সিসিলিতে ‘গ্যাংমাস্টার সিস্টেম’ (কাপোরালাতো) দ্বারা অভিবাসী কৃষি শ্রমিকদের শোষণ বন্ধ করার বিষয়টিতে জোর দেয়া হচ্ছে৷ বেশ কয়েকটি প্রচারণার লক্ষ্যই হলো, অভিবাসী কর্মীদের আরও বেশি অধিকার প্রদান এবং জোটবদ্ধ হতে উত্সাহিত করা৷
ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি বছরের ছয় অক্টোবর পর্যন্ত ৭২ হাজারের বেশি অভিবাসী ইতালির উপকূলে, বিশেষ করে সিসিলিতে এসেছেন৷
দক্ষিণ ইটালির হাজার হাজার অভিবাসীদের অধিকাংশই মৌসুমী কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন৷ বসবাসের অনুমতি প্রাথমিকভাবে মাত্র ছয় মাস স্থায়ী হয়, তাই হাজার হাজার অভিবাসীর সঠিক অনুমতিপত্র বা স্থায়ী ঠিকানা থাকে না৷ সেটা থাকলে কাজের অনুমতি এবং একটি উপযুক্ত চুক্তি পেতে পারতেন তারা৷ যে সব অভিজাত কৃষকরা সস্তায় খাদ্য উৎপাদন করতে ইউরোপীয় এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তারা এভাবেই শ্রমিক শোষণ করছেন বলে অভিযোগ৷
ইটালির বৃহত্তম ইউনিয়ন সিজিআইএল এফএলএআই-এর সর্বশেষ সমীক্ষা (২০২০ পর্যন্ত) অনুসারে, ৪৫% এর একটু বেশি সংখ্যক কৃষি শ্রমিক ‘অনিয়মিত’ কাজে নিযুক্ত৷ সংগঠনগুলি প্লাসিডো রিজোটো অবজারভেটরির সঙ্গে কাজ করছে, যারা কৃষি শোষণ এবং সংগঠিত অপরাধের মধ্যে যোগাযোগগুলো পর্যবেক্ষণ করছে৷ ১৯৪৮ সালে সিসিলির এক মাফিয়ার হাতে খুন হন ইটালির ইউনিয়ন সদস্য৷ মৃত সদস্যের নামেই সংগঠনের নামকরণ করা হয়েছে৷
অবজারভেটরি জানিয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, একধরনের ‘অনিয়মিত চুক্তি’ সহ শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে৷ তবে কৃষিখাত ব্যতিক্রম৷ সেখানে এটি শূন্য দশমিক চার শতাংশ বেড়েছে৷

অনিয়মিত চুক্তি কী
ইটালির আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন একাধিক চুক্তিতে কাজ করতে বাধ্য হন শ্রমিকরা৷ যেখানে শ্রমিকদের কম বেতন দেওয়া হয়৷ যত ঘণ্টা শ্রমিকরা কাজ করেন, তত ঘণ্টা চুক্তিতে উল্লেখ থাকে না৷ এর ফলে নিয়োগকর্তাকে রাষ্ট্রের কাছে কর ফাঁকি দেন৷ বাকি পারিশ্রমিক বেআইনিভাবে কিংবা নগদে দেয়া হয়৷অনেক সময় মৌসুমী কর্মীদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়া হয় না৷
‘ছায়া অর্থনীতি ইটালির জিডিপির প্রায় ১১.৯% এর সমান’
ইটালির জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস আইএসটিএটি অনুমান করে, যারা বেআইনিভাবে এবং ‘ছায়া’ অর্থনীতির আওতায় কাজ করে তারা প্রতি বছর প্রায় ২১১ বিলিয়ন ইউরো আয় করে, যা ইটালির জিডিপির প্রায় ১১.৯% এর সমতুল৷
প্লাসিডো রিজোট্টো অবজারভেটরি জানিয়েছে, ক্যালাব্রিয়া এবং পুগলিয়া সহ, অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি হল সিসিলি৷ ২০১৮ এবং ২০২০ সালের মধ্যে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত সিসিলি দ্বীপজুড়ে তথাকথিত ‘গ্যাংমাস্টার’ সিস্টেমের অধীনে শোষণমূলক কাজের ৫৩টি উদাহরণ চিহ্নিত করেছে এই অবজারভেটরি৷ ক্যাম্পোবেল্লো দি মাজারা এবং কাস্তেলভেলত্রানোর জলপাইসমৃদ্ধ অঞ্চলে একাধিক শোষণের ঘটনা ঘটেছে৷ অভিযোগ উঠেছে, দক্ষিণে রাগুসা, মোডিকা, ভিট্টোরিয়া এবং গেলার আশেপাশে কৃষি ‘গ্রিনহাউস’ অঞ্চলে গত ১০ বছর ধরে পুরনো সিমেন্ট কারখানার চারপাশে অনানুষ্ঠানিক শিবির গড়ে উঠেছিল৷
সিসিলির অভিবাসনের বিশেষ অফিসের পরিচালক মিশেলা বোঞ্জোর্নো জানেন, সিসিলির অর্থনীতির একটি বড় অংশ কৃষি এবং মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল৷ তবে একটি সমস্যা রয়েছে৷ তিনি এবং তার দল বিষয়টি সামলাতে কঠোর পরিশ্রম করছেন৷
অভিবাসীদের সঙ্গে কাজ করে এমন গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে, অভিবাসী, কৃষি শ্রমিক এবং ইউনিয়নগুলিকে সঙ্গে নিয়ে তারা কাজ করে৷ বোঞ্জোর্নো বলেন, ‘‘আমাদের কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অভিবাসীদের ইটালির মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করা এবং কর্মীদের শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করা৷ আমাদের সর্বশেষ প্রচারাভিযানে স্কুলে সবচেয়ে তরুণ প্রজন্মদের কথা ভাবা হয়েছে, যাতে সিসিলিয়ানদের নতুন প্রজন্ম এই ‘ইন্টিগ্রেশন’ বুঝে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে৷আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের সমৃদ্ধির জন্য এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ৷’’

প্রচারণা: দিরিত্তি নেগলি ওচি
২০২২ সালের শুরুর দিকে অভিবাসন অফিস ‘দিরিত্তি নেগলি ওচি’ প্রচারণা শুরু করে৷ দিরিত্তির অর্থ ‘অধিকার’ এবং ‘প্রত্যক্ষ’ উভয়ই, তাই শিরোনামের অর্থ হতে পারে ‘তাদের চোখে অধিকার’, কিন্তু এছাড়াও ‘শ্রমিকদের চোখে সরাসরি তাকান’ বলা যেতে পারে, যার মানে তাদের প্রয়োজনীয় অধিকার দিন৷
প্রচারাভিযানের ভিডিওটিতে কৃষির গুরুত্ব এবং ফল ও সবজি বাছাইকারী কর্মীরা কীভাবে সেই সম্পদে অবদান রাখেন তাও দেখানো হয়েছে৷ এই কারণেই এই শ্রমিকদের অধিকার প্রয়োজন৷ ভিডিওটিতে বলা হয়েছে, ‘‘তারা আমাদের অঞ্চলের অর্থনীতির জন্য একটি অপরিহার্য সম্পদ৷’’
বোঞ্জোর্নো বলেন, ‘‘সিসিলিয়ানরা স্বাগত জানাচ্ছে৷ অভিবাসন আমাদের ইতিহাস৷ তাই স্বাগত জানানো আমাদের সংস্কৃতির অংশ৷এই দ্বীপে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ভ্রমণ করেছে এবং তাদের কোনো না কোনো চিহ্ন রেখে গিয়েছে৷ সেগুলি সবই ইতিবাচক৷’’
তার কথায়, ‘‘আমাকে নিশ্চিত করতে হবে, মানুষ যাতে বোঝে অভিবাসীরা সম্পদ, কোনো সমস্যা নয়৷ যখন কেউ কোনো সম্মেলনে অভিবাসন একটি সমস্যা বলতে শুরু করে, তখন আমি আমার চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠব এবং বলব, ‘না, আপনি বোঝেননি, এটা সম্পদ৷’’
কৃষি ‘সময়ের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে’
তিনি স্বীকার করেন, কৃষির পরিস্থিতি সময়ের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে৷ তিনি ব্যাখ্যা করেন, ইটালির কৃষকদের সন্তানরা আর কৃষিখাতে কাজ করতে চায় না, তাই সেই শ্রমের বড়সড় ঘাটতি রয়েছে৷
মৌসুমী শ্রমিকরা এই ঘাটতি পূরণ করছেন৷ এর ফলে পুগলিয়া থেকে ক্যালাব্রিয়া থেকে সিসিলিতে প্রায়ই তারা শোষণকারীদের হাতে পড়েন৷
অভিবাসনের বিশেষ অফিসের পরিচালক মিশেলা বোঞ্জোর্নো বলেন, অভিবাসীদের ‘‘এমন একজনের জন্য কাজ করতে বাধ্য হয় যিনি কেবল তাদের কাজের নিশ্চয়তা দেবেন এমন না৷ কম বেতনে থাকার জায়গা এবং খাবারের নিশ্চয়তাও চান অভিবাসী কৃষিশ্রমিকরা৷ সেই জিনিসগুলি সরবরাহ করার জন্য কর্মীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে এখানে দ্বিগুণ শোষণ চলছে৷’’
তিনি জানান, সম্প্রতি সিরাকুসা এলাকার ক্যাসিবিলে আগস্ট মাসে আলু এবং তরমুজ কাটতে এসেছিলেন অভিবাসীরা৷ ক্যাম্পোবেল্লো দি মাজারায় পরিস্থিতি ছিল অমানবিক৷ সেখানে কোনও পরিষেবা নেই, বিদ্যুৎ নেই, বিশুদ্ধ পানি পর্যন্ত ছিল না৷ সেই অঞ্চলে আগস্ট মাসে ফসল কাটা হয়েছিল৷ ছায়াতেও যেখানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি৷

চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের জন্য হস্টেল
সিসিলিয়ান অঞ্চল সিরাকুসা প্রিফেকচার এবং স্থানীয় পৌরসভার সঙ্গে একটি হস্টেল তৈরি করা হয়েছে৷ বিদ্যুৎ এবং নিয়মিত পানি সরবরাহ রয়েছে তাতে৷ প্রি-ফেব্রিকেটেড কেবিনে নিয়মিত চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের সুবিধা রয়েছে৷
বোঞ্জোর্নো বলেন, ‘‘এটি আমাদের প্রকল্পের সীমাবদ্ধতা৷ আমরা শোষণকে বাতিল করতে চাই তাই চুক্তিপত্র আছে এমন শ্রমিক নিয়োগ করতে চাই৷ তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যাদের যথাযথ চুক্তি নেই, তারাই শোষিত হন৷ তাই বিষয়টা কঠিন৷’’
প্রকল্পটিকে ইটালির শ্রম মন্ত্রণালয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিবাচকভাবে দেখেছে৷ দক্ষিণ সিসিলিজুড়ে একইরকম ‘হস্টেল’ তৈরি হচ্ছে৷ ইটালির উত্তরাঞ্চলের কিছু হস্টেলও এই ব্যবস্থা চাইছে৷এ পর্যন্ত, তারা জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার সহায়তায় প্রায় ৩০০ জনের জন্য জায়গাসহ কেবিন তৈরি করেছে৷
‘ইন্টিগ্রেশন’ চাবিকাঠি
এই নতুন প্রকল্পগুলির জন্য অর্থপ্রদানের কিছু অংশ ইটালিয়ান ন্যাশনাল রিকভারি অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ফান্ড (পিএনআরআর) থেকে আসে৷
বোঞ্জোর্নো খুশি যে শীঘ্রই মৌসুমী কর্মীদের জন্য আরো ভাল আবাসন তৈরি করা হবে৷ তার কথায়, ‘‘আবাসন ব্যবস্থা আমাদের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা৷ মৌসুমী কর্মীদের উপযুক্ত আবাসন খুঁজে বের করতে হবে, কিন্তু যারা দীর্ঘ সময় ধরে থাকেন, তাদের ইন্টিগ্রেশন প্রকল্পে অংশ নিতে হবে৷ ’’
সিসিলির পশ্চিমে একটি সাম্প্রতিক সম্মেলনে, পৌরসভাগুলি এমন পরিকল্পনা পেশ করেছে যেখানে পুরোপুরি ফাঁকা গ্রামগুলিতে এই অঞ্চলের অভিবাসী পরিবারগুলি কাজের জন্য থাকতে পারেন৷ তাদের জন্য নতুন বাস রুট চালু করা হবে৷ এই পরিবারগুলির জন্য এবং অঞ্চলগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একটি সম্পূর্ণ অবকাঠামোর পরিকল্পনা করা হয়েছে৷ স্থানীয় আঞ্চলিক সংবাদপত্র টিপি২৪ অনুসারে, এই পরিকল্পনাগুলি কয়েক বছর সময় নিতে পারে এবং অনুমান করা হয় কমপক্ষে ২৫.৫ কোটি টাকা খরচ হবে৷
ইটালিতে বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া বিদেশি নাগরিকদের এই অঞ্চলে থাকতে দেয়া নিয়ে প্রকল্পের ভাবনাও রয়েছে তার৷ সাবেক কৃষি কর্মীদের কৃষি উদ্যোক্তা হিসাবে পরিণত করতে চান তিনি, যাতে তারা নিজের ব্যবসা শুরু করতে পারে৷ এই অঞ্চলে সাবেক অভিবাসী শ্রমিকদের দ্বারা পরিচালিত সাতটি নতুন ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া চলছে৷
শোষণ বন্ধ করা
বোঞ্জোর্নো স্বীকার করেন, শোষণ বন্ধ করা কঠিন৷ পালেরমো একটি বিশাল অঞ্চল৷এখানকার পরিদর্শকদের শুধু কৃষি নয়, সব ধরনের ব্যবসা নিয়ে ভাবতে হবে৷’’
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং প্রণোদনা
এই অঞ্চলটি কৃষিখাতে ব্যবসার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্ল্যাটফর্মের (আইএনপিএস) কথা বলছে৷ নেটওয়ার্ক তৈরি করে একসঙ্গে কাজ করার প্রস্তাবও দিয়েছে বোঞ্জোর্নো ও তার দল৷ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে চান তারা৷ ফলে নেটওয়ার্কে সাইন আপ করার জন্য মালিককে প্রমাণ দিতে হবে কর্মীদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে৷ শ্রমিকরা চুক্তিবদ্ধ এবং উচ্চমানের খাবার তৈরির প্রতিশ্রুতি দিতে হবে৷
গত বছর যখন তিনি দায়িত্ব নেন, এই ধরনের নেটওয়ার্ক ছিল মাত্র দুটি৷ বর্তমানে তা আটটি, নবমটিরও উদ্বোধন সামনেই৷ তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ন্যায্য বাণিজ্য এবং গুণমান যাচাই করতে একটি স্ট্যাম্পও তৈরি করছেন তারা৷
বোঞ্জোর্নো আশা করছেন এই অঞ্চলটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে থাকা শ্রমিকরা উপযুক্ত চুক্তি এবং বসবাসের অনুমতি পেতে পারেন৷ অনুবাদক এবং সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতাকারীদের সাহায্য করা হচ্ছে, আইনি পদক্ষেপেও সহায়তা করা হচ্ছে৷
তিনি বলেন, ‘‘আমার স্বপ্ন একদিন ইটালি নিজে এই দেশে পৌঁছাতে অভিবাসীদের সাহায্য করবে৷ ভাষা শেখাতে, দক্ষভাবে কাজ শেখাতে এবং বাকি ইউরোপের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী সরবরাহ করবে এই দেশ৷’’
আরকেসি (এমা ওয়ালিস)