অপর্যাপ্ত ভাষাগত দক্ষতা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে অর্জিত ডিগ্রির স্বীকৃতি অর্জনে সমস্যা ও আবাসন সংকটসহ বিভিন্ন কারণে চাকরি পেতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় ফ্রান্সে অবস্থানরত শরণার্থীদের। তবে আশার কথা হলো, শ্রমিকের ঘাটতি পূরণে সংকটে ভোগা ফরাসি নিয়োগকর্তারা চাচ্ছেন শরণার্থীদের আরও বেশি নিয়োগ দিতে। বিস্তারিত পড়ুন সাক্ষাৎকারে।
বুধবার ২২ জুন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্যারিস চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির কর্মকর্তারা।
কোম্পানিগুলোর চলমান শ্রমিক ঘাটতি মেটাতে শরণার্থীদের চাকুরিতে নিয়োগ দেয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে জানান ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
ফরাসি ব্যাংক ও শিল্পগ্রুপ বিএনপি পারিবা ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি ইজাবেল জিওর্দানো বলেন, “আমরা শরণার্থীদের ইন্টিগ্রেশনে শুধু কাজ করলেই হবে না, বরং আরও জোরালো ভাবে কাজ করতে হবে।”
ইতিমধ্যে এই শিল্পগ্রুপ শরনার্থীদের ফরাসি সমাজে ইন্টগ্রেশনে সহায়তার জন্য বিভিন্ন খাতে ১৭ মিলিয়ন ইউরো বা ১৭০ কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছে।
আরও পড়ুন>>ইটালির কৃষিখাতে সাড়ে তিন লাখ বিদেশি
ফরাসি শিল্পমালিকদের সংগঠন মেদেএফ-এর প্রতিনিধি ওডিল মেনেটিউ বলেন, “বর্তমানে কোম্পানিগুলোর বড় আকারে নিয়োগ দেয়ার আগ্রহ রয়েছে এবং শরণার্থী মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অবশ্যই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন।”
তিনি আরও যোগ করেন, দীর্ঘদিন ধরে শরণার্থী নিয়োগ করাকে একটি সহায়তা কার্যক্রম হিসেবে দেখা হচ্ছিল। এখন এটিকে অবশ্যই কর্মসংস্থান নীতির অংশ হিসাবে বিবেচনা করা উচিত।”
চাকরি খোঁজার জন্য নিবেদিত ফরাসি সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘পোল-এমপ্লোয়া’ পরিচালিত "জনশক্তির প্রয়োজন" নামক একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২০২২ সালের ৩০ লাখেরও বেশি নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে ফরাসি প্রতিষ্ঠানগুলোর। যা ২০২১ সালের তুলনায় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২১ সালের শরণার্থী ও রাষ্ট্রহীনদের নির্ধারিত ফরাসি দপ্তর (অফপ্রা) এবং ফরাসি জাতীয় আশ্রয় আদালর (সিএনডিএ) প্রায় ৫৪,০৯৪ জনকে সুরক্ষা মর্যাদা প্রদান করেছে।
আরও পড়ুন>>ফ্রান্সে সাংসদ নির্বাচিত হলেন সাবেক অভিবাসী পরিচ্ছন্নতা কর্মী রাশেল কেকে
ফ্রান্সে বিদেশীদের জন্য নিবেদিত ডিরেক্টরেট জেনারেল (ডিজেইফ) এর পরিসংখ্যান অনুসারে, শরণার্থী মর্যাদা এসব অভিবাসীদের অধিকাংশেরই ফরাসি শ্রমবাজারে প্রবেশাধিকার নেই। কারিগরি ও নানা প্রশাসনিক সমস্যায় জর্জরিত শরণার্থীরা।
এ ব্যাপারে ইনফোমাইগ্রেন্টসের সাথে কথা বলেছে ধনী দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিভাগের প্রধান জঁ-ক্রিস্টোফ দ্যুমো’র সাথে। পড়ুন তার সাক্ষাৎকারটি।
ইনফোমাইগ্রেটস: বর্তমানে ইউরোপে একজন শরণার্থীর প্রথম চাকরি খুঁজে পাওয়ার গড় সময়সীমা কত?
জঁ-ক্রিস্টোফ দ্যুমো: প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে আমরা দেখতে পাই, ইউরোপের প্রায় অর্ধেক শরণার্থীর একটি কর্মসংস্থান খুঁজে পেতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে।
এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যে, যখন আমরা কাউকে কোন প্রতিষ্ঠানের ‘কর্মচারী‘ হিসেবে সম্বোধন করি তার অর্থ এই নয় যে উক্ত ব্যক্তি একটি স্থায়ী কাজের চুক্তি পেয়েছেন৷
মূলত চাকরি খুঁজে পেয়েছে মানে যেকোনো ধরনের কাজ, এমনকি অনিশ্চিত কাজও হতে পারে। ইউরোপে আসা শরণার্থীদের মধ্যে মাত্র অর্ধেক তাদের আগমনের ১০ বছরের মধ্যে কোনও না কোনও উপায়ে কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছে। এটা খুব দীর্ঘ, অনেক অনেক দীর্ঘ।
ইনফোমাইগ্রেটস: এতদিন কেন? তারা কী কী বাধার সম্মুখীন হয়?
জঁ-ক্রিস্টোফ দ্যুমো: এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সুরক্ষাপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তি আইনি সংজ্ঞা অনুসারে, আঘাত ও কষ্ট নিয়েই তিনি তার দেশ ছেড়েছেন। প্রায়শই তারা কোনো প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি ও সতর্কতা ছাড়াই এসে থাকেন। এমনকি কখনো কখনো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও সনদ ছাড়াই নিজের দেশ থেকে পালিয়ে আসেন। এসব ঝামেলা তাদেরকে অস্থির এবং দুর্বল করে তোলে। প্রস্থানের সময়কার সমস্যার কারণে শরণার্থীরা গন্তব্যের দেশের উদ্দেশ্যে একটি ভাল সংহতকরণ বা ইন্টিগ্রেশন প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি নেয়ার সময় পান না।
দেখা যায়, শরণার্থীরা ফরাসি ভাষা অথবা সংস্কৃতি সম্পর্কে না জেনেই ফ্রান্সে এসে থাকেন। তাদের কাছে ফরাসি চাকরির বাজার, চাকরির ইন্টারভিউ কেমন হয় বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কী এসব জানা থাকে না। তারা বেশিরভাগ সময় নিজেদেরকে একটি একা ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আবিষ্কার করে।
পড়ুন>>ফ্রান্সে অনিয়মিত শ্রমিকরা কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার হলে করনীয় কী?
আরেকটি সমস্যাযুক্ত বিষয় হল একজন শরণার্থী যদিও তার সকল শিক্ষাসনদ সাথে নিয়ে যেতে সক্ষম হন, তবে সেক্ষেত্রেও একটি ঝুঁকি রয়েছে। নিয়োগকর্তারা অনেক সময় এসব ডিগ্রির বৈধতা নিয়ে সন্দেহ করেন। (ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে ইস্যু হওয়া সকল ডিগ্রি অবশ্যই প্রশাসনিক যাচাইয়ের মধ্যে দিয়ে ফরাসি মান অনুযায়ী সঙ্গতিপূর্ণ হিসাবে স্বীকৃত হতে।)
ফরাসি ভাষা ভাল না জানা এবং সমমান করা যায় না এমন ডিগ্রি দিয়ে নিজের জন্য একটি কাজ খুঁজে পাওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ।
এছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কিত বেশ কিছু অসুবিধা আছে। প্যারিস অঞ্চলে যারা আসেন তাদের অনেক লোকের দেখা হয় এবং সেখানেি বসবাস করতে থাকেন। বৃহত্তর প্যারিস অঞ্চলে, অনেক শরণার্থীই থাকেন। যার ফলে এই এলাকায় কাজ খুঁজে পেতে প্রতিযোগিতাও অনেক বেশি।
আমরা জানি, ফরাসি শ্রমবাজারে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক ঘাটতি রয়েছে মূলত প্যারিসের বাইরে অন্য বিভাগগুলোতে। বৃহত্তর প্যারিস অঞ্চলে শ্রম ঘাটতি নেই বললেই চলে।
ইনফোমাইগ্রেটস: সুনির্দিষ্টভাবে শরণার্থীদের ইন্টিগ্রেশন প্রক্রিয়া উন্নীত করতে কী করা যেতে পারে?
জঁ-ক্রিস্টোফ দ্যুমো: ইতিমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেমন, শরণার্থীদের চাকরি এবং আবাসন খুঁজে দিতে ‘আজির’ নামক একটি সহায়তা প্রোগ্রাম চালু করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়।
২০১৮ সাল থেকে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন ফর ফ্রেঞ্চ অফিস (অফি) এর নেয়া রিপাবলিকান ইন্টিগ্রেশন কন্ট্রাক্ট (সিআইআর) এর বিশেষ পরিবর্তনগুলিও ফলাফল দেয়া শুরু করবে। বিশেষ করে পরিবর্তনের আওতায় একজন ব্যক্তি শরণার্থী মর্যাদা পাওয়ার পর বাধ্যতামূলক ভাষা প্রশিক্ষণের সময় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এটি ২০০ থেকে ৪০০ থেকে ঘন্টা করা হয়েছে। অনেক সময় ব্যক্তির উপর নির্ভর করে এটি ৬০০ ঘন্টা পর্যন্ত যেতে পারে। এই পরিবর্তনটি শ্রমবাজারে শরণার্থীদের অবস্থান সংহত করার একটি পূর্বশর্ত। কারণ ভাষা জানা চাকরি খুঁজে পেতে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পড়ুন>>ফ্রান্সে শরণার্থীদের ‘অনিশ্চিত, অসন্তোষজনক’ কর্মসংস্থান
এছাড়া ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন ফর ফ্রেঞ্চ অফিস (অফি) এবং‘পোল-এমপ্লোয়া’ -এর মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সম্প্রতি আসা ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের দ্রুত কাজ চাকরি খুঁজে দিতে তারা সমন্বয় করে কাজ করেছে আমরা আশা করতে পারি যে এটি দ্রুত সব শরনার্থীদের জন্যেও প্রয়োগ করা হবে।
ইন্টিগ্রেশন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া৷ আপনাকে ভাষাে দক্ষতা অর্জন করতে হবে, সন্তোষজনক বাসস্থান খুঁজে পেতে হবে ইত্যাদি। এটা রাতারাতি ঘটে না। অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, চাকরি হারানোসহ নানা সমস্যা হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে খারাপ সময়ে এসব ব্যক্তিদের সহায়তা করতে হবে। যাতে করে তারা সবকিছু বুঝে উঠতে পারে। ব্যবসায়ি এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের জন্য এটি একটি ম্যারাথন দৌড়, স্প্রিন্ট নয়।
ইনফোমাইগ্রেটস: বিদেশি ডিগ্রির স্বীকৃতির বিষয়টি কী? এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
জঁ-ক্রিস্টোফ দ্যুমো: এটা সত্যিই বেশ বড় একটি সংকট। বিদেশী ডিগ্রি ও সনদের স্বীকৃতি এবং পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার বৈধতা ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ফ্রান্স অনেক পিছিয়ে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ সমস্যাটি বুঝতে পারলেও এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই করা হয়নি।
পড়ুন>>ফ্রান্স: রান্না শেখা শরণার্থীদের গল্প
এটা লজ্জাজনক, কারণ যারা শরণার্থী মর্যাদা পায় তারা প্রায়শই তাদের জীবন পুনর্গঠনের জন্য বেশ অনুপ্রাণিত থাকেন। যখন তারা চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারে, তখন তারা প্রচুর সম্ভাবনাময় হয়ে উঠে। কারণ বৈধতা পাওয়ার পর সবার মধ্যে দ্রুত শেখার এবং স্বাবলম্বী হওয়ার তীব্র ইচ্ছা থাকে। যখন তাদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ থাকে, তখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যবসায় নামেন।
আমরা বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে যা দেখেছি তা হলো, সুযোগ পেলে শরণার্থীরা বেশ ভালোভাবেই সফল হন।
মূল প্রতিবেদন শার্লত ওবেরতি। ফরাসি থেকে ভাষান্তর মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ।
এমএইউ/আরআর