যুক্তরাজ্যে ক্ষেত থেকে ফল ও সবজি তোলা মৌসুমি নেপালী কর্মীদের কাছ থেকে একটি চক্র অবৈধভাবে টাকা নিচ্ছে বলে এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে৷
ব্রিটেনে ফসলের ক্ষেত থেকে অ্যাসপেরাগাস, ব্লুব্যারি, মোটরশুটিসহ বিভিন্ন ফল ও সবজি তুলতে কয়েকশত মৌসুমি কর্মীকে প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে চাকুরি দেয় কোবরি ফার্মস নামের একটি প্রতিষ্ঠান৷ হ্যারেফোর্ডশারের এই প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদেরকে কাজের জায়গাতেই আবাসনের ব্যবস্থা করে এবং ঘণ্টাপ্রতি তাদের অন্তত ১০ দশমিক দশ পাউন্ড মজুরি দেয়৷
কোবরির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২১ সালে মূলত ইউক্রেন থেকে অনেক কর্মী নিয়োগ দিয়েছে৷ পাশাপাশি রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়া থেকেও কিছু কর্মী নিয়োগ দিয়েছে৷ এসময় ৫২০ জন নেপালি নাগরিককে মৌসুমি কাজের ভিসা দেয়া হয়েছে এবং তাদের অনেকে কোবরি ফার্মসে কাজ করেছেন৷
চলতি সপ্তাহে ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান এবং ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (টিবিআইজে) এক যৌথ অনুসন্ধানে জানিয়েছে যে নেপালি অনেক কর্মীর যুক্তরাজ্যে পৌঁছাতে বেশ মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়েছে৷
তাদের একজনের নাম দিত্য (ছদ্মনাম)৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের এই ‘সিঙ্গেল মাদার’ জানিয়েছেন যে তিনি কাজটি পেতে নিয়োগদাতা এজেন্সিকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছেন৷ এই টাকার মধ্যে তার যুক্তরাজ্যে পৌঁছানোর বিমানের টিকিট এবং ভিসার খরচ রয়েছে, যা সাকুল্যে ত্রিশ হাজার টাকার মতো হওয়ার কথা৷ আর বাকি টাকার মধ্যে অবৈধ কোনো ফি যোগ করা হয়েছে বলে মনে করেন দিত্য৷
দিত্য একা নন৷ কোবরি ফার্মসে কাজ করা আরেক নেপালী কর্মী জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্যে ফার্মটিতে কাজ পেতে নেপালি এক নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি৷
ইইউর বাইরে থেকে কর্মী নিয়োগ বাড়ছে
কৃষিখাতে সহায়তার জন্য গত কয়েক দশক ধরেই বিদেশি কর্মীদের সহায়তা নিচ্ছে যুক্তরাজ্য৷ তবে গত দুই বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) নয় এমন দেশ থেকে কর্মী আনার হার বেশ বেড়েছে৷ ২০২২ সালে অন্তত ৩০ হাজার মৌসুমি বিদেশি কর্মী দেশটিতে কাজ করার সুযোগ পাবেন, চাহিদা আরো বেশি হলে সংখ্যাটি ৪০ হাজারেও পৌঁছাতে পারে৷
২০১৯ সালে নেয়া এক নতুন প্রকল্পের আওতায় এসব বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেয়া হচ্ছে৷ সেসময় এমন উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল যে ইইউত্যাগ করার পর কর্মী সংকটে পড়তে পারে ব্রিটেন৷ তাই সেই ঘাটতি পূরণে বিদেশি কর্মী নিয়োগের নতুন প্রকল্প কার্যকর করা হয়৷
যুক্তরাজ্য সরকার এটাও বুঝতে পেরেছিল যে এভাবে নিয়োগ করা কর্মীরা নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হতে পারেন৷ ফলে প্রকল্পের পরীক্ষামূলক ধাপেই এসব নিগ্রহ প্রতিরোধে উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে শক্ত অবস্থানের কথা জানানো হয়েছিল৷
ইতোমধ্যে কিছু সমস্যা শনাক্তও সম্ভব হয়েছে৷ যেমন কর্মীদেরকে তাদের নিজেদের ভাষায় চুক্তিপত্র দেয়া হয় না বলে তারা অনেক কিছু বুঝতে পারে না এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷ যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছে৷
এই কর্মী নিয়োগ প্রকল্পের আওতায় কাজ করতে আগ্রহী মৌসুমি কর্মীরা যুক্তরাজ্যে যাওয়ার টিকিট এবং ভিসা খরচ ছাড়া অন্য কোনো প্রয়োজনে কোনো টাকা দেবে না বলেও নিয়ম রয়েছে৷
কিন্তু দুই ব্রিটিশ গণমাধ্যমের তদন্ত বলছে বাস্তবতা ভিন্ন৷ তারা বলছে এই বিষয়ে নজরদারির অপ্রতুলতা এবং মৌসুমি কর্মীর চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক কর্মী শোষণের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন৷
যুক্তরাজ্যের স্বাধীন দাসত্ববিরোধী কমিশনের সাবেক উপদেষ্টা এমিলি কেনওয়ে এই বিষয়ে বলেন, ‘‘সুপারমার্কেটের তাকে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিতে অভিবাসী কর্মীরা যুক্তরাজ্যে এসেছেন৷ এক্ষেত্রে আমাদের দিকটা ঠিক রাখতে হবে, আর তাতে কর্মীরা যাতে এখানে আসতে গিয়ে লুন্ঠিত না হয় সেটা নিশ্চিত করাও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে৷’’
টাকার জন্য অপেক্ষা
এদিকে, যুক্তরাজ্যে নেপালি মৌসুমি কর্মীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে৷ চলতি মাসের প্রথম তিন মাসের পরিসংখ্যানে মৌসুমি কর্মীর হিসেবে নেপালের অবস্থান চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে৷ এই সময়ে দেশটি থেকে ৩৯৫ জন মৌসুমী কর্মী যুক্তরাজ্যে এসেছেন৷ এই খাতে গতবছর তাদের অবস্থান নবম ছিল৷
বিশাল তামাং মাত্র সত্তরহাজার টাকা খরচ করে নেপাল থেকে কর্মী হিসেবে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন৷ বর্তমানে অভিবাসন নিয়ে গবেষণা করা এই নেপালী টিবিআইজেকে বলেন, ‘‘হাজার হাজার নেপালী বিভিন্ন নিয়োগদাতা এজেন্সিকে নিয়োগ ফি হিসেবে টাকা দিয়েছেন৷ কিছুক্ষেত্রে সেই টাকা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘তারা এমন সব মহাজনের কাছ থেকে টাকা ঋণ নেন যারা অত্যন্ত চড়া সূদে ঋণ দেন এবং সেই টাকার গ্যারান্টি হিসেবে ঋণগ্রহীতার জমির দলিল রেখে দেন৷ এসব জমির উপর অনেক পরিবার যুগ যুগ ধরে নির্ভরশীল৷’’
টিবিআইজে জানিয়েছে, ব্রিটেন সরকারের প্রকল্পের আওতায় আসা নেপালী কর্মীদের কাছ থেকে নিয়োগদাতাদের অবৈধভাবে টাকা নেয়ার বিষয়টি তদন্ত শুরু করেছে টেস্কো এবং এমএন্ডএস৷ সুপারমার্কেট দুটো কোবরি ফার্মস থেকে পণ্য কেনে৷
টেস্কো জানিয়েছে যে ক্ষতিগ্রস্ত মৌসুমি কর্মীদের সব টাকা ফেরত দেয়া উচিত, তবে টিবিআইজে যে নেপালীদের সঙ্গে কথা বলেছে তাদের কেউই এখনো কোনো টাকা ফেরত পাননি৷
এআই/কেএম