মাথা গোঁজার ঠাই এবং উন্নত সুরক্ষার দাবিতে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে প্যারিসের রিপাবলিক চত্তরে বিদেশী নাবালকদের বিক্ষোভ। ছবিঃ ইনফোমাইগ্রেন্টস
মাথা গোঁজার ঠাই এবং উন্নত সুরক্ষার দাবিতে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে প্যারিসের রিপাবলিক চত্তরে বিদেশী নাবালকদের বিক্ষোভ। ছবিঃ ইনফোমাইগ্রেন্টস

২০ বছর বয়সি মামাদু সোউ দুই মাস ধরে বৃহত্তর প্যারিস অঞ্চলের ভাঁসেন এলাকায় অবস্থিত প্রশাসনিক আটক কেন্দ্র বা সিআরএ-তে বন্দি রয়েছেন। নাবালক হিসেবে ফ্রান্সে এসে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া মামাদুকে অনিয়মিত অভিবাসী হিসেবে আটক রাখা বেআইনি ও অন্যায় দাবি করে বিক্ষোভ করেছে অভিবাসন সংস্থা এডুকেশন উইদাউট বর্ডার নেটওয়ার্ক (আরইএসএফ) সহ কয়েকটি সংগঠন।

দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে ইল-দ্য-ফ্রন্সঁ অঞ্চলের ভাঁসেন প্রশাসনিক আটক কেন্দ্র (সিআরএ ) বা ডিটেনশন সেন্ট্রারে বন্দি রয়েছেন ২০ বছর বয়সি গিনির নাগরিল মামাদু সোউ। ফ্রান্সে নাবালক হিসেবে আসার পর একটি দুই বছর মেয়াদি কারিগরি কোর্স সম্পন্ন করে আরেকটি পেশাদার স্নাতক কোর্সে ভর্তি ছিলেন মামাদু। 

বুধবার ১৫ জুন, তার মুক্তির দাবিতে প্যারিসের ১৩ তম অ্যারোন্ডিসমেন্ট বা ডিস্ট্রিক্টের স্থানীয় নগর ভবনের সামনে একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে এডুকেশন উইদাউট বর্ডার নেটওয়ার্ক (আরইএসএফ)। সমাবেশে মামাদুকে মুক্তি দিয়ে আবারও তার পড়াশোনা শুরু করতে দেয়ার দাবি জানানো হয়। 


আরইএসএফ নেটওয়ার্কের মতে, “অনিয়মিত অভিবাসী তরুণদের ফ্রান্স ত্যাগের নোটিশ দেয়া এবং বহিষ্কার করা হবে অপচয় এবং অপব্যবহার। কারণ মামুদু সোউ ২০১৮ সালের শুরুতে ফ্রান্সে নাবালক হিসেবে এসেছিলেন। তিনি ফরাসি সমাজে নিজের অবস্থান সংহত করা ও ইন্টিগ্রেট হওয়ার পথে বেশ ভালো ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কাপ বা (সেআপে) নামক একটি কারিগরি কোর্স শেষ করে, তিনি প্যারিসের ১৩ তম অ্যারোন্ডিসমেন্টে অবস্থিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি কারিগরি স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হন।”

স্বাভাবিক নিয়মেই ছিলেন মামাদু

ফ্রান্সে নাবালক হিসেবে এলে কিশোররা সাধারণত শিশুদের জন্য নির্ধারিত সামাজিক দপ্তর (এএসই) এর আওতায় থাকে। মামাদুও ঠিক একই নিয়মে এএসই এর সঙ্গে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি থেকে উপকৃত হচ্ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে এএসই এর চুক্তির মেয়াদ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ২১ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমতি দেয়া হয়। যার ফলে সদ্য নাবালক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া তরুণ শিক্ষা, আবাসন ও মানসিক সহায়তা কেন্দ্র থেকে উপকৃত হতে পারেন। 

মামদু নাবালক হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া-সহ যাবতীয় শর্ত মেনে পরবর্তীতে বৈধতা প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। 

আরও পড়ুন>>প্যারিসে বিদেশি নাবালকদের শোষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার সাত পাচারকারী

এছাড়া তিনি এএসই এর অনুমদিত চুক্তির আওতায় বৃহত্তর প্যারিসের সেইন-সেন্ট-ডেনিস অঞ্চলের অরোর নামক একটি অভিবাসন সংস্থার কেন্দ্রে বসবাস করছিলেন এবং সার্বিক প্রশাসনিক সহায়তা পেয়ে আসছিলেন।  

এডুকেশন উইদাউট বর্ডার নেটওয়ার্ক (আরইএসএফ) এর সদস্য আন ম্যারি দেফু ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন,”অনাথ মামাদুকে তার একমাত্র বোন কোলে পিঠে করে বড় করেছেন। সম্প্রতি এই বোনটিও মারা যাওয়ায় তার জন্মভূমি গিনির সঙ্গে কার্যত সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনার পর মামাদু তার পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আগামী সেপ্টেম্বর থেকে মামাদুকে আবারো পড়াশোনার সুযোগ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ বর্তমান ছাত্র হিসেবে তার কাছে প্রমাণপত্র আছে।”

আপিলের রায় না আসা পর্যন্ত বহিষ্কার বেআইনি

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ চেকে পড়েছিলেন মামাদু। তখন তাকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। বসবাসের অনুমতি না থাকায় ফরাসি অঞ্চল ত্যাগ করার বাধ্যবাধকতা বা ওকিউটিএফ রয়েছে তার৷

ফেব্রুয়ারির ঘটনায় গ্রেপ্তার এড়ানো গেলেও পরবর্তীতে ১৩ এপ্রিল গণপরিবহনে নিয়মিত পুলিশ চেকিংয়েক সময় গ্রেপ্তার হন মামাদু। 

২০ বছর বয়সি মামদুকে ১৬ জুন ফ্রান্স থেকে বহিষ্কার করার কথা ছিল, কিন্তু বিমানটি বাতিল করা হওয়ায় সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। 

পড়ুন>>নাবালকদের অধিকার আদায়ে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ফরাসি বেকারি মালিক

আন ম্যারি দেফু ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “এমন বহিষ্কার ফরাসি কর্তৃপক্ষ চাইলে প্রতিদিন করতে পারবে। কিন্তু এগুলো বেআইনি। কারণ ফ্রান্সে বিদেশিদের প্রবেশ, থাকার নিয়ম এবং আশ্রয় সংক্রান্ত আইনের ধারা অনুযায়ী ওকিউটিএফ আদেশের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের রায় না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিকে বহিষ্কার বা ডিপোর্ট করা বেআইনি।” 

গিনি থেকে আসা ২০ বছর বয়সি মামাদুর জন্য বহিষ্কারের সম্ভাবনা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। মামাদু আটক কেন্দ্র থেকে ফোনে জানান, “দেশে আমার আর পরিচিত কেউ নেই। আমি সেখানে ফিরে গেলে জানি না আমার কী হবে?”

মামাদু অপ্রাপ্তবয়স্ক বা নাবালক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে অপেক্ষাকালীন সময়ে ‘টিমি’ নামক একটি অভিবাসন সংস্থার আওতায় ছিলেন। 

আরও পড়ুন>>বেলজিয়ামে অপ্রাপ্তবয়স্ক বিদেশিরা আইনি অভিভাবকের সংকটে

এই সংস্থার সভাপতি এসপেরন্স মিনার্ত বলেন, “মামুদোকে বহিষ্কার করা হলে তার উপর অনেক বড় অন্যায় হবে। কারণ দেশে তার কেউ নেই। তাকে এমন দেশে পাঠানো হবে যেখানে তার আর কোনো আত্নীয় নেই। আমরা জানি যে এমন হলে তাকে নিজেদের দেশে গিয়ে রাস্তায় বসবাস করতে হবে।”

অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্কদের এবং সদ্য প্রাপ্তবয়স্কদের অধিকার আদায়ে কাজ করা এই অধিকার কর্মী বলেন, “ফ্রান্স বিদেশিদের প্রতি আরও বেশি প্রতিকূল হয়ে উঠছে। আমরা ২০২১ ও ২০২২ সালে তরুণ ও সদ্য প্রাপ্তবয়স্কদের বিরুদ্ধে একাধিক দেশত্যাগের নোটিশ বা ওকিউটিএফ পেয়েছি। যা অতীতে কখনও দেখা যায় নি।” 

পড়ুন>>ফ্রান্স: অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্কদের আশ্রয় প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ

তার মতে, এই সিদ্ধান্তগুলি ২০২১ সালের জুনের শুরুতে ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রঁর অভিবাসন বিষয়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলির ফলাফল। তিনি সে সময় অনিয়মিত বিদেশিদের বহিষ্কার বাড়ানোর কথা বলেছিলেন।২০২২ সালে ফরাসি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ও এই বিষয়টি বহুবার আলোচিত হয়েছিল।


মূল প্রতিবেদন জুলিয়া দ্যুমো। ফরাসি থেকে ভাষান্তর মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ।


এমএইউ/আরকেসি


 

অন্যান্য প্রতিবেদন