২০২২ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত চার হাজার ১৫৪ জন মিশরীয় অভিবাসী সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইটালি উপকূলে এসেছেন। মিশরের অর্থনৈতিক সংকট এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের কারণে হাজারো নাগরিক উন্নত জীবনের খোঁজে শেষ অবলম্বন হিসাবে সমুদ্রপথে ইউরোপ পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইনফোমাইগ্রেন্টসের বিশেষ প্রতিবেদন।
ইউরোপে বসন্ত শুরুর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই অভিবাসী বোঝাই ছোট নৌকাগুলো ইটালিতে অবতরণ করে। এসব নৌকার বেশিরভাগই ইটালির ক্যালাব্রিয়া, সিসিলি এবং লাম্পেদুসা উপকূলে এসে ভিড় করে।
মধ্য ভূমধ্যসাগরের এই বিপজ্জনক রুটে জীবনের সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে যাত্রা করেন দারিদ্র্যে জর্জরিত হাজারো মিশরীয় নাগরিক। শুধুমাত্র মিশরীয় অভিবাসীরা নন, এই পথে ইটালিতে আসা অভিবাসীদের মধ্যে শীর্ষে আছেন বাংলাদেশিরা।
ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, “২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত মোট ২৬ হাজার ৬৫২ জন সমুদ্রপথে ইটালিতে এসেছেন। বাংলদেশিদের পরই ইটালিতে সবথেকে বেশি আসেন দেশ মিশরীয়রা।”
আরও পড়ুন>>ইটালির কৃষিখাতে সাড়ে তিন লাখ বিদেশি
যদিও মিশরের উপকূল থেকে ইটালিতে আসার পথ পুরোপুরি আলাদা। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের উপকূল থেকে ইটালির লাম্পেদুসা এবং সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের দূরত্ব ১৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মত, চলতি বছর ইটালিতে মোট যত লোক এসেছে, তাদের মধ্যে চার হাজার ৬০৫ জন বাংলাদেশি (১৬ শতাংশ) এবং প্রায় চার হাজার ১৫৪ জন মিশরীয় (১৫ শতাংশ) ।
মিশরীয়দের ক্ষেত্রে এটি ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। সে সময় দেশটি থেকে আসা এক হাজার ৫৪৩ জন নাগরিককে নথিভুক্ত করা হয়েছিল।
ইউরোপীয় কমিশনও মিশর থেকে নতুন করে ছোট নৌকায় অনিয়মিত অভিবাসীদের আগমন বৃদ্ধির ব্যাপারকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে।
১৫ জুন ইইউ কমিশনের একটি অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ইউরোপীয় সংবাদ মাধ্যম ইউরো অবজারভার জানিয়েছে, “মিশর উপকূল থেকে অনিয়মিত অভিবাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে শীঘ্রই দেশটির সরকারকে ৮০ মিলিয়ন ইউরো বা ৮০০ কোটি টাকা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে ইইউ কমিশন।”
পড়ুন>>অভিবাসীদের আগমনে হিমশিম খাচ্ছে লাম্পেদুসা
ইউরো অবজারভারের হাতে আসা ইইউ কমিশনের নথিতে বলা হয়েছে, এই অর্থের মধ্যে প্রায় ২৩ মিলিয়ন ইউরো বা ২৩০ কোটি টাকা এ বছর উপকূলীয় অঞ্চলে সীমান্ত নজরদারি সরঞ্জাম কেনার অর্থায়নের জন্য মঞ্জুর করা হবে। অবশিষ্ট ৫৭ মিলিয়ন ইউরো বা ৫৭০ কোটি টাকা পরের বছর নানারকম শনাক্তকরণ সরঞ্জাম কেনার জন্য দেয়া হবে।
এছাড়া নথিতে উল্লেখ করা হয়, লিবিয়া এবং সুদানের সঙ্গে থাকা মিশরীয় সীমান্তও যৌথ নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা হবে, তবে এটি নিয়ে কোন বিশদ বিবরণ দেয়া হয় নি।
বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে ২৭১ শতাংশ
মিশর থেকে হাজারো অনিয়মিত অভিবাসীদের ইউরোপীয় ইউনিয়নে আগমন দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে, কারণ তাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার কারণগুলো মূলত মিশরীয় সমাজের সঙ্গে জড়িত।
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশটি গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট পার করছে। সেখান থেকে নিজেদের বের করে আনার জন্য লড়াই করছে দেশটি।
২০১৬ সালে সেনা প্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছর পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমঈফ) দেশটির জন্য ১২ বিলিয়ন ডলারের জরুরি উদ্ধার ঋণ মঞ্জুর করেছিল।
মিশর সরকার তখন একদিকে ব্যয় কমিয়ে এনে কঠোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়, অপরদিকে বেসরকারি খাতের সাহায্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির বিকাশকে উত্সাহিত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র কমানোর চেষ্টা করে।
আরও পড়ুন>>ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্তের আদ্যোপান্ত
তাহরির ইনস্টিটিউট ফর মিডল ইস্ট পলিসির গবেষক টিমোথি কালদাস বলেন, “সরকারের সেই পরিকল্পনার মাত্র অর্ধেক বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে এটা ঠিক ব্যয় সংকোচন নীতির ন্যায় কিছু কঠোর পদক্ষেপের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং বিদ্যুতের উপর ভর্তুকি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৭/২০১৮ সালে দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত মিশরীয়দের বিদ্যুত বিল ২৭১ শতাংশ বেড়েছে।”
যার ফলে দারিদ্র্যের হার আকাশচুম্বী হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, এটি এখন ২৯.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা ২০১৫ সালের তুলনায় দুই পয়েন্ট বেশি। তবে বিশ্বব্যাংকের অনুমান অনুযায়ী অবস্থা আরও ভয়াবহ। বিশ্ব ব্যাংকের মতে ২০১৯ সালে মিশরে মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ দরিদ্র বা অর্থনৈতিকভাবে বেশ দুর্বল অবস্থায় ছিল।
সর্বশেষ কোভিড -১৯ মহামারি এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে দেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। কারণ রাশিয়ার আক্রমণের আগে পর্যন্ত মিশর ছিল ইউক্রেনের প্রধান গম ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম। মিশরের মোট চাহিদার প্র্য ৩০ শতাংশ গম আমদানি হতো ইউক্রেন থেকে এবং ৬০ শতাংশ আসত রাশিয়া থেকে।
অন্য দেশের উপর খাদ্য নির্ভরতা মিশরে খাদ্য ঘাটতির হুমকি সৃষ্টি করেছে, যার দেশটির জনসংখ্যার জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক।
আমদানির ঘাটতির কারণে স্থানীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সম্মুখীন হয়ে ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যদ্রব্যের দাম ১৭.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের পক্ষে দেশটির প্রধান খাদ্য হিসেবে পরিচিত "বালাদি" রুটির ভর্তুকি অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে উঠছে। উল্লেখ্য, কয়েক দশক ধরে এই রুটির ভর্তুকির সরাসরি উপকারভোগী জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষ।

ইতিমধ্যে ২০২০ সালে, কর্তৃপক্ষ জনগণকে তাদের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থ প্রদান করেছে। প্রতি পিস রুটির দামের উপর একই ভর্তুকি কমিয়ে আনতে সরকার রুটির ওজনও কমিয়েছে। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি পিস রুটির ওজন ছিল ১৩০ গ্রাম। সেটি ২০১৬ সালে কমিয়ে আনা হয় ১১০ গ্রামে। সর্বশেষ ২০২০ সালে তা ৯০ গ্রাম হয়েছে।
৬০ হাজারেও বেশি বিরোধী মতের লোক আটক
টিমোথি কালদাসের মতে, “মিশর কর্তৃপক্ষ ক্রমাগত বিদেশি অভিবাসীদের দেশের সমস্ত সমস্যার উৎস বলে অভিযুক্ত করে আসছে। কিন্তু মিশরীয়রা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে লড়াই করছেn। অনেক যুবক, যারা একা বাইরে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন না, তারা তাদের বাবা-মায়ের সাথে থাকছে। বেশ কয়েক বছর ধরে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় বহু মানুষ অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ খুঁজছেন।"
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, “মিশরের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, অনেকেই অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজের দিকে ঝুঁকছেন, যা নিশ্চিতভাবে পাওয়া সহজ, কিন্তু সেগুলো আরও অনিশ্চিত। কেউ কেউ জীবিকা অর্জনের জন্য কাগজে কলমে দ্রুত উদ্যোক্তা হওয়ার সহজ উপায় বেছে নেয়। কিন্তু নিজের ব্যবসা স্থাপন করা জটিল প্রক্রিয়া।
পড়ুন>>সাগরে প্রাণ হারানো অভিবাসীদের জন্য কবরস্থান
তার মতে, “ব্যবসার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা সেনাবাহিনীর নিপীড়ন। দেখা গেল কেউ ব্যবসা দিল কিন্তু হঠাৎ সেনা সদস্যরা এসে বলবে কাল থেকে আপনার ব্যবসা বন্ধ। তাদের মন মতো না হলে কিছুই করা যায় না।”
মিশরে বিরোধী মতের উপর নির্যাতন ভয়াবহ। যারা ভাগ্যবান তাদের শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। আর বাকিদের হাজতে পাঠানো হয়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, মিশরে বর্তমানে ৬০ হাজারেরও বেশি বিরোধী মতের মানুষ বন্দি রয়েছেন। যাদের মধ্যে রয়েছে, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিক। যাদের বেশিরভাগকে শুধুমাত্র মতপ্রকাশ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং কথা বলার অধিকার দাবি করার জন্য আটক করা হয়েছে।
বর্তমানে ফ্রান্সে নির্বাসিত মিশরের খ্যাতনামা মানবাধিকার কর্মী বাহে এলদিন হাসান ফরাসি টিভি-৫ মোন্দকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিকে আজ সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ কিংবা সুদানের সাবেক স্বৈরশাসক ওমর আল বশিরের সঙ্গে তুলনা করা যায়।”
২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল, মিশরীয় রাষ্ট্রপতি তিন হাজার ২০০ জনেরও বেশি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমা আট বছর ধরে চলমান রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, হুমকি এবং নির্যাতনের সমাধান করবে না।
এছাড়া ২০১৯ সালে সংবিধান সংশোধন করে পরোক্ষ ভাবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সব ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। এমন নেতার আওতায় মিশরের সুন্দর ভবিষ্যত্ কল্পনা করা বেশ কঠিন বলে মনে করছেন মিশরীয়রা।
আরও পড়ুন>>এক লাখ মৌসুমি কর্মীর ঘাটতি ইটালিতে
গবেষক হাসান আবদেল রহমান অনুশোচনা করে বলেন, “আমি আশঙ্কা করছি, অভিবাসন হাজার হাজার মিশরীয়দের অনিবার্য ভাগ্যে পরিণত হয়েছে। মিশরের কঠিন পরিস্থিতিতে ইউরোপে একটি উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন অনেকের জন্য জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।”
এমএইউ/আরকেসি