গ্রিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় উদ্ধার হওয়া একটি অভিবাসী দল। ছবি: এজিয়ান বোট রিপোর্ট
গ্রিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় উদ্ধার হওয়া একটি অভিবাসী দল। ছবি: এজিয়ান বোট রিপোর্ট

ইউরোপে গ্রীষ্ম শুরুর আগেই বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে তুরস্ক উপকূল থেকে এজিয়ান সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা বাড়ছে। এথেন্স জানিয়েছে, গ্রিক কোস্ট গার্ড বছরের শুরু থেকে ৪০ হাজার অনিয়মিত অভিবাসীকে গ্রিসে প্রবেশে বাধা দিয়েছে। গ্রিস সরাসরি নাম উল্লেখ না করেই ব্যাপক অভিবাসী স্রোতের জন্য তুরস্ককে অভিযুক্ত করেছে।

গ্রিস থেকে ফ্রান্স২৪ এর বিশেষ সংবাদদাতা অ্যালেক্সিয়া কেফালাস-এর প্রতিবেদন। 

গ্রিসে রৌদ্রোজ্জ্বল গ্রীষ্মের দিন ফিরে আসার পর থেকেই বেড়েছে দ্বীপপুঞ্জগুলোতে অভিবাসীদের দুঃস্বপ্নের যাত্রা। প্রতিদিন ভোর থেকেই তুরস্ক থেকে গ্রিসকে আলাদা করা সংকীর্ণ সামুদ্রিক সীমান্তগুলোতে ভীড় করে অভিবাসী বোঝাই ডিঙ্গি, পালতোলা কিংবা অন্যান্য অস্থায়ী নৌকাগুলো। 

সামোস দ্বীপে কর্মরত ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধি এলেফথেরিয়া পেট্রিডু বলেন, “তুর্কি উপকূলের সবচেয়ে নিকট অংশ থেকে সামোস দ্বীপের দূরত্ব মাত্র ২ কিলোমিটার।”

গত সপ্তাহে এই অঞ্চলটিতে ৭৫০ জন অনিয়মিত অভিবাসীকে সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধা দেয়া হয়েছিল। গ্রিক উপকূলরক্ষীরা দাবি করেছে, বছরের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত রেকর্ড ৪০ হাজার অভিবাসীকে তুরস্ক পেরিয়ে ইউরোপীয় অঞ্চলে প্রবেশ আটকে দেয়া হয়েছে। 

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত তিন হাজারেও বেশি আশ্রয়প্রার্থী গ্রিসে এসেছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র এপ্রিল মাসেই এসেছেন প্রায় এক হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী।  

করোনা মহামারির পর থেকে গ্রিক সীমান্তে কড়াকড়ি থাকলেও চলতি বছর হঠাৎ সীমান্ত পেরিয়ে দেশটিতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রবেশের চেষ্টা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।


২০২০ সালের ১ মার্চ কাস্তানিজের কাছে তুর্কি-গ্রিক স্থল সীমান্তে  গ্রিক সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সামনে অভিবাসীরা। ছবি: রয়টার্স
২০২০ সালের ১ মার্চ কাস্তানিজের কাছে তুর্কি-গ্রিক স্থল সীমান্তে গ্রিক সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সামনে অভিবাসীরা। ছবি: রয়টার্স


সামোস দ্বীপে সক্রিয় এনজিও ‘এশিয়া’ এর সমন্বয়ক মার্ক-অ্যান্টোইন পিনউ বলেছেন, “অবশ্যই ভালো আবহাওয়ার কারণে পরিস্থিতি আংশিকভাবে পরিবর্তন হয়েছে। তবে এর পেছনে বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশের উদ্বেগজনক রাজনৈতিক ব্যাখ্যাও রয়েছে।”

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক ঘোষণা দিয়েই সীমান্তবর্তী অভিবাসন গেটগুলো খুলে দিয়েছিল। যার ফলে হাজার হাজার আশ্রয়প্রার্থী তুরস্ক এবং গ্রিসের মধ্যকার স্থল সীমান্ত এবং এভ্রোস নদীর পাশে আটকা পড়েছিল। 

বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক সেরকম না হলেও ২০২২ সালের সীমান্ত প্রচেষ্টার সংখ্যা বেশ উদ্বেগজনক। 

এথেন্স এবং আঙ্কারার মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা

এথেন্সের মতো গ্রিক এনজিওগুলোরও একই প্রশ্ন, আবারও কি ২০২০ সালের শীতের পুনরাবৃত্তি হবে? 

অনেক অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ১৭ মে মার্কিন কংগ্রেসে দেয়া গ্রিক প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিৎসোটাকিসের ভাষণকে উদ্বৃত করছেন। ৪১ মিনিটের ভাষণে গ্রিক প্রধানমন্ত্রী আঙ্কারার ক্ষোভকে উস্কে দিয়েছেন বলে মনে করছেন অনেক এনজিও ও অধিকার সংস্থা। 

তার বক্তব্যে গ্রিক সরকার প্রধান তুরস্কের নাম উল্লেখ না করেই বলেন, “গ্রিসের আকাশ ও সমুদ্র সীমান্তে প্রতিনিয়ত হুমকি এবং আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে।”

এই বক্তব্যের পরই তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের প্রতিক্রিয়া আসতে বেশি সময় লাগেনি। তুর্কি রাষ্ট্রপতি তার উত্তরে বলেন, তার চোখে গ্রিক প্রধানমন্ত্রীর আর কোনো অস্তিত্ব "আর বিদ্যমান নেই।”

প্রকৃতপক্ষে, এই বক্তব্যের পর থেকেই দুই দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারের মধ্যে সব ধরনের আলোচনা অনানুষ্ঠানিকাভবে স্থগিত আছে।

এছাড়া ৩১মে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেহমেত কাভুসোগলু গ্রিসের রোডস, সামোস, চিওস এবং লেসবোসসহ এজিয়ান সাগরের ১৬ টি দ্বীপের উপর গ্রিকের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এসব দ্বীপ অভিবাসী নৌকার আগমনের স্থান হিসাবে পরিচিত। 


অভিবাসীদের প্রায়শই তুরস্কের দিকে পুশব্যাক করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে গ্রিসের বিরুদ্ধে। ছবি: এজিয়ান বোট রিপোর্ট
অভিবাসীদের প্রায়শই তুরস্কের দিকে পুশব্যাক করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে গ্রিসের বিরুদ্ধে। ছবি: এজিয়ান বোট রিপোর্ট


৩০ ও ৩১ মে অনুষ্ঠিত বিশেষ ইউরোপীয় শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এর পক্ষ থেকে ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তুরস্কের এই বক্তব্যকে যুদ্ধবাদী বিবৃতি আখ্যা দিয়ে নিন্দা জানিয়েছেন। 

দুই দেশের মধ্যে মৌখিক কূটনৈতিক উত্তেজনা অব্যাহত থাকায় আঙ্কারা ২০১৬ সালে ইইউ এর সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোকে আর মেনে চলছে না বলে ধারণ করা হচ্ছে। 

২০১৬ সালে অভিবাসন প্রবাহকে রোধ করতে তুরস্ক বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ইইউ এর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল।

সীমান্ত শক্তিশালী করছে গ্রিস

রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপে থাকা গ্রিক সরকার সীমানা শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

সীমান্তে কোস্টগার্ডের টহল দ্বিগুণ করা হয়েছে। এছাড়া তুরস্কের সাথে থাকা স্থল সীমান্তকে পৃথক করে ৩৫ কিলোমিটার কাঁটাতারের প্রাচীর তৈরি করেছে এথেন্স যা ধারাবাহিকভাবে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত হবে। 

এথেন্সের মতে, দেশের উত্তরে স্থল সীমান্তেও বেআইনি প্রবেশের প্রচেষ্টা বাড়ছে।

এনজিও ‘এশিয়া’ এর সমন্বয়ক’ মার্ক-অ্যান্টোইন পিনউ নিন্দা জানিয়ে বলেন, “সব প্রচেষ্টায় অভিবাসীদের ক্ষতির জন্য করা হয়েছে। একদিকে, তুরস্ক ইউরোপকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। অন্যদিকে, ইউরোপ অভিবাসীদের গ্রহণ করছে না।”

তার মতে, “সবাই অনেকটা পিং-পং বলের মতো কাজ করছে। এটা অমানবিক। এজিয়ান সাগর আরও একটি সলিল সমাধিতে পরিণত হবে।”

তুরস্কের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সমিতি, অধিকার সংগঠন ও ইউরোপীয় গণমাধ্যম এজিয়ান সাগরে গ্রিসের কর্তৃপক্ষ পুশব্যাকের নিন্দা জানিয়ে আসছে। 

এমনকি সম্প্রতি পুশব্যাক বিতর্কের মুখোমুখি হয়ে পদত্যগ করেছেন, ইইউ বহিঃসীমান্তরক্ষী সংস্থা ফ্রন্টেক্স প্রধান ফাব্রিস লেজেরি।  

গ্রিক গণমাধ্যমগুলো ইতিমধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে গ্রিস থেকে ফ্রন্টেক্স সৈন্যদের সম্ভাব্য প্রত্যাহারের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে যা এথেন্সকে সীমান্তে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। 


এমএইউ/এআই








 

অন্যান্য প্রতিবেদন