিয়ে ইইউর প্রতিক্রিয়া জানানো গুরুত্বপূর্ণ বলেও তিনি উল্লেখ করেন৷
জার্মান হাইনরিশ ব্যোল ফাউন্ডেশনের এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ইউক্রেন থেকে আগতরা যে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ছাড়াই গ্রিসে সুরক্ষা পাচ্ছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ৷‘‘এটা প্রমাণ করছে যে সহমর্মিতা সম্ভব৷’’ একই ধরনের সহমর্মিতা অন্য দেশের আশ্রয়প্রার্থীদেরও দিতে হবে বলে মত দেন তিনি৷
তবে বাস্তবতা হলো আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের আশ্রয়প্রার্থীদের শুনানিতে অংশ নিতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে, লাল ফিতার দৌরাত্মে কেটে যাচ্ছে তাদের বছরের পর বছর৷
এফএস/আরকেসি