ইউক্রেন থেকে জার্মানিতে আসা ভিনদেশি শিক্ষার্থীরা সবকিছু গুছিয়ে নিতে আরো সময় চান | ছবি: ইমেগো
ইউক্রেন থেকে জার্মানিতে আসা ভিনদেশি শিক্ষার্থীরা সবকিছু গুছিয়ে নিতে আরো সময় চান | ছবি: ইমেগো

জার্মানিতে আসা ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা খুব সহজেই ইউরোপের দেশটিতে দুই বছর থাকার অনুমতি পেতে পারেন৷ তবে, ইউক্রেন থেকে আসা অন্য দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা৷

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনার জন্য ২০১৮ সালে ইউক্রেনের নিপ্রোতে গিয়েছিলেন মার্ভিন৷ সেখানে যাওয়ার পর তার মনে হয়েছিল স্বপ পূরণ হতে চলেছে৷ 

‘‘আমি অনেক খুশি ছিলাম৷ কারণ এটা এমন এক ব্যাপার ছিল যা একসময় অসম্ভব মনে হয়েছিল,’’ ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷  

সিয়েরা লিওনের একটি দরিদ্র পরিবারে বড় হওয়া মার্ভিন ইউক্রেনে যেতে কয়েক বছর ধরে টাকা জমিয়েছিলেন৷ এরপর ভিসা পেতেও এক লম্বা লড়াই করতে হয়েছিল তাকে৷ 

চলতি মাসে তার স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হলে মার্ভিনের সবকিছু এলোমেলা হয়ে যায়৷ নিপ্রো থেকে পালিয়ে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে চলে আসতে বাধ্য হন তিনি৷ 

ইউরোপের এই দেশে তার জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে৷ জার্মানির অভিবাসন ব্যবস্থা ইউক্রেনের নাগরিকরা যত দ্রুত পার হতে পারছেন, সেদেশে থেকে আসা অন্য দেশের মানুষ সেভাবে পারছেন না৷ 

তাদের অনেকের হাতে এখন জার্মানিতে বসবাসের অনুমতি চাওয়ার জন্য মাত্র কয়েক সপ্তাহ সময় বাকি রয়েছে৷  

ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী 

জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংগঠন এইচআরকে জানাচ্ছে, ইউক্রেন থেকে আসা ইউক্রেনীয় বা ইইউ কোনো দেশের নাগরিক নন এমন বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কয়েক হাজার৷ 

ইউক্রেন থেকে আসা সব শরণার্থী একইরকম সুবিধা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে | ছবি: ডিপিএ
ইউক্রেন থেকে আসা সব শরণার্থী একইরকম সুবিধা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে | ছবি: ডিপিএ


ইউক্রেনীয়রা যেসব সুযোগ সুবিধা বার্লিনের কাছ থেকে পাচ্ছেন তা পাচ্ছেন তা এই শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন না বলে মনে করে বিভিন্ন সংস্থা৷ 

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে সামগ্রিকভাবে ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা দ্রুত বসবাসের অনুমতি পাচ্ছেন৷ তাদেরকে কাজ, পড়াশোনা বা সামাজিক সহায়তা নেয়ার সুযোগও দ্রুত দেয়া হচ্ছে৷ এমনকি যারা ইউক্রেনীয় বা ইইউভুক্ত কোনো দেশের নাগরিক নন কিন্তু ইউক্রেনীয় কারো স্বামী, স্ত্রী বা সন্তান বা যাদের ইউক্রেনে শরণার্থীর মর্যাদা ছিল বা সিরিয়া, আফগানিস্তান কিংবা ইরিত্রিয়ার নাগরিক, তারাও এসব সুবিধা পাচ্ছেন৷

এসব দেশের বাইরে ইউক্রেন থেকে আসা অন্যান্য দেশের নাগরিকরা ভিসা ছাড়া আগস্টের শেষ অবধি জার্মানিতে থাকতে পারবেন৷ এরপর তাদের দেশটিতে থাকার জন্য আবেদন করতে হবে৷ 

‘‘জার্মান সরকার সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে যেতে যেতে চাচ্ছে যে যুদ্ধে কে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর কে হবে না তারমধ্যে পার্থক্য তৈরি করে না,’’ বলেন আইন বিষয়ে ইউক্রেনে পড়তে যাওয়া ২৫ বছর বয়সি নাইজেরীয় নাগরিক জেভিয়ার৷ সেখানে মাত্র এক সেমিস্টার পড়েই যুদ্ধের কারণে জার্মানিতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন তিনি৷ 

মার্ভিন মনে করেন, ইউক্রেনীয় বা ইউরোপীয় নন এমন মানুষদের জন্য আলাদা নিয়ম বৈষম্যমূলক ব্যাপার৷ 

‘‘আমি অন্তত জার্মানিতে এমনটা আশা করিনি৷ এটা এমন এক দেশ যেটি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেয়,’’ বলেন তিনি৷ 

তবে, জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশিদের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতির এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ ইইউর শর্ত মানার ফলে অন্য দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় আলাদা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়৷  

শিক্ষার্থীদের কঠিন জীবন 

মার্ভিন এবং জেভিয়ারের মতো ভিনদেশিরা জার্মানিতে শিক্ষার্থী ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন৷ তবে সেই প্রক্রিয়া বেশ জটিল৷ প্রথমে জার্মানির কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ভর্তির আবেদন গৃহীত হতে হবে৷ এরপর তাদের দেখাতে হবে যে ‘ব্লকড একাউন্টে’ তাদের প্রত্যেকের দশ লাখ টাকার মতো রয়েছে যা দিয়ে তারা নিজেদের খরচ চালাতে পারবেন৷ 

জার্মানির অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে জার্মান ভাষা জানতে হয় এবং জার্মান ভাষা যে একজন শিক্ষার্থী জানেন সেটা প্রমাণের জন্য সনদও জমা দিতে হয়৷ 

‘‘এর অর্থ হচ্ছে তৃতীয় দেশের নাগরিকদের সবাইকে সমানভাবে দেখা হচ্ছে,’’ ডয়চে ভেলেকে বলেছে জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ 

কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে এসব শর্ত পূরণ ইউক্রেন থেকে আসা ভিনদেশি অনেক শিক্ষার্থীরক্ষেত্রেই পূরণ করা সম্ভব হবে না৷ 

মার্ভিন ইতোমধ্যে ইংরেজিতে পড়াশোনা করা যায় এরকম কয়েকটি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তির আবেদন করেছেন৷ যদিও সিয়েরা লিওনের আনুষ্ঠানিক ভাষা ইংরেজি, তারপরও তাকে ভাষা জানার প্রমাণ দিতে ২৪ হাজার টাকা খরচ করে আইইএলটিএস পরীক্ষা দিতে হয়েছে৷ 

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নিতে সম্মত হলেও ব্লকড একাউন্টে জমা করার মতো টাকার অভাবের কারণে তিনি জার্মানির ভিসা নাও পেতে পারেন বলে শঙ্কায় রয়েছেন৷ 

‘‘এটা একটা স্বাভাবিক সময় হলে আমি বিষয়টা বুঝতাম৷ কিন্তু এটা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়৷ এখন আমার একমাত্র আশা হচ্ছে একটি স্কলারশিপ,’’ বলেন মার্ভিন৷ 

জার্মানির হামবুর্গ এবং ব্রেমেন শহর অবশ্য ইউক্রেন থেকে আসা ভিনদেশি শিক্ষার্থীদের ছয়মাসের জন্য জার্মানিতে থাকার অনুমতি দিচ্ছে৷ এই সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবেন৷ ফলে ইউক্রেন থেকে আসা অনেক শিক্ষার্থী জার্মানির অন্যান্য শহর থেকে হামবুর্গ এবং ব্রেমেনে চলে যাচ্ছেন ছয়মাস থাকার সুযোগ নিতে৷ তবে, তারা মনে করেন, নতুন করে সবকিছু শুরুর জন্য ছয়মাসও পর্যাপ্ত সময় নয়৷ 

এআই/এফএস

 

অন্যান্য প্রতিবেদন