কয়েকটি গণমাধ্যমের যৌথ তদন্তে আশ্রয়প্রার্থীদের সুরক্ষার প্রদানের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যে ব্যর্থতার চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৮২ জন আশ্রয়প্রার্থী সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে ও কর্তৃপক্ষের দেওয়া হোটেলে মারা গেছেন। মৃতদের অর্ধেকই অরক্ষিত ও দুর্বল স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ছিলেন বলে জানা গেছে।
আইভরি কোস্ট এবং লিবিয়ায় নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০২০ সালের জুনে যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন ২৬ বছর বয়সি মোহাম্মদ কামারা। আশ্রয় আবেদনের পর তাকে উত্তর লন্ডনের একটি হোটেলে স্থানান্তর করে কর্তৃপক্ষ। সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে রুপান্তরিত হওয়া হোটেলটিতে উঠার পর থেকেই মোহাম্মদ কামারা শরীরের বিভিন্ন অংশে তীব্র ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেন।
সেসময় একই হোটেলে থাকা আরেক আশ্রয়প্রার্থী মুসা ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “হোটেলটিতে থাকা অবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিল।”
হোটেলগুলো সাধারণত ব্রিটিশ সরকারের আওতাধীন একটি নির্দিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
ভুক্তভোগী আশ্রয়প্রার্থী কামারা হোটেলের কর্মচারীদের কাছে প্রতিনিয়ত চিকিৎসাজনিত সাহায্য চেয়েছিলেন বলে দাবি করেন তারই বন্ধু ও একই হোটেলের আশ্রয়প্রার্থী মুসা। কিন্তু তাকে হোটেল থেকে বলা হয়েছিল, তিনি আপাতত হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে যেতে পারবেন না।
হোটেল কর্মচারীদের মতে, “সে সময় করোনার স্বাস্থ্য বিধি ও লকডাউনের কারণে তাকে হাসপাতালে পাঠানো সম্ভব হয় নি।”
পড়ুন>> উপকূলে ব্যাপক কড়াকড়ি সত্ত্বেও বেড়েছে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ির প্রচেষ্টা
মোহাম্মাদ কামারাকে ২০২০ সালের নভেম্বরে নিজ কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
নিহতের পরিবারের আইনজীবীর মতে, ব্রিটিশ হোম অফিস বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় হোটেল কর্তৃপক্ষকে মোহাম্মদ কামারার বিশেষ চিকিৎসা সেবা প্রয়োজনের ব্যাপারটি অবহিত করেনি। আইন অনুযায়ী তাকে বিশেষ সেবা দেয়া উচিত ছিল।
মোহাম্মদ কামারার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটিকে গার্ডিয়ান যুক্তরাজ্যের মাটিতে আশ্রয়প্রার্থীদের রক্ষা করতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার চিত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
১৭ আশ্রয়প্রার্থীর আত্নহত্যা
লিবার্টি ইনভেস্টিগেটস নামে দ্য অবজারভার এবং গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি যৌথ তদন্তের হিসেব অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৮২ জন আশ্রয়প্রার্থী সরকারি আবাসন ও আশ্রয়কেন্দ্রে মারা গেছেন।
গার্ডিয়ানের হাতে আসা ব্রিটিশ হোম অফিসের বেশ কিছু নথি অনুসারে, নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৭ জন আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পশাপাশি, মৃতদের মধ্যে অর্ধেক ব্যক্তিই অত্যন্ত দুর্বল স্বাস্থ্যের এবং স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কিত ঝুঁকিতে ছিলেন বলে জানা গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে মতামত দেয়া বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের উল্লেখ করা বেশ কিছু মামলার বিবরণে সম্ভাব্য প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে ।
লিবারেল ডেমোক্র্যাট দল থেকে নির্বাচিত সংসদ এবং দলটির মুখপাত্র অ্যালিস্টার কারমাইকেল এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “এই প্রতিবেদন আশ্রয়প্রার্থী বসবাসের স্থান, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং আশ্রয়প্রার্থীদের দেওয়া সুরক্ষাব্যবস্থার উপর একটি জরুরি এবং স্বাধীন পরিদর্শনের দাবি করে।”
পড়ুন>>আশ্রয়প্রার্থীদের ইলেকট্রনিক ব্রেসলেট পরানোর পরিকল্পনা যুক্তরাজ্যের
কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বরাবরই সাধারণ ঘটনার ন্যায় আশ্রয় আইন বিষয়ক যেকোনো দায়িত্বের ব্যর্থতার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে নিজেদের রক্ষা করে।
হোম অফিসের একজন মুখপাত্র বলেন, “সাধারণ নাগরিকদের ন্যায় অসুস্থতাসহ যে কোনও কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। এখানে অন্য কিছু অনুমান করা ভুল।”
২০১৯ সালের নভেম্বরে চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে আসেন ২৩ বছর বয়সি শায়ান জাল দেহনাভি নামে এক ইরানি যুবক। দেশটিতে আসার এক বছর পর লিসেস্টারের একটি হোটেলে মারা যান তিনি।
তার একজন বন্ধু জানান, হোটেলটিতে শায়ানের দুর্দশার অন্ত ছিল না।
হোটেল কর্মীরা জানান, শায়ান জাল দেহনাভির অসুস্থতা এবং সমস্যাগুলো তারা হোম অফিসকে জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারবেন বলে জানানো হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
আইন অনুযায়ী, যখন কোনও আশ্রয়প্রার্থীর শারীরিক সুরক্ষার বিষয়ে উদ্বেগ দেখা দেয় তখন তাকে দ্রুত সহজতর স্বাস্থ্যসেবা আছে এমন স্থানে পাঠানো উচিত। কিন্তু শায়ান জাল দেহনাভির ক্ষেত্রে তা হয়নি। হোটেলে তাকে ফাঁসিতে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
যুক্তরাজ্যে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য নির্ধারিত বাসস্থানগুলো দীর্ঘদিন ধরে বেশ সমালোচিত।
সরকার নির্ধারিত অস্থায়ী বাসস্থানগুলোতে মাসের পর মাস কিংবা বছর পর্যন্ত অবস্থান করত হয় আশ্রয়প্রার্থীদের।
ব্রিটিশ মিডিয়া দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের মতে, বর্তমানে ২৮ হাজারেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থী অস্থায়ী আবাসনগুলোতে বসবাস করছেন। তাদের মধ্যে হাজারো ব্যক্তি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে আছেন।
পড়ুন>>আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডা পাঠাতে আদালতের বাধা, কী করবে যুক্তরাজ্য
আট মাস ধরে একটি ছোট কক্ষ্যে তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানের সাথে বসবাস করেছেন ৩৫ বছর বয়সি কার্লোস। তিনি দ্য ইন্ডিপেনডেন্টকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “কক্ষটির নোংরা পরিবেশে থাকার কারণে আমার বাচ্চাদের প্রচণ্ড কাশি হচ্ছে।”
২০২২ সালের জানুয়ারিতে আশ্রয়প্রার্থীদের বাসস্থানের বিষয়ে বিবিসি পরিচালিত একটি সমীক্ষায়ও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত বাড়ি ও হোটেলগুলোর অস্বাস্থ্যকর অবস্থা উঠে এসেছিল।
এমএইউ/আরআর