ভূমধ্যসাগরের তীরের যেসব শহর অভিবাসীদের চাপে জর্জরিত থাকে সেসব অঞ্চলে সাধারণত অভিবাসন বিরোধী কিছু মনোভাব তৈরি হয়। কিন্তু দক্ষিণ ইটালির ক্যালাব্রিয়া অঞ্চলের ক্রোটোনে শহরে দেখা গেছে এর বিপরীত চিত্র। অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র হলেও এই শহরের নাগরিকেরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসা অভিবাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার করেন।
ক্রোটোনে (ক্যালাব্রিয়া) থেকে ইনফোমাইগ্রেন্টসের বিশেষ প্রতিনিধি শার্লত ওবেরতি।
ইটালির সুদূর দক্ষিণে অবস্থিত দরিদ্র ক্যালাব্রিয়া অঞ্চলের শহর ক্রোটোনে। এই অঞ্চলের বিভিন্ন উপকূলে নিয়মিত লিবিয়া, তুরস্ক এবং লেবানন থেকে যাত্রা করা অভিবাসী নৌকাগুলো ভীড় করে।
ক্যালাব্রিয়ায় ২৯ সেপ্টেম্বর সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে অভিবাসীরা একটি বিল্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছেন। যেখানে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসা নতুন অভিবাসীদের বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করা হয়। সদ্য ইটালি আসা এসব অভিবাসীদের সকলের পরনে প্রায়ই একই ধরনের পোশাক। দলবেঁধে হাঁটার সময় অনেক অভিবাসী স্পীকারে জোরে গান শুনছেন।
ক্যালাব্রিয়ার ক্রোটোনে শহর থেকে একটু বাইরে অবস্থিত এই কেন্দ্রটির নাম সান্ত'আন্না অভ্যর্থনা কেন্দ্র। এই শিবিরে অনেকটা ছুটির আমেজ লক্ষ্যা করা গেছে। সমুদ্রপথে ইটালিতে আসা নতুন অভিবাসীদের এই কেন্দ্রে রাখা হয়।
বৃহস্পতিবার এই শিবিরে মোট ৫১১ জন সদ্য ইটালি আসা অভিবাসী অবস্থান করেছে। তাদের মধ্যে প্রায় ২০০ জন অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসী।
আরও পড়ুন>>‘বসনিয়া থেকে নিজে নিজেই ম্যাপ দেখে ইটালি চলে এসেছি’
৩৯ বছর বয়সি মাহমুদ আহমাদ সাদ মিশর থেকে এসেছেন। বর্তমানে তিনি এই শিবিরে অবস্থান করেছেন। তিনি শিবিরের সার্বিক পছন্দ নিয়ে বেশ খুশি। তিনি প্রতিদিন ইটালীয় ভাষা শিখতে যান।
মাহমুদ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “ইটালি আসার আগে পাচারকারীরা আমাকে বলেছি ইউরোপে আসার পর আমার সাথে ভালো আচরণ করা হবে না। কিন্তু আমি মনে করি এটি সত্য নয়। আমি এখানে ভালো আছি এবং থাকতে চাই।”

আগস্টের শেষে অন্য ৪৭৫ জন যাত্রী নিয়ে লিবিয়া উপকূল ছেড়ে ক্যালাব্রিয়া এসেছিলেন মাহমুদ। পাঁচ দিন ধরে শুধু খেজুর খেয়ে নৌকায় দিন পার করেছিলেন এই অভিবাসী। মৃত্যু ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ইটালিতে পৌঁছার পরে অন্য সবার মতো তিনিও আনন্দে ফেটে পড়েছিলেন।
২০২২ সালে ইতিমধ্যে সমস্ত ইটালীয় উপকূলে ৭১,০০ এরও বেশি লোক প্রবেশ করেছে। যা ২০২০ সালের একই সময়ের তুলনায় তিনগুণ বেশি। এই বৃদ্ধির ধাক্কা লেগেছে ইটালির দক্ষিণে অবস্থিত ক্যালাব্রিয়া অঞ্চলেও।
আরও পড়ুন>>পাসপোর্টে বয়সের গরমিল: ইটালিতে বিপাকে অনিয়মিত বাংলাদেশিরা
এই অঞ্চলের অভিবাসী নৌকাগুলো আসে মূলত ক্রোটোনে উপকূলে।
প্রায় ৬০ হাজার বাসিন্দার শহর ক্রোটোনে। শহরের নগর কার্যালয়ে মেয়র ভিনসেঞ্জো ভয়েস ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “এই গ্রীষ্মে আমরা প্রায় প্রতিদিনই অভিবাসী নৌকা দেখেছি। কখনও কখনও দিনে দুবারও উপকূলে নৌকা এসেছে।”

এই সাক্ষাৎকারের ঠিক দুই দিন আগেও একটি অভিবাসী নৌকা উপকূলে এসে পৌঁছেছে।
পালতোলা নৌকা এবং বড় মাছ ধরার নৌকা
ক্রোটোনের বন্দরে আসা অভিবাসী নৌকাগুলোকে বেশ কড়া নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে প্রায় পঞ্চাশটি নৌকা আছে। নোঙ্গর করে রাখা বেশিরভাগই পাল তোলা নৌকা এবং কয়েকটি বড় মাছ ধরার নৌকা।
কিছু নৌকায় আরবিতে খোদাই করে লেখা বিভিন্ন চিত্রকর্ম ও শিলালিপি দেখা যাচ্ছে। আবার নৌকার পাল ভঙ্গুর। যা সমুদ্র পারাপারের সময় ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সাক্ষ্য দেয়।
পড়ুন>>নির্বাচনে কট্টর ডানের জয়ে যেসব প্রভাব পড়বে ইটালির অভিবাসন নীতিতে
মাহমুদ আহমাদ সাদের মতো যারা এই নৌকায় চড়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মিশরীয় নাগরিক। যারা লিবিয়ার উপকূল থেকে গড়ে চার থেকে সাত দিনে ইটালিতে এসেছিলেন।

আবার অনেকেই আরও দূর থেকে ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে বিপজ্জনক রুট তুরস্ক বা লেবানন থেকে এসেছেন। এসব দেশ থেকে ইটালি পৌঁছতে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত লাগে।
“অভিবাসীরা লাম্পেদুসা না থেমেই ক্যালাব্রিয়া আসছে”
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অভিবাসীরা গ্রিস এবং বলকান রুটে বেআইনি পুশব্যাকের ব্যাপারে বেশ সচেতন।
এই অঞ্চলের ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) এর সমন্বয়কারী জিওভানি পার্না ব্যাখ্যা করেন, “সম্প্রতি আমরা নৌকায় থাকা লোকজনকে লাম্পেদুসায় না থেমেই চলে যেতে দেখেছি। তারা লাম্পেদুসায় দুর্ব্যবহার এবং দ্বীপের অনেক কেন্দ্র থেকে বের বের হতে না পারার কথা শুনেছে। সে কারণে তারা শুরু থেকেই ক্যালাব্রিয়া উপকূলে নামার উদ্দেশ্যে যাত্রা চালিয়ে যান।”
পড়ুন>>কট্টর ডানপন্থিদের জয়ে ইটালিতে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশিরাও
ইটালীয় রেড ক্রসের প্রধান এবং সান্ত'আন্না অভ্যর্থনা কেন্দ্রের পরিচালক ইগনাজিও ম্যাঙ্গিওনি ব্যাখ্যা করেন, “অনেক সিরীয়, ফিলিস্তিনি বা লেবাননের নাগরিক তুরস্ক বা লেবানন থেকে যাত্রা করে ইটালি আসছেন। তবে তাদের সাথে ঘটনাস্থলে কথা বলা মুশকিল। কারণ ক্যালাব্রিয়ার উপকূলের সান্ত'আন্না অভ্যর্থনা কেন্দ্রের একটি অংশ বন্ধ থাকায় শনাক্তকরণের পর আশ্রয়ের আবেদন করার আগেই অভিবাসীরা দ্রুত উত্তর দিকে চলে যায়। লক্ষ্য জার্মানি, ফ্রান্স বা যুক্তরাজ্য, যেখানে তাদের আত্মীয়রা বসবাস করছেন৷”

এছাড়া, অভিবাসীদের অনেকেই "নিরাপদ" বলে বিবেচিত তৃতীয় দেশগুলি থেকে আসে। সেখানে তাদের বহিষ্কার করা হতে পারে এই ভয়ে তারা আশ্রয় আবেদন জমা করেন না। এটি মিশরীয় অভিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
“কেন্দ্রে খাদ্য বিতরণকারী রয়েছে”
১৯ বছর বয়সি মিশরীয় আলী ২০ দিন ধরে ক্রোটেনে আছেন। তিনি কাজের সন্ধানে দেশ ছেড়ে প্রথমে লিবিয়া আসেন। সেখানে নির্মাণ সাইটে খুঁজে পেলেও শীঘ্রই তিনি লিবিয়ায় আসা নিয়ে অনুশোচনা করতে থাকেন।
তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, “আমি লিবিয়ার শহরত্যাগ করে উপকূলের দিকে চলে যাই। পরে নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলাম। নৌকায় আমার পাশে একটি সিরীয় পরিবার ছিল। তারাও আমার মতো ইটালিতে এসে অত্যন্ত আনন্দিত। আমার সাথে ভাল আচরণ করা হচ্ছে। আশ্রয় কেন্দ্রের খাবার আমাদের পছন্দ। এখানে কফি পান করারও ভেন্ডিং মেশিন আছে।”
৩৬ বছর বয়সি আরেক অভিবাসী খালেদ বলেন, “যখন আমরা ক্রোটোনে শহরের কেন্দ্রস্থলে যাই, লোকেরা আমাদের দেখে হাসে এবং সম্মানজনক আচরণ করে।”
আরও পড়ুন>>ইটালিতে সাংসদ নির্বাচিত অনিয়মিত অভিবাসীদের মুখপাত্র
এই অভিবাসী পেশায় তার দেশে কৃষক ছিলেন। তিনিও মিশরীয় এবং তিন সন্তানের জনক। তিনি ১৪ সেপ্টেম্বর পরিবারের কোন সদস্য ছাড়াই লিবিয়া থেকে নৌকায় এসেছিলেন।
তিনি বলেন, “আশা করি আশ্রয় মর্যাদা পাওয়ার সাথে সাথে যদি একটি কাজ খুঁজে পাই তাহলে আমার সন্তানদের এখানে আনতে সক্ষম হব।”
বেকারত্ব
মিশরীয় অভিবাসী খালেদের জন্য অবশ্য দুঃশ্চিন্তা কিছুই বেশি। শরণার্থী মর্যাদা পেলে পরিবার আনতে তাকে একটি বৈধ কাজ খুঁজে পেতে হবে। অন্যদিকে, ইটালির এই অঞ্চলটি ইউরোপের অন্যতম দরিদ্র একটি এলাকা। ক্রোটোনে বেকারত্বের হার ৬০ শতাংশ।
শহরের মেয়র ভিনসেনজো ভোক বলেন, “এটি একটি বড় সমস্যা।”
অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এই অনুপস্থিতির ফলস্বরূপ, ক্যালাব্রিয়ায় অভিবাসী আগমনের অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও ইটালির অভিবাসীদের মোট সংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ এই অঞ্চলে বাস করে।

ইটালিতে অনুষ্ঠিত ২৫ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলে শহরের মেয়র আরও হতাশ। কট্টর ডানপন্থিরা অভিবাসীদের প্রতি কঠোর হবে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। বর্তমানের তিনি অভিবাসীদের প্রতি সর্বোচ্চ সহানুভূতি দেখাচ্ছেন।
ক্রোটোনে হল ইটালির এমন একটি শহর যেখানে জন্মগ্রহণকারী অভিবাসী সন্তানদের সম্মানসূচক প্রতীকী নাগরিকত্ব প্রদান করে।
পড়ুন>>ছবিঘর: সিসিলিতে বাংলাদেশি কৃষকদের বেতন ভালো, জীবন কঠিন
তিনি বলেন, “তারা মরুভূমি, কারাগারসহ অনেক কিছু অতিক্রম করে এখানে আসে। এখানে তারা তাদের পুরো ভবিষৎ পুনর্নির্মাণ করতে চায়।”
মূল প্রতিবেদন শার্লত ওবেরতি। ইনফোমাইগ্রেন্টস বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ।
এমএইউ/এআই