যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন লিজ ট্রুস। ছবি: রয়টার্স।
যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন লিজ ট্রুস। ছবি: রয়টার্স।

যুক্তরাজ্যের রক্ষণশীল দলের প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ের দৌড়ে বরিস জনসনের স্থলাভিষিক্ত হয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন লিজ ট্রুস। নতুন প্রধানমন্ত্রী ইংলিশ চ্যানেলে অভিবাসীদের আগমন রোধ এবং আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্বসূরি বরিস জনসনের কট্টর অভিবাসন নীতি দৃঢ়ভাবে মেনে চলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ফরাসি উপকূল থেকে যুক্তরাজ্যে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় বহিষ্কার প্রক্রিয়ার জনক সদ্য সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পরবর্তী নেতৃত্ব নিশ্চিত হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিব দলের সদস্যরা মঙ্গলবার লিজ ট্রুসকে তাদের পরবর্তী নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মার্গারেট থ্যাচার এবং থেরেসা মে-এর পরে তিনি হতে যাচ্ছেন দেশটির তৃতীয় ডানপন্থি নারী প্রধানমন্ত্রী। 

এ নিয়ে ছয় বছরের মধ্যে যুক্তরাজ্যে চারজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার রেকর্ড গড়লেন। 

পড়ুন>> যুক্তরাজ্যের রুয়ান্ডা পরিকল্পনা: আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আশ্রয়প্রার্থীরা

৪৭ বছর বয়সি নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে ‘একজন প্রকৃত রক্ষণশীলের মতো’ দেশকে শাসন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। 

একটি জটিল আর্থ সামাজিক-প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন রক্ষণশীল দলের নতুন এই নেতা। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যের মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে এবং আসছে শীতে সম্ভাব্য জ্বালানি ব্যয়বৃদ্ধির কারণে অগ্রিম ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ট্রেড ইউনিয়নগুলো। 

তবে, এসব চ্যালেঞ্জ ছাড়াও লিজ ট্রুসের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে চ্যানেলে অনিয়মিত অভিবাসীদের আগমনের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা মোকাবেলা করা। এই বিষয়ে তার পূর্বসূরির অনুসরণ করা কট্টর অভিবাসন নীতি থেকে সরে আসবেন না বলে আগাম ঘোষণা দিয়েছেন লিজ ট্রুস। 

বিতর্কিত রুয়ান্ডা চুক্তির সমর্থক

অনিয়মিতভাবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ব্রিটেন আসা আশ্রয়প্রার্থীদের পাঠাতে জনসন প্রশাসন রুয়ান্ডার সঙ্গে যে চুক্তি করেছে, সেটি সমর্থন করেন ট্রুস৷ শুধু তাই নয়, এ ধরনের চুক্তি আরো দেশের সঙ্গে করার পরিকল্পনা তার৷ সেইসঙ্গে ‘অবৈধ অভিবাসন’ ঠেকাতে যথাযথ আইনি ভিত্তির জন্য একটি ‘শক্তিশালী বিল’ চান তিনি৷

যদিও ইউরোপীয় আদালতের একটি রায়ের পরে বাস্তবিক অর্থে এখনও স্থবির হয়ে আছে আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডা পাঠানোর পরিকল্পনা। 

পড়ুন>>সাজাপ্রাপ্ত অভিবাসীদের নজরদারিতে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তাব

তবে রুয়ান্ডা চুক্তি নিয়ে নতুন এই প্রধানমন্ত্রী যে বেশ আশবাদী সেটি বিগত দিনে তার বিভিন্ন উদ্যোগে ফুটে উঠেছে। অভিবাসন সংস্থা ও এনজিওগুলো গেল গ্রীষ্মের সময় তৎকালীন পররাষ্ট্র লিজ ট্রুসের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশে বিলম্ব করার অভিযোগ এনেছিল। 

এনজিওগুলো জানায়, “তিনি জেনেশুনে মানবাধিকার সম্পর্কিত প্রতিবেদনটি দেরিতে প্রকাশ করেছেন। যাতে করে, এই প্রতিবেদনের ফলে রুয়ান্ডা চুক্তি বাধাগ্রস্ত না হয়।” .

ব্রিটিশ আদালতে চলতি সপ্তাহের সোমবার থেকে বিতর্কিত এই চুক্তি বিরুদ্ধে অভিবাসন সংস্থাগুলোর দায়ের করা আপিল আবেদনের বিচার প্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

উল্লেখ্য, রুয়ান্ডায় বহিষ্কার উদ্যোগের আওতায় প্রথম ফ্লাইটটি চলতি বছরের ১৪ জুন রুয়ান্ডার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের এক জরুরি রায়ে সেটি বাতিল হয়ে যায়। 

পড়ুন>>‘লিবিয়ার পুলিশ আমাদের বাংলাদেশি দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়’

এই বিপত্তির পরে ২২ জুন ব্রিটিশ সংসদে ‘'রাইটস রিমুভাল বিল' নামে একটি বিল পেশ করা হয়েছে, যা মানবাধিকার সম্পর্কিত ইউরোপীয় কনভেনশনকে অমান্য করার অনুমতি দেয়৷

এই আইনটি ব্রিটিশ সরকারকে ইউরোপীয় কোর্ট অফ হিউম্যান রাইটস (ইসিএইচআর) এর যে কোনো ধরনের অন্তর্বর্তী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার অনুমতি দেবে। এটি দোষী সাব্যস্ত বিদেশিদের পারিবারিক জীবনের অধিকারের থেকেও জনসাধারণের নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিবে। যার সাহায্যে ভুক্তভোগী বিদেশিদের বহিষ্কার প্রক্রিয়া সহজ হবে।

ট্রুস জানিয়েছেন, চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ব্রিটেনে আসার প্রবণতা কমানো তার নীতিতে অন্যতম প্রাধান্য পাবে৷ চলতি বছর এমন লোকের সংখ্যা এরই মধ্যে ১৫,০০০ ছাড়িয়েছে৷ 

ব্রিটিশ গণমাধ্যম ডেইলি মেইলকে তিনি বলেন, ‘‘আমার অধীনে ব্রিটেনের সীমান্ত নিরাপদ থাকবে এবং রুয়ান্ডা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে আমি যা করার করবো, সেই সঙ্গে অন্য দেশের সঙ্গে অন্য ব্যবস্থাও নেবো৷’’

'আইনি জালিয়াতি' বন্ধের প্রতিশ্রুতি 

নতুন প্রধানমন্ত্রীর মত একই নীতিতে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান। তিনি ব্রিটিশ সরকারের আইন উপদেষ্টা এবং প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেলের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। 

পড়ুন>>অভিবাসন ইস্যুতে কঠোর ব্রিটেনের দুই প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী

একজন ভারতীয় অভিবাসীর কন্যা থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে উঠা সুয়েলা ব্র্যাভারম্যানও লিজ ট্রুসের ন্যায় শক্ত হাতে চ্যানেলে অনিয়মিত অভিবাসী দমন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। 




প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হয়ে দেওয়া বক্তব্যে তিনি দাবি করেছিলেন, “তিনিই একমাত্র প্রার্থী যিনি ইংরেজ উপকূলে অবতরণকারী অভিবাসীদের ‘ছোট নৌকা’ থামাতে সক্ষম।”

গত মার্চে একটি টেলিভিশন বিতর্কের সময় সুয়েলা ব্রাভারম্যান বলেন, “যুক্তরাজ্যে প্রবেশের চেষ্টাকারীদের লক্ষ্য করে নিরাপত্তা জোরদার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তে নথি জাল করে প্রবেশের চেষ্টা হচ্ছে এবং অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য আইনি কাঠামোকে ফাঁকি দিয়ে অপব্যবহার করা হচ্ছে।”

সার্বিকভাবে যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়ই কট্টর অভিবাসন বিরোধী অবস্থান বজায় রাখবেন বলে ধারণা করছে এনজিওগুলো। 

তবে, চ্যানেল নিয়ে যুক্তরাজ্যের কট্টর অভিবাসন নীতি ‘বুমেরাং’ হয়েছে বলে মনে করছে এনজিও ও অভিবাসন সংস্থাগুলো। ২০২১ সালে চ্যানেল পেরিয়ে আসা অভিবাসীর সংখ্যা ২০২০ সালের থেকে বেশি ছিল। বিবিসি জানিয়েছে, ২০২২ সালের শেষে চ্যানেল পেরিয়ে আসা অভিবাসীর সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

পড়ুন>> শিশু গৃহভৃত্য থেকে অলিম্পিক তারকা মো ফারাহ

বিশেষজ্ঞদের মতে, “এই কট্টর অভিবাসন নীতিটি ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য উভয় দেশের জন্য হিতে বিপরীত হবে৷ যুক্তরাজ্যে যেতে ইচ্ছুক অভিবাসীদের জন্য উত্তর ফ্রান্স অঞ্চল জন্য যতই নরক বানিয়ে ফেলা হোক না কেন, কিছুই পরিবর্তন হবে না৷ আপনি এমন ব্যক্তিদের বাধা দিতে পারেন না যারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এসেছে৷’’


এমএইউ/এআই 








 

অন্যান্য প্রতিবেদন