(ফাইল ছবি) যুক্তরাজ্যের ডোভার উপকূলে আসা অভিবাসীদের একটি দল। ছবি: রয়টার্স
(ফাইল ছবি) যুক্তরাজ্যের ডোভার উপকূলে আসা অভিবাসীদের একটি দল। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক আশ্রয়প্রার্থী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এমনই তথ্য উঠে এসেছে শুক্রবার প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনে। ঝুঁকির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ভুল বয়স নির্ধারণের কারণে অনেক আশ্রয়প্রার্থীর সাথে প্রাপ্তবয়স্কের মতো আচরণ করা হচ্ছে।

শুক্রবার প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনে গ্রেটার ম্যানচেস্টার ইমিগ্রেশন এইড ইউনিট (জিএমইএইউ) এবং অভিবাসন সংস্থা রিফিউজি কাউন্সিল জানিয়েছে, “ব্রিটেনে আসা অপ্রাপ্তবয়স্ক অনিয়মিত আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই প্রাথমিকভাবে ভুল বয়স নির্ধারণের সিদ্ধান্তের শিকার হচ্ছেন। যার ফলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদেরকে প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে একই কেন্দ্রে রাখা হচ্ছে।”

এমনই একজন আশ্রয়প্রার্থী আফরান* (ছদ্মানাম)। এই কুর্দি কিশোর ইরান থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে এক মাস দীর্ঘ ভ্রমণের পর ২০২২ সালে একটি অস্থায়ী নৌকায় ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে আসেন। যুক্তরাজ্যের ডোভার উপকূলে পৌঁছানোর পর তিনি কর্তৃপক্ষকে জানান তার বয়স ১৭ বছর। কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তার এই বক্তব্য আমলে না নিয়ে তাকে সরাসরি প্রাপ্তবয়স্কের জন্য নির্ধারিত একটি কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। 

এই কেন্দ্রে দুই সপ্তাহ অতিবাহিত করা অবস্থায় কয়েকটি অভিবাসন সংস্থার অব্যাহত চেষ্টার ফলে আফরানকে নাবালক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক স্বীকৃতির পর নিয়ম অনুযায়ী ব্রিটিশ শিশু পরিষেবা দপ্তরের পক্ষ থেকে আফরানের দায়িত্ব নেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন>>চ্যানেলে নৌকা থেকে পড়ে নিখোঁজ তিন অভিবাসী!

আফরানের মতো একই ভাবে কোন প্রকার পরিচয়পত্র ছাড়াই ডোভার উপকূলে এসেছিলেন আরেক আশ্রয়প্রার্থী আহমেদ* (ছদ্মানাম)। 

ব্রিটিশ অভিবাসন কর্মকর্তারা এই আশ্রয়প্রার্থীর বয়স ২৫ বছরের বেশি হিসেবে বিবেচনা করে অন্যান্য প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সাথে একটি হোটেলে স্থানান্তর করে। 

কিন্তু আহমেদের বয়স পুনঃমূল্যায়নের পর অবশেষে তাকে ১৭ বছর বয়সি নাবালক হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ব্রিটিশ অভিবাসন কর্তৃপক্ষ। যার ফলে তাকে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্ধারিত ব্রিটিশ পরিষেবাগুলোতে পাঠানো হয়েছিল।

পড়ুন>>যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী ‘অভিবাসন বিরোধী’ লিজ ট্রুস

গ্রেটার ম্যানচেস্টার ইমিগ্রেশন এইড ইউনিট (জিএমইএইউ) তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, “প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্ধারিত কেন্দ্রগুলোতে তরুণ ও কিশোর আশ্রয়প্রার্থীরা প্রায়ই ‘অপব্যবহার এবং অবহেলার’ শিকার হন।

জিএমইএইউকে সাক্ষাৎকার দেওয়া এক কিশোর বলেন, “একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক আমাকে ধমক দিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন। আমাকে সেই ব্যক্তির সাথে একই ঘরের মেঝেতে ঘুমাতে বাধ্য করা হয়েছিল। আমি তার কাছ থেকে ক্রমাগত হুমকির মধ্যে ছিলাম।”

দ্বিতীয় আরেকজন ভুক্তভোগী এক সাক্ষাৎকারে বেসরকারি অভিবাসন সংস্থা রিফিউজি কাউন্সিলকে বলেন, “আমি সবসময় আমার কক্ষে অবস্থান করি। এখানে আমি কখনও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। আমি সব সময় আতঙ্কে থাকি। বর্তমানে একটি খারাপ পরিস্থিতিতে হোটেলে অবস্থান করছি।”

অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যান

আফরান* এবং আহমেদ* শেষ পর্যন্ত তাদের সঠিক বয়সের স্বীকৃতি পেতে সক্ষম হয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে অভিবাসন সংস্থা ও এনজিওগুলোর উল্লেখযোগ্য সংহতি এবং প্রতিবাদের কারণে। 

তবে, সব ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রেই এটি ঘটে না। এই ধরনের পরিস্থিতির সংখ্যা যুক্তরাজ্যে কম নয়। শরণার্থী কাউন্সিল এবং জিএমইএইউ-এর দুটি প্রতিবেদনে এরকম বেশ কিছু ঘটনা উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন>>ফ্রান্সে অনিয়মিত অভিবাসী পরিবহণের দায়ে এক পাচারকারীর ১৮ মাসের কারাদণ্ড

রিফিউজি কাউন্সিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে আশ্রয়প্রার্থীদের ১৪১টি আবেদন প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। এই আবেদনগুলো বিশদ পরীক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা কর্মীদের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়নি। যাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ কিশোরকে ভুলভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। রিফিউজি কাউন্সিলসহ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে অবগত হওয়ার আগেই তাদেরকে প্রাপ্তবয়স্কদের আবাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। সে সময় তাদেরকে কোন কার্যকরি সহায়তা ও শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়নি।”

প্রায় ৬০টি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যের বরাত দিয়ে একটি মানবাধিকার সংগঠন নিশ্চিত করেছে, ২০২১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় মোট ৪৫০ জন তরুণের বয়স প্রাথমিকভাবে সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেছিল। কিন্তু পুনঃমূল্যায়নের পর তাদের মধ্যে তিন চতুর্থাংশই নাবালক বলে প্রমাণিত হয়েছিল।

এনজিওগুলোর মতে, বয়স মূল্যায়নের বিষয়টি নির্ভুলতার সাথে পরিমাপ করা কঠিন। এ ব্যাপারে সরকার অনেক পরিসংখ্যান প্রকাশ করলেও সেগুলো “অনির্ভরযোগ্য” বলে মনে করেন অভিবাসন সংগঠনগুলো।

পড়ুন>>যুক্তরাজ্যের রুয়ান্ডা পরিকল্পনা: আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আশ্রয়প্রার্থীরা

ব্রিটিশ হোম অফিসের তথ্য অনুসারে, গত পাঁচ বছরে ৬,১৭৭ জন আশ্রয়প্রার্থীর বয়স মূল্যায়নের জন্য আবেদন করা হয়েছে।

কিন্তু এই পরিসংখ্যানে যেসব আশ্রয়প্রার্থী কোন প্রকার পরিচয়পত্র ছাড়াই নিজেদেরকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে ঘোষণা করে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যার ফলে সরকারের প্রতিবেদন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে বলে মনে করছে এনজিওগুলো। 

সংস্কার এবং নিয়ন্ত্রণ

রিফিউজি কাউন্সিলের মতে, “কর্তৃপক্ষ নিজে থেকেই প্রাপ্তবয়স্ক ঘোষণা দেওয়া নাবালকদের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কথা জানিয়েছে। 

যুক্তরাজ্যে অনিয়মিত উপায়ে আসা অভিবাসীদের বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি সংস্কার বাস্তবায়িত হয়েছে।

পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী, একজন আশ্রয়প্রার্থীর বয়স ২৫ বছরের বেশি বলে মনে হলে সেক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিবাসন কর্মকর্তা তাকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচনা করতেন।

কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট আশ্রয়প্রার্থীকে ১৮ বছরের বেশি মনে হলেই তাকে প্রাথমিকভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। নতুন আইনটি অভিবাসন দপ্তরের নিজস্ব সমাজকর্মীদের নিয়ে গঠিত একটি জাতীয় বয়স মূল্যায়ন কাউন্সিল গঠনকেও সমর্থন করে।

অভিবাসন সংস্থাগুলো, প্রাথমিকভাবে শারীরিক গঠন ও চেহারার ভিত্তিতে বয়স নির্ধারণের এই নতুন নীতির সংস্কার দাবি করেছে। 

পড়ূন>>সাজাপ্রাপ্ত অভিবাসীদের নজরদারিতে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তাব

রিফিউজি কাউন্সিল তাদের প্রতিবেদনে, প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে ভুলভাবে চিহ্নিত কিশোরদের সংখ্যা কমাতে আরও বিশদ পরিসংখ্যান প্রকাশের সুপারিশ করেছে। এছাড়া, যাদের বয়স নিয়ে বিতর্ক উঠবে, তাদের জন্য প্রাথমিকভাবে অগ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বাতিল করে সামাজিক কর্মীদের তত্ত্বাবধানে বয়স মূল্যায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে। 

সর্বশেষ সংস্থাটি বয়স নির্ধারণ প্রক্রিয়া স্থায়ীভাবে অফসেড এর মতো নিরপেক্ষ সংগঠনগুলোর উপর ন্যাস্ত করার জন্য সুপারিশ করেছে। কারণ অফেসড দীর্ঘদিন ধরে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে। অতীতেও সংগঠনটি যুক্তরাজ্যে শিশুদের বয়স নির্ধারণ প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। 

অপরদিকে, গ্রেটার ম্যানচেস্টার ইমিগ্রেশন এইড ইউনিট (জিএমইএইউ) গত এক বছরে কেন শত শত শিশুকে ব্রিটিশ হোম অফিস প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে আখ্যা দিয়ে ভুল আচরণ করেছে সেটি নিয়ে বিশদ আইনি তদন্তের দাবি জানিয়েছে। 


*সাক্ষাৎকার প্রদানকারী ব্যক্তিদের অনুরোধে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। 


এমএইউ/আরআর 






 

অন্যান্য প্রতিবেদন