চলতি বছর টিউনিশিয়া উপকূল থেকে অনিয়মিত উপায়ে যাত্রার হার ১৮ শতাংশ বেড়েছে। ছবি: রয়টার্স
চলতি বছর টিউনিশিয়া উপকূল থেকে অনিয়মিত উপায়ে যাত্রার হার ১৮ শতাংশ বেড়েছে। ছবি: রয়টার্স

টিউনিশিয়া থেকে ইউরোপে অনিয়মিত অভিবাসন বাড়ছে৷ চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১৩ হাজারেরও বেশি অভিবাসী দেশটির উপকূল থেকে ইটালিতে এসেছেন। কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও আর্থসামাজিক কারণে অনিয়মিত পথে অভিবাসন সেখানে পারিবারিক প্রকল্পে পরিণত হয়েছে৷

২০২১ সালের তুলনায় টিউনিশিয়া উপকূল থেকে ইউরোপ অভিমুখে যাত্রার সংখ্যা ১৮ শতাংশ বেড়েছে৷

চলতি বছরের শুরু থেকে ১৩ হাজারেরও বেশি টিউনিশীয় অভিবাসী ইটালির উপকূলে পৌঁছেছেন। ক্রমবর্ধমান মুল্যস্ফীতি এবং অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দেশটির আর্থসামাজিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে৷ এ কারণে দেশত্যাগ করে অভিবাসী হওয়া এখন প্রত্যেক পরিবারের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে৷ 

আরও পড়ুন>>সাত মাসে ইউরোপে অনিয়মিত অভিবাসন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ

এদিকে ইউরোপে থাকা অনিয়মিত টিউনিশীয়দের ফিরিয়ে নিতে দেরি করায় দেশটির উপর চলছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভিসা নিষেধাজ্ঞা৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বিচারে ভিসা নিষেধাজ্ঞায় আতংকিত হয়ে অনেকেই অনিয়মিত অভিবাসনের পথ বেছে নিচ্ছেন৷ 

দৈনিক আয় ২০ দিনার

সম্প্রতি টিউনিশিয়া উপকূল থেকে যাত্রা করে সমুদ্রে নিখোঁজ হওয়া এক ব্যক্তির বাড়িতে থাকা স্বজনদের সাথে কথা বলতে সক্ষম হয় ফ্রান্স২৪ এর সাংবাদিকেরা৷ 

দেশটির উত্তরের বৌহাজলার এই বাড়িতে আত্মীয় আর প্রতিবেশীরা তার খবরের সন্ধানে রয়েছেন৷ সমুদ্রে নিখোঁজ হওয়া আত্মীয়ের লাশের জন্য অপেক্ষা করছেন সবাই৷ নিখোঁজ ব্যক্তি দুই সন্তানের জনক৷ তিনি যেই নৌকাযোগে যাত্রা করেছিলেন সেই নৌকাটির মাত্র অর্ধেক যাত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে৷

পড়ুন>>ইইউর বদলে সাব-সাহারান আফ্রিকায় যাচ্ছে টিউনিশীয়রা

শোবার ঘরে সাজানো জিনিসপত্র দেখিয়ে তার স্ত্রী সাবেহ জানান, “এগুলি সবই তার পোশাক, আমি জানি না আমাদের কী হবে? তিনি ১,৬০০ ইউরোর চুক্তিতে নৌকায় সমুদ্র পার হওয়ার চেষ্টা করেন৷ এই গোপন যাত্রার টাকা সংগ্রহের জন্য আমার স্বামী ঘরের অনেক আসবাবপত্রও বিক্রি করে৷ আমার স্বামী অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য এই ঝুঁকি নেন৷’’

সাবেহ আরও বলেন, ‘‘তিনি (স্বামী) দিনে ২০ দিনার আয় করতেন৷ কিন্তু আজকের দিনে আপনি ২০ দিনার দিয়ে কী করবেন? একবার বাচ্চাদের ডায়াপার আর দুধের প্যাকেট কিনতেই সব টাকা শেষ হয়ে যায়৷ আমার স্বামী একজন দিনমজুর ছিলেন, কখনও কখনও তিনি একটানা কাজ করতেন৷ আবার মাঝে মাঝে তাকে দশ দিন ধরে কাজে ডাকা হতো না, এটা খুবই অনিশ্চিত জীবন৷’

আরও পড়ুন>>টিউনিশিয়া: অভিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে নতুন কেন্দ্র

এই শহরটিতে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ৩২ শতাংশ৷ সেখানে প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই কেউ না কেউ নিয়মিত ইউরোপের দিকে যাত্রা করে৷ 

২২ বছর বয়সি হাজেম নৌকাডুবি থেকে বেঁচে এসেছেন। সমুদ্রে যাত্রার আগে, কোন প্রকার স্থায়ী চাকরি ছাড়াই তিনি টিউনিশিয়ায় দিন পার করছিলেন৷ ইটালিতে চাকরিরত তার এলাকার অন্যান্য যুবকদের দেখে তিনি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইটালিতে পোঁছার চেষ্টা করেন৷ 

তিনি ফ্রান্স২৪কে জানান, “আমরা প্রতিদিন ফেসবুকে দেখছি অল্পবয়সিরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে৷ সারাদিন স্থানীয় ক্যাফেতে তরুণ থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা সবাই এটা নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়৷ এটি এখন আর আশেপাশের যুবকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, প্রায় সব পরিবারে এটি নিয়ে আলোচনা চলছে৷’’

অনিয়মিত সমুদ্র যাত্রার প্রচার, প্রচারণা

মনোবিজ্ঞানী এবং গবেষক ওয়েযল গার্নাউই বলেন, “টিউনিশিয়ার পরিবারগুলিতে অবৈধ অভিবাসন বর্তমানে একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এই বছর প্রায় দুই হাজার অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী এবং ৬০০ প্রাপ্তবয়স্ক নারী ঝুঁকি নিয়ে টিউনিশিয়া ত্যাগ করেন৷’’

পড়ুন>>ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপে অভিবাসন সংকট বৃদ্ধি করবে: ফ্রন্টেক্স

তিনি আরও বলেন, “তারা সেখানে তাদের পরিবারের কাছে যায়, কারণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাদের পরিবারের কোন সদস্য আছে৷ আত্নীয় এবং স্থানীয় কমিউনিটির সাথে যোগাযোগ করে তারা এই সিদ্ধান্ত নেন৷

এই গবেষকের মতে, “সমুদ্রে অনিয়মিত যাত্রা একটি সামাজিক অস্থিরতার ফলাফল৷ এটি এমন সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠে যখন সামাজিক অস্থিরতায় জটিল এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে পালাতে নাগরিকেরা বাধ্য হন৷’’

এই অনিয়মিত অভিবাসন উপর পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে টিউনিশিয়ার উপর ক্রমবর্ধমান সীমাবদ্ধ ভিসা নীতি৷ নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রকৌশলী ফ্রান্স২৪ কে ব্যাখ্যা করেন, ‘‘আমার ফরাসি ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল৷ একটি বিখ্যাত ফরাসি কোম্পানি থেকে নিয়োগ পেয়ে টিউনিশিয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন এবং ক্রমানুসারে সব কাগজপত্র জমা দিয়ে আবেদনের পরেও আমি ভিসা পেতে ব্যর্থ হই৷ আমার ভিসা আবেদন জমা করার সময় ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান হবে এটি আমি একবারও চিন্তা করিনি৷ এটা আমাকে সত্যি হতবাক করে দিয়েছিল৷’’


মূল প্রতিবেদন ফ্রান্স২৪, ইনফোমাইগ্রেন্টস বাংলায় ভাষান্তর মোহাম্মদর আরিফ উল্লাহ।

এমএইউ/এফএস





 

অন্যান্য প্রতিবেদন