ইটালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি এবং আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবদেলমাদজিদ টেবোউনে গত ১৮ জুলাই একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন | সূত্র: পালাজো চিগি (ইতালির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) প্রকাশিত সংবাদ সম্মেলনের স্ক্রিনশট
ইটালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি এবং আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবদেলমাদজিদ টেবোউনে গত ১৮ জুলাই একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন | সূত্র: পালাজো চিগি (ইতালির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) প্রকাশিত সংবাদ সম্মেলনের স্ক্রিনশট

সোমবার আলজেরিয়া সফরে গিয়েছেন ইটালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি৷ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত করার প্রক্রিয়া গত নভেম্বরে শুরু হয়েছিল৷ এই সফরে শক্তি, অভিবাসন এবং ভূমধ্যসাগরে স্থিতিশীলতা সহ একাধিক এজেন্ডা ছিল ইটালির৷ সে সংক্রান্ত চুক্তি সই হলো সফরে৷

রাশিয়া থেকে আসা গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমাতে বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধানে ইউরোপ৷ ইটালি মনে করছে এই পরিস্থিতিতে আলজেরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা গুরুত্বপূর্ণ৷

দ্রাঘির আলজেরিয়া সফর উপলক্ষে দুই দেশের মধ্যে মোট ১৫টি প্রধান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে৷ ইটালির প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্ধারিত দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ বৈঠকগুলির মধ্যে শেষ সফর এটি৷ ২০২১ সালের নভেম্বরে এটি শুরু হয়েছিল৷ 

সোমবার ইটালির প্রধানমন্ত্রী প্রেস বিবৃতিতে বলেন, ‘ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে আলজেরিয়া এবং ইটালির মধ্যে বন্ধুত্ব অপরিহার্য৷’ ইটালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুইগি ডি মাইওসহ মন্ত্রিপরিষদের একাধিক মন্ত্রীও এই সফরে গিয়েছেন৷

দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং সফর

দ্রাঘি জানান, ‘‘আমাদের দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের একটি সিরিজ চলছিল৷ জুলাই মাসের এই বৈঠকটি ছিল শেষ বৈঠক৷’ 

রুশ আগ্রাসনের কারণে দুই দেশের আলোচনার মূল বিষয় ছিল শক্তি এবং গ্যাস৷ রাশিয়াকে ছাপিয়ে আলজেরিয়া এখন ইটালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে৷ দ্রাঘি জানান, সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, সবুজ হাইড্রোজেন সহ একাধিক ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করতে চায় ইটালি৷ ব্যবসায় আরো উন্নতি করতে চান তারা৷ বায়োমেডিকেল শিল্প, ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প এবং কৃষি-শিল্প খাতকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মূল লক্ষ্য হিসাবে উল্লেখ করেন তিনি৷

তার কথায়, ‘‘শক্তি, শিল্প, ব্যবসা সহ একাধিক ক্ষেত্রে ইটালির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার আলজেরিয়া৷ অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, ভূমধ্যসাগরে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও আলজেরিয়ার ভূমিকা জরুরি৷’’

ইউরোপে অভিবাসন

গ্যাস, জ্বালানি ইত্যাদি নিয়ে আলজেরিয়ার সঙ্গে চুক্তি সংবাদ শিরোনামে রয়েছে৷ তবে ২০০৫ সাল থেকে ইটালি এবং আলজেরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন-আলজেরিয়ার মধ্যে অভিবাসন সংক্রান্ত সহযোগিতা নিয়ে চুক্তি হচ্ছে৷

২০০৫ সালে আলজেরিয়ার সঙ্গে ‘অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি’ স্বাক্ষর করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ তারপর ২০১৭ সালের নতুন ‘অংশীদারত্ব অগ্রাধিকার’ নিয়ে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়৷ এর মধ্যে ছিল ভূমধ্যসাগরীয় এবং সাহেল উভয় এলাকার স্থিতিশীলতার দিকে খেয়াল রাখবে আলজেরিয়া৷ এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতার কথা দ্রাঘি উল্লেখ করেছেন বেশ কয়েকবার৷ এমনকি যখন তিনি সরাসরি অভিবাসনের কথা বলেননি, তখনও স্থিতিশীলতার কথা বলেছেন৷

মাদক, অস্ত্র এবং মানব পাচার প্রতিরোধে আলজেরিয়া এবং ইইউ একসঙ্গে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ ‘অংশীদারত্ব অগ্রাধিকার’ চুক্তির মূল অংশ হলো অভিবাসন৷ ইইউ এবং আলজেরিয়া এই বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্যোগ নিয়েছে৷

২০১৭ সালের চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে আলজেরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে অভিবাসন প্রবাহের ফলে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে সম্ভব৷কিন্তু বর্তমান আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে সেগুলি ভালভাবে পরিচালিত না হলে সমস্যা বাড়বে৷ 

পরিস্থিতি নিয়ে অভিবাসন এবং আশ্রয়ের অধিকার নিয়ে নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে আলজেরিয়া এবং ইইউ৷ ইইউ অভিবাসী প্রবাহ পরিচালনায় আলজেরিয়াকে সমর্থন করবে৷ উভয়পক্ষই বলেছে তারা মানবপাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে৷ আশ্রয়ের জন্য যোগ্য নয় এবং কাজ করার জন্য সঠিক কাগজপত্র ছাড়াই যে অভিবাসীরা ইইউতে পৌঁছাবেন, তাদের প্রত্যাবাসন নীতি উন্নত করা হবে৷

‘নিরাপদ, আইনি ও সুশৃঙ্খল অভিবাসন’

ইইউ বলেছে ২০১৯ সালে তারা আলজেরিয়া, মিশর, লিবিয়া, মরক্কো এবং টিউনিশিয়াসহ উত্তর আফ্রিকা জুড়ে ৩৫টি প্রগ্রামের জন্য মোট ৮০৭ মিলিয়ন ইউরো অনুমোদন করেছে৷ এই অঞ্চলটিকে সাব-সাহারান আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা মিশ্র অভিবাসন প্রবাহের উত্স, প্রবেশদ্বার এবং চূড়ান্ত গন্তব্যের একটি এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷

ব্লকের উদ্দেশ্য হল নিরাপদে, আইনি উপায়ে, সুশৃঙ্খলভাবে উত্তর আফ্রিকা থেকে অভিবাসন ব্যবস্থাপনাকে সমর্থন করা৷ মানবাধিকার বজায় রেখে অভিবাসন প্রক্রিয়া যাতে চলে, তা খেয়াল রাখাও ব্লকের ‘বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা’৷

২০২১ সালের নভেম্বরে ইটালির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সের্জো মাতারেল্লা আলজেরিয়া সফরে গিয়েছিলেন৷ সেইসময় আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবদেলমাজিদ টেবোউনের সঙ্গে গ্যাস এবং অভিবাসন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন মাতারেল্লা৷ ইউরোনিউজ তখন রিপোর্ট করেছিল, আলজেরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়৷ তাই পশ্চিমা বিশ্বের অংশীদার প্রয়োজন ছিল তাদের৷ রিপোর্টে বলা হয়েছিল, কোভিড মহামারি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছিল৷

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ইইউ ঘোষণা করে লিবিয়া এবং মিশরের সঙ্গে আলজেরিয়া ‘মানবিক তহবিল’ থেকে ১৮০ লাখ ইউরো পাবে৷ সেই সময়ে ইইউ কমিশনার ফর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট, জানেজ লেনারসিক বলেছিলেন যে ‘‘সংঘাত, অস্থিতিশীলতা বা গৃহহীন হয়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য সে দেশের মানবিক সংস্থাগুলিকে এই সহায়তা দেয়া হবে৷’’

এই তহবিলের মধ্যে ৯০ লাখ ইউরো আলজেরিয়ার জন্য নির্ধারিত ছিল৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ‘এই তহবিলের উদ্দেশ্য হলো সংঘাত এবং যুদ্ধের ফলে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীদের খাদ্য, পুষ্টি, বিশুদ্ধ জল এবং মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি শিক্ষার উন্নতিতে সহায়তা করা৷’

আলজেরিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়ার দিকে

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, আলজেরিয়ায় বেকারত্বের হার বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে৷ আলজেরিয়া সংক্রান্ত নিউজের প্ল্যাটফর্ম আলজেরি ৩৬০এর ২০১৯ সালের মে মাসের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের বেকারত্বের হার ২৬.৯ শতাংশ ছিল৷ আলজেরিয়ার অনেক তরুণ সরকারের সমালোচনা করেছে৷ 

আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে ২০২২ সালে বেকারত্বের হার ১৪.৮৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷ ২০২৪ সালে এটি প্রায় ১৭ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে৷ এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিতে আলজেরীয় তরুণরা আরো বেশি করে যেতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে৷ 

অল্প সংখ্যক আলজেরীয় প্রতি বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইটালির সার্ডিনিয়ার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷ সম্প্রতি ইউরোনিউজের একটি প্রতিবেদনে আলজেরিয়ার ভেঙে পড়া অর্থনীতির কথা বলা হয়েছে৷

বেকারত্ব বাড়তে চলেছে

সংবাদসংস্থা এপি বলছে গত বছরের একই সময়ে (জানুয়ারি-জুলাই) তুলনায় ২০২২ সালে আলজেরিয়া থেকে ইউরোপে আগমন অনেকটাই কমেছে (৪৬ শতাংশ)৷ অভিবাসীরা মূলত যে দেশগুলি থেকে আসেন, তার প্রথম দশটিতেও আলজেরিয়া নেই৷

২০২০ সালে ইটালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান এবং অর্থনীতিবিষক সংবাদপত্র ‘ইল সোলে ২৪ ওরে’তে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, আইভরি কোস্ট, ইরাক, ইরান, বাংলাদেশ, টিউনিশিয়া, নাইজেরিয়া, মালি, গিনি এবং ইউক্রেনের তুলনায় অনেক বেশি অভিবাসী এসেছেন আলজেরিয়া থেকে৷

মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশের মতো, আলজেরিয়াও সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের মুখে৷ রুশ হামলার পর কৃষ্ণসাগরে নিষেধের কারণে ইউক্রেনের শস্য বিশ্ববাজারে পৌঁছাতে পারছে না৷ মারিও দ্রাঘি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছে ইটালি৷ খাবার যাতে পৌঁছাতে হতে পারে তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক পরিশ্রম করছেন তারা৷’’

ইটালি এবং আলজেরিয়ার নেতাদের আশা, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এবং গোটা ইউরোপে সামগ্রিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাম্প্রতিক চুক্তিগুলি বেশ জরুরি৷ দ্রাঘি জানিয়েছেন, ‘‘আমরা এক সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে চাই৷ আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে আমাদের ব্যবসা ভূমধ্যসাগরের ভবিষ্যৎকে সমৃদ্ধ করুক৷’’


আরকেসি/কেএম

 

অন্যান্য প্রতিবেদন