দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো ইটালির ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে কট্টর ডানপন্থীরা৷ এই জোটের দলগুলোর অভিবাসনবিরোধী অবস্থানে উদ্বেগে আছেন দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিরা৷
নির্বাচনে জয় পেয়ে ইটালির ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে কট্টর ডানপন্থি দল দ্য ব্রাদার্স অব ইটালি আর তাদের সঙ্গী দ্য লিগ ও ফোরজা ইটালিয়া৷ এই জোট ইটালির পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই অর্জন করেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা৷ আর দেশটির ইতিহাসের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন জর্জিয়া মেলোনি৷
৪৫ বছর বয়সি এই নেত্রী তার নির্বাচনী প্রচারে কখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরোধিতা, কখনও ‘অবাধ অভিবাসন’, কখনওবা এলজিবিটিবিরোধী বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন৷
কে এই মেলোনি?
রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তরুণ বয়সে প্রকাশ্যেই মুসোলিনির সমর্থক ছিলেন মেলোনি৷ ২০১৯ সালে দলের এক র্যালিতে তিনি বলেন, ‘‘আমি জর্জিয়া, আমি একজন নারী, আমি একজন ইটালিয়ান, আমি একজন খ্রিষ্টান৷’’
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার দল মাত্র চার শতাংশ ভোট পায়, যেখানে মেলোনির নেতৃত্বে রোববার ২৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে দলটি৷

ব্রাদার্স অব ইটালির এই নেত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত৷ যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করেন তিনি৷ তবে ইইউ নিয়ে তার অবস্থান বদলেছে বার বার৷ বর্তমানে ইইউর একক মুদ্রা ইউরো থেকে ইটালি বেরিয়ে যাক তা চান না তিনি৷ এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধ ও রাশিয়া ইস্যুতে ইউরোপের অন্য ডানপন্থীদের চেয়ে তার অবস্থান বিপরীত মেরুতে৷ ক্রেমলিনের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ইইউতে ইটালির স্বার্থ বজায় রাখতে রোমের আরো জোরদার অবস্থানও চান তিনি৷
পড়ুন: নির্বাচনে কট্টর ডানের জয়ে যেসব প্রভাব পড়বে ইটালির অভিবাসন নীতিতে
কঠোর অভিবাসনবিরোধী অবস্থান
নির্বাচনী প্রচারে মেলোনি অবাধ অভিবাসন নিয়ে নিজের কঠোর অবস্থান তুলে ধরেছেন৷ ইটালির জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন তিনি৷ ইহুদি বিদ্বেষ আর ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান তার৷
তিনি ও জোটের অন্য নেতা মাত্তেও সালভিনি দুইজনই সীমান্ত কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং ভূমধ্যসাগর হয়ে অভিবাসী নৌকার আগমন ঠেকাতে শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷
নির্বাচনী প্রচারে মেলোনি বলেছেন, তিনি চান ইটালির জলসীমা বা ভূখণ্ডে আসার আগেই অভিবাসীদের বহনকারী নৌকা ফেরত পাঠাক নৌবাহিনী৷
বাংলাদেশিদের ভাবনা
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইটালিতেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বসবাস করেন৷ গত আগস্টে দেশটির সরকার প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছর ইটালিতে ‘অনিয়মিত পথে’ সাড়ে সাত হাজারের বেশি বাংলাদেশি এসেছেন৷ টিউনিশীয় ও মিশরীয়দের পর এই তালিকায় বাংলাদেশিরা তৃতীয় অবস্থানে৷
কট্টর ডানপন্থীরা ক্ষমতায় আসায় এই অভিবাসীদের জন্য এখন নিয়মিত হওয়া বা আশ্রয় পাওয়ার প্রক্রিয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন অনেকে৷
২২ বছর ধরে ইটালিতে বসবাসরত বাংলাদেশের নাহিদ বিন ইউনুস দোভাষী হিসেবে কাজ করেন৷ ইটালির সিসিলিতে অবস্থানরত ইনফোমাইগ্রেন্টসের আরাফাতুল ইসলামকে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে হয়ত অনেকে অনেক আশা নিয়ে আসছেন৷ কিন্তু তাদের সেই আশা হয়ত পূর্ণ হবে না৷ তাদের ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারে, এমন সমস্যা এখন তৈরি হতে পারে৷’’ এছাড়াও নিয়মিত অভিবাসনের ক্ষেত্রেও নতুন নতুন বিধিনিষেধ আরোপের আশঙ্কাও প্রকাশ করেন তিনি৷
সিসিলির দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশি রুবেনা অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা ইটালির একটি এনজিওর সঙ্গে যুক্ত৷ তিনিও মনে করেন রক্ষণাত্মক পারিবারিক ঘরানা থেকে আসা মেলোনি ইটালিকে পেছনের দিকে নিয়ে যাবেন৷ অভিবাসন, এলজিবিটিকিউ অবস্থান নিয়ে ইটালির সরকারের এতদিনের যে উদার অবস্থান ছিল তা হুমকিতে পড়বে৷
গুলজার হোসেন নামের আরেক বাংলাদেশি অবশ্য এতটা হতাশ নন৷ তার মতে, ইটালি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনের বাইরে গিয়ে কাউকে চাইলেই ফেরত পাঠাতে পারবে না সরকার৷ তার মতে, ‘‘ক্ষমতায় আসলেও নতুন জোট বেশিদিন থাকতে পারবে বলে মনে হয় না৷ কেননা দ্য ব্রাদার্স এর আগে কখনও এত জনপ্রিয়তা পায়নি৷ ডানপন্থী সালভিনিও এর আগে ক্ষমতায় এসেছিল ২০১৭ সালে৷ তারা মাত্র দেড় বছর ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল৷ বর্তমান জোটও যত কম ক্ষমতায় থাকবে অভিবাসীদের জন্য তত ভালো হবে৷’’
গুলজার মনে করেন বিদেশিদের কারণে অপরাধ বাড়ছে নির্বাচনে এমন প্রচারণা চালানো হলেও এর কোনো ভিত্তি নেই৷ ‘‘ইটালিতে সবসময়ই অভিবাসীদের সঙ্গে নাগরিকদের বন্ধুসুলভ সমস্যা ছিল৷ কিন্তু নির্বাচনে এই জোট অপপ্রচার চালিয়েছে,’’ বলেন তিনি৷
আরাফাতুল ইসলাম,নাতাশ মেলেরশ/এফএস