সুইজারল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ বলছে, ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থীদের প্রায় অর্ধেকই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার থেকে সাহায্য পাচ্ছেন৷ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দেয়া খাবারের উপর মূলত নির্ভর করতে হচ্ছে শরণার্থীদের৷
ফেব্রুয়ারির শেষে রুশ আক্রমণ শুরুর পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার ইউক্রেনীয় শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন সুইজারল্যান্ডে৷ জুরিখ সেন্ট্রালে ফুডব্যাংকের সামনে গত সপ্তাহান্তে সারি সারি শরণার্থীকে খাবারের লাইনে দেখা গেছে৷
সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে ইউক্রেনীয় শরণার্থী ক্রিস্টিনা দাঁড়িয়েছিলেন সেই লাইনে৷ রুশ হামলার পর ৪২ বছর বয়সি এই নারী তার মেয়েকে নিয়ে কিয়েভ থেকে পালিয়ে আসেন সুইজারল্যান্ডে৷ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে তিনি জানান, সুইজারল্যান্ডের একটি পরিবার তাকে আশ্রয় দিয়েছে৷ কিন্তু সেই পরিবারের কাছে এত টাকা নেই যে তারা ক্রিস্টি ও তার মেয়েকে চারবেলা খাওয়াতে পারেন৷ ক্রিস্টিনার কথায়, ‘‘আমরা এখানে খাবার নিতে এসেছি, কারণ খাবার ছাড়া তো চলবে না৷’’
সুইজারল্যান্ডে সরকারি আবাসনে থাকা ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন৷ তবে ক্রিস্টিনার মতো যারা সরকারি আবাসনে জায়গা পাননি এবং অন্যদের আশ্রয়ে রয়েছেন, তারাও কেউ কেউ এই আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন৷ কিছু জেলায় বা ক্যান্টনগুলিতে, শরণার্থীরা তাদের সহায়তাকারী পরিবারের খরচের জন্য সামান্য অর্থ পান৷ বিশ্বে জীবন যাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি যেসব দেশের তার মধ্যে অন্যতম সুইজারল্যান্ড৷ দেশটিতে এসে তাই থাকা-খাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছেন শরণার্থীরা৷
সুইস স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি বলছে, বিপুল সংখ্যক মানুষ খাদ্য, পোশাক এবং চিকিত্সার জন্য তাদের উপর নির্ভরশীল৷ অনেক শরণার্থী এমন পরিবারের কাছে আশ্রয় পেয়েছেন, সেখানে থাকার ব্যবস্থা হলেও খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ খ্রিস্টান সহায়ক সংস্থা ‘ইনকন্ট্রো’-র তরফে আরিয়েন স্টকলিন রয়টার্সকে জানান, ‘‘অনেক আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে খাবার অপর্যাপ্ত৷ খাবারের প্রচুর চাহিদা রয়েছে৷’’

আশ্রয়দাতা পরিবারগুলি কী ভাবছে?
জুরিখের সামাজিক সহায়তা বিভাগের মুখপাত্র হেইকে ইসেলহোর্স্ট সংবাদসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, যে সব শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীরা সরকারি সহায়তায় রয়েছেন, তারা মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছেন৷ কিন্তু যে সব ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা নির্দিষ্ট কোনো পরিবারের আশ্রয়ে রয়েছেন, তাদের পাশে থাকার সেই অর্থে কোনো নিয়ম নেই৷
গত সপ্তাহে ক্যান্টনের সামাজিক সহায়তা বিভাগের তরফে গ্যাবি সোজোলোসি একটি সাংবাদিক বৈঠকে ইউক্রেনীয় শরণার্থী পরিবারের কাছে ক্ষমা চান৷ তিনি বলেন, ‘‘ওরা সবাই ছিন্নমূল৷ আশ্রয়দাতা পরিবারের বিষয়ে না জানলে বিষয়টা আরো কঠিন৷ কারণ সেক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা নেই৷’’
ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা অন্য আশ্রয়প্রার্থীর তুলনায় বঞ্চিত?
ইউরোপের অন্য দেশের মতোই, ইউক্রেন থেকে আগত শরণার্থীদের অস্থায়ী বসবাস ও কাজের আবেদনের অনুমতি দিয়েছে সুইস কর্তৃপক্ষ৷ ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা আফগানিস্তান বা ইরিত্রিয়ার আশ্রয়প্রার্থীদের মতো দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে না গিয়ে একটি বিশেষ সুরক্ষা মর্যাদা (এস স্ট্যাটাস) পেয়েছেন৷
সংবাদমাধ্যম সনটাগসাইটুং সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ‘এস-স্ট্যাটাস’-এর সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সুইজারল্যান্ডের বেশ কিছু অংশে ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা আর্থিকভাবে অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীদের তুলনায় বঞ্চিত৷
অতি-ডানপন্থী এসভিপি দলের সংসদ সদস্য আন্দ্রেয়াস গ্লারনার সুইজারল্যান্ডে অভিবাসীবিরোধী হিসেবে পরিচিত৷ তিনিও বলেছেন, ইউক্রেনের প্রতি আরো সমর্থন বাড়ানো উচিত৷ তার কথায়, ‘‘ইউক্রেনীয়রা প্রকৃত শরণার্থী এবং সুইজারল্যান্ডকে নিশ্চিত করতে হবে যে তারা এই শরণার্থীদের পাশে রয়েছে৷’’

দৈনিক আট ফ্রাঙ্কের কম
ইউক্রেন সংকটের আগে, সুইজারল্যান্ডের অনেক এলাকায় আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সাহায্যের অঙ্কটা মোটেও যথেষ্ট ছিল না৷ ২০১৭ সাল থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে জুরিখ প্রশাসন৷ মাসিক আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ৪৫ হাজার টাকা (৫০০ সুইস ফ্রাঙ্ক) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ৷ এটি প্রয়োজনীয় বরাদ্দের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম৷
সানডে নিউজপেপারের হিসাব অনুযায়ী, আরগাউ ক্যান্টনে ইউক্রেন থেকে আসা তিনজন শরণার্থীর একটি পরিবার রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের আওতায় থেকেও ‘নিয়মিত’ আশ্রয়প্রার্থীদের চেয়ে আরো বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছে৷ দৈনিক জনপ্রতি ৭১৪ টাকারও (আট ফ্রাঙ্ক) কম অর্থ বরাদ্দ ওই পরিবারের জন্য৷ অর্থাৎ প্রতি বেলার প্রধান খাবারের জন্য বরাদ্দ মাত্র ২৩৭ টাকা (২.৬৫ ফ্রাঙ্ক) , যেখানে আরগাউয়ের রাজধানী আরাউতে ম্যাকডোনাল্ডসের একটি বিগ ম্যাক বার্গারের দাম ৬৪৩ টাকা বা ৭.২০ ফ্রাঙ্ক৷
জুরিখের শহরতলি এলাকা উইন্টারথুরে আশ্রয় পেয়েছেন ৩৮ বছর বয়সি ইউক্রেনীয় শরণার্থী আনা৷ বন্ধুর বাবা-মায়ের অ্যাপার্টমেন্টে থাকছেন তিনি, তার দুই সন্তান এবং মা৷ তিনি জানান, ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে তারা যখন প্রথম সুইজারল্যান্ডে এসেছিলেন তখন পরিস্থিতি অনেকটা ভাল ছিল৷ তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘‘পৌঁছানোর পর আমরা শরণার্থী শিবিরে থাকতাম, সেখানেই ঘুমাতাম৷ কিন্তু ছোট শিশুদের জন্য সেটা মোটেও স্বাস্থ্যকর ছিল না৷ ভাল খাবার ছিল না, সেই শিবিরে গোপনীয়তা বলেও কিছু ছিল না৷’’
আরকেসি/এফএস