গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্টিত দোয়েল একাডেমী নামক একটি স্কুল। ছবি: মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ/ইনফোমাইগ্রেন্টস
গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সন্তানদের জন্য প্রতিষ্টিত দোয়েল একাডেমী নামক একটি স্কুল। ছবি: মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ/ইনফোমাইগ্রেন্টস

বছরের পর বছর গ্রিসে বসবাস করার পরও গ্রিক সমাজে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে বেগ পাচ্ছেন ইউরোপের বাইরে থেকে আসা অভিবাসীরা৷ বাংলাদেশি অভিবাসীরা ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছেন এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ ও প্রতিবন্ধকতার কথা৷

২০০০ সাল থেকে গ্রিসে আছেন বাংলাদেশি অভিবাসী আমিনুল মজুমদার৷ নিজ পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এথেন্সের উপকন্ঠে বসবাস করছেন এই উদ্যোক্তা৷ 

দেশটিতে ২২ বছর বসবাসের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “কট্টর অভিবাসন নীতি, নতুন ভাষা, ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক বৈষম্য সহ নানা কারণে গ্রিসে বসবাসরত অ-ইউরোপীয় অভিবাসীদের দেশটির মূল সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে৷ 

তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘মূল সমাজে ইন্টিগ্রেশনে শিশুদের বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন৷ গ্রিসে অভিবাসীদের বৈধতা প্রাপ্তিতে জটিলতা থাকায় অভিবাসীরা তাদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়েও নানা জটিলতায় পড়ের৷ এটি নিঃসন্দেহে বড় প্রতিবন্ধকতাগুলোর একটি৷’’

পড়ুন>>ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী: নর্থ মেসিডোনিয়ায় ৫.৬ শতাংশ বাংলাদেশি

তবে বেশ কিছু অভিবাসীদের সাথে কথা বলে যে প্রশ্নটি বারবার উঠে এসেছে সেটি হচ্ছে গ্রিক ভাষা এবং ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থার বাস্তবতা৷ 

এ ব্যাপারে আমিনুল মজুমদার বলেন, ‘‘যেহেতু অভিবাসীরা একটি বড় সময় ধরে গ্রিক ভাষা রপ্ত করতে পারেন না সে কারণে তারা কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হন৷ তার উপর বৈধতা না থাকায় সঠিক বেতন কাঠামোর সুবিধাও তারা নিতে পারেন না৷’’

কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও শ্রম শোষণ

দীর্ঘদিন ধরে গ্রিসে বসবাসরত আরেক বাংলাদেশি অভিবাসী সাঈদ আহমেদ বলেন, ‘‘আমি তুরস্কে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুদ্র যন্ত্রশিল্পের একজন দক্ষ কারিগর হিসেবে কাজ করেছি৷ কিন্তু গ্রিক ভাষা না জানায় এবং বৈধতা না থাকায় এই খাতে আমি কাজ খুঁজতে পারছি না৷ যার ফলে বাধ্য হয়ে মৌসুমি কৃষি খাতে কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে৷”

পড়ুন>>গ্রিসের কৃষি খামারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের দাসজীবন

তিনি আরও বলেন, “আমরা এখানে কেউই শ্রম আইন সম্পর্কে অবগত নই এবং এমনকি গ্রিক শ্রম আইন অনুযায়ী কী কী সুবিধা রয়েছে সেটিও জানি না৷ আমি মৌসুমে সপ্তাহে ছয়দিন কিংবা সাতদিনও টানা কাজ করি৷ বিনিময়ে যেই পারিশ্রমিক পাই সেটি একজন বৈধ শ্রমিক খণ্ডকালীন কাজ করেই পেতে পারেন৷’’ 

একটি গ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন বাংলাদেশি অভিবাসী। ছবি: মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ/ইনফোমাইগ্রেন্টস
একটি গ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন বাংলাদেশি অভিবাসী। ছবি: মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ/ইনফোমাইগ্রেন্টস


অনিয়মিত ও ‘রেসিডেন্স পারমিট’ নবায়ন করতে গিয়ে সাময়িক অনিয়মিত হয়ে পড়া অভিবাসীদের জন্য গ্রিক হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেওয়া এক প্রকার যুদ্ধের মতো৷ এছাড়া হাসপাতালের ব্যয় ও ঔষধ কিনতে যেই অর্থের প্রয়োজন হয় সেটিও তারা রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে পেতে ব্যর্থ হন৷ 

বর্ণবৈষম্য কতটা প্রকট?

গ্রিসে অভিবাসীরা বর্ণবৈষম্যের শিকার হন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে দেশটির অভিবাসন সংস্থা কেরফার পরিচালক এবং এথেন্স মিউনিসিপ্যালিটির কাউন্সিলর পেট্রোস কনস্টান্টিনো ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “মূল গ্রিক সমাজ থেকে অভিবাসীদের প্রতি এর আগে এত বেশি বৈষম্যের অভিযোগ শোনা না গেলেও বেশ কিছু বছর ধরে কট্টরপন্থার উত্থান ঘটেছে৷ এটি দুঃখজনক৷’’

পড়ুন>> চলতি বছরই গ্রিসে বাংলাদেশি কর্মী নেয়া ও অনিয়মিতদের কাগজ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু

অভিবাসীদের ঠিক কী ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে হয় তার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এক আলবেনীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসী গ্রিসের একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন৷ পড়াশোনার শেষ দিকে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করার জন্য তিনি এথেন্সের হাসপাতালগুলোতে কাজ খুঁজছিলেন৷ কিন্তু গ্রিক জাতীয়তা না থাকায় কোনো হাসপাতালই তাকে গ্রহণ করছিল না৷’’

এথেন্স মিউনিসিপ্যালিটির এই কাউন্সিলর আরও যোগ করেন, “নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ছাত্রী গ্রিক জাতীয়তা পেলেও এবং সাদা বর্ণের হয়েও শুধু ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত না হওয়ায় কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা পেশায় চাকরি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হন৷ ইউরোপে কট্টর পন্থার উত্থানের সাথে সাথে গ্রিক সমাজেও এই বিষবাষ্প ছড়িয়েছে৷’’

রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ

গ্রিক সমাজ ব্যবস্থা বিশেষ করে রাজনীতিতে অভিবাসীদের অংশগ্রহণ কেমন সেটির উত্তরে পেট্রোস কনস্টান্টিনো বলেন, “বাম রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও তারাও ডানপন্থীদের মতো একই পথে হেঁটেছেন৷ উদাহরণস্বরুপ সর্বশেষ অনুষ্ঠিত এথেন্স মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে কোনো দলই অ-ইউরোপীয় অভিবাসীদের কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে মনোয়ন দেয় নি৷’’  

অভিবাসন সংস্থা কেরফার পরিচালক এবং এথেন্স মিউনিসিপ্যালিটির কাউন্সিলর পেট্রোস কনস্টান্টিনো। ছবি: মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ/ইনফোমাইগ্রেন্টস
অভিবাসন সংস্থা কেরফার পরিচালক এবং এথেন্স মিউনিসিপ্যালিটির কাউন্সিলর পেট্রোস কনস্টান্টিনো। ছবি: মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ/ইনফোমাইগ্রেন্টস


তিনি বলেন, “আমাদের ফ্যাসিবাদ ও বর্ণবাদ বিরোধী জোট থেকে প্রথমবারের মতো শ্রমিক সংগঠন ইউনিয়ন ফর মাইগ্রেন্টস ওয়ার্কার্সের চারজন অ-ইউরোপীয় সদস্যকে প্রার্থী করি৷ যদিও তাদের কেউই জিততে পারেন নি কিন্তু এটির মাধ্যমে মূল সমাজকে একটি বার্তা দেয়া গেছে৷’’

পড়ুন>>গ্রিসে বাংলাদেশি মৌসুমি কর্মী নিয়োগের শর্তগুলো সামনে শিথিল হতে পারে

গ্রিসের বর্তমান ক্ষমতাসীন নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অভিবাসীদের ‘ইন্টিগ্রেশন’ প্রক্রিয়া সহজতর করতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে দাবি করেন এই মানবাধিকারকর্মী৷ 

এথেন্সের শহরতলীতে বসবাসরত অনেক অভিবাসী জানান, মূল সমাজের সাথে চলতে না পেরে এক সময় অভিবাসীরা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েন। 

তবে অনেকেই আছেন নিজ উদ্যোগে ভাষা রপ্ত করে মূল গ্রিক সমাজের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন৷ তবে গ্রিক সমাজে যুক্ত করার প্রক্রিয়া বা ইন্টিগ্রেশন ব্যবস্থার প্রয়োগ করা না হলে বেশিরভাগ অভিবাসীরাই মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 


এমএইউ/এফএস 





























 

অন্যান্য প্রতিবেদন