রোমানিয়ায় বৈধভাবে আসার পর অনেক বাংলাদেশিই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যদেশে যাওয়ার অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছেন৷ ছবি: পিকচার অ্যালায়েন্স
রোমানিয়ায় বৈধভাবে আসার পর অনেক বাংলাদেশিই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যদেশে যাওয়ার অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছেন৷ ছবি: পিকচার অ্যালায়েন্স

বাংলাদেশ সরকারের নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসা নিয়ে রোমানিয়ায় এসেও অনেক কর্মী বাধ্য হচ্ছেন অবৈধ পন্থা বেছে নিতে৷ সম্প্রতি রোমানিয়া থেকে অনিয়মিত পথে ইউরোপের অন্যান্য দেশে আসা কয়েকজন অভিবাসীর সঙ্গে কথা হয়েছে ইনফোমাইগ্রেন্টসের৷

বাংলাদেশে রোমানিয়ার দূতাবাস না থাকায় ভিসা দেয়া হয় ভারতের রাজধানী দিল্লির দূতাবাস থেকে৷ তবে বর্তমানে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে রোমানিয়া যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়ে চলায় মাঝেমধ্যে দিল্লি দূতাবাসের প্রতিনিধি ঢাকায় এসে ভিসা দেয়ার ব্যবস্থা করেন৷

বিভিন্ন কাজে এক থেকে দুই বছরের কাজের চুক্তি হলেও শুরুতে কর্মীদের দেয়া হয় তিন মাসের ভিসা৷ রোমানিয়া আসার পর কোম্পানির চুক্তিপত্রসহ বেশ কিছু কাগজ জমা দিয়ে সাময়িক বসবাসের অনুমতি বা টিআরসি এর জন্য আবেদন করতে হয়৷

বৈধ থেকে অবৈধ

কিন্তু অনেক অভিবাসীই কাগজপত্রের অভাবে সময়মতো টিআরসি না পাওয়ায় বাধ্য হচ্ছেন অন্য পথ বেছে নিতে৷

এই মুহূর্তে রোমানিয়াতে ইলেকট্রিশিয়ান হিসাবে কাজ করছেন আহমেদ (ছদ্মনাম)৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রত্যেকেই সাত-আট লাখ টাকা খরচ করে এসেছি৷ এত টাকা খরচ করে এসে তো কেউ ফেরত যেতে চায় না৷ কারো ধার আছে, কারো ব্যাংকে লোন আছে৷ আমাদের আসলে দেশে ফিরে যাওয়ার মতো কোনো অবস্থা নাই৷ আমাদের এত টাকাও নাই যে দেশ থেকে টাকা এনে গেম মারবো৷ আমরা এসেছিলাম এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য৷ কিন্তু যে পরিস্থিতি এখানে তৈরি করা হয়েছে, মনে হচ্ছে তারাই চায় না আমরা এখানে থাকি৷ বারবার শুধু বলা হয় যে বাংলাদেশিরা গেম মারে৷ কিন্তু কেন গেমের দিকে তারা যায়, এটা কেউ দেখে না৷’’

আরেক অভিবাসী রাকিব (ছদ্মনাম)৷ রোমানিয়ায় আসার পর থেকে বেশ কয়েকবার তিনি যোগাযোগ করেছেন প্রতিবেদকের সঙ্গে৷ নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজের কথা বলে রোমানিয়া এনে তাকে দিয়েও করানো হতো সব ধরনের কাজ৷ এর ফলে একসময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন৷

জুলাই মাসে প্রতিবেদককে পাঠানো ফেসবুক ম্যাসেজে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমার রোমানিয়া আসতে ছয় লাখের বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে৷ টাকাগুলো তোলাই এখন প্রথম লক্ষ্য৷ টাকাটা তুলতে পারলেই আমি দেশে ফেরত চলে যাবো৷ গেম মারার কোনো ইচ্ছা আমার নেই৷’’

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হলেও ইউরোপের ভিসামুক্ত চলাচল ব্যবস্থা শেঙ্গেন অঞ্চলে নেই রোমানিয়া৷ শেঙ্গেনের বাইরে থেকে শেঙ্গেনভুক্ত দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করার নাম অভিবাসীরা দিয়েছেন ‘গেম’৷

রাকিবের ইচ্ছা ছিল, যে কোম্পানিতে তিনি কাজ করছেন, তাদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে দোকান বা রেস্টুরেন্টের মতো অন্য কোনো কাজে যোগ দিয়ে রোমানিয়াতেই বৈধভাবে কাজ করা৷ কিন্তু তার কোম্পানি তাকে সে ছাড়পত্র তো দেয়ইনি, ব্যবস্থা করে দেয়নি টিআরসিও৷ ২২ অক্টোবর তার ভিসার মেয়াদ শেষ হলে তিনি রোমানিয়াতে ‘অনিয়মিত’ অভিবাসীতে পরিণত হন৷

অক্টোবরে প্রতিবেদকের সঙ্গে আবার যোগাযোগ হলে রাকিব বলেন, ‘‘আমাকে আরেকটা ফ্যাক্টরিতে কাজ দিয়েছিল, কিন্তু সেটার কোনো পারমিট ছিল না, তারা ছিল অবৈধ৷ আমি বারবার তাদের টিআরসি ম্যানেজ করে দেয়ার অনুরোধ করলেও তারা বলতো, তোমার তো ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষ৷ এখন আর কিছু হবে না৷ দূতাবাসে যেয়ে কী বলবো? সাত লাখ টাকা খরচ করে আসছি৷ দেশে ফেরত চলে গেলে সব শেষ৷’’

এক পর্যায়ে দেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও অনেক টাকা ধারদেনা এবং আত্মীয়-স্বজনের কথা শোনার ভয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন গেম মারার৷ অবশেষে রোমানিয়া থেকে দালালের মাধ্যমে গেম মেরে অক্টোবরে তিনি পৌঁছান ইটালি৷

রাকিবের মতো অনেকেই পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে অনিয়মিত পথে ইটালি বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য কোনো দেশে এরই মধ্যে চলে গিয়েছেন বা যাওয়ার পথে রয়েছেন৷

বুখারেস্টে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দাউদ আলীর মতে যেকোন অভিবাসীকে নিয়োগের আগে দূতাবাসের অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো৷ ছবি: ব্যক্তিগত
বুখারেস্টে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দাউদ আলীর মতে যেকোন অভিবাসীকে নিয়োগের আগে দূতাবাসের অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো৷ ছবি: ব্যক্তিগত

অধিকাংশ অভিবাসীই থাকতে চান না রোমানিয়া

রোমানিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দাউদ আলী জানান, দিল্লিতে অবস্থিত রোমানিয়া দূতাবাস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু চলতি বছর সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত ভিসা দেয়া হয়েছে সাত হাজার ১৫২ জন বাংলাদেশিকে৷

কিন্তু ১৬ আগস্ট রোমানিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইনফোমাইগ্রেন্টকে জানিয়েছে, বর্তমানে সেখানে ১,৬৭৬ জন বাংলাদেশি বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি নিয়ে আছেন৷ তাদের মধ্যে ১৫০৬ জনের চাকরি রয়েছে৷

অভিবাসীদের বাধ্য করা হচ্ছে অন্য দেশে চলে যেতে, এমন অভিযোগ মানতে নারাজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত৷ তবে অনেক ক্ষেত্রে অভিবাসী কর্মীরা পরিস্থিতির শিকার হন বলে জানান তিনি৷ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তিনি বলেন, ‘‘এখানে যেসব কোম্পানি সাপ্লাই কোম্পানি হিসাবে কাজ করছে, তার অধিকাংশই বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বাংলাদেশি৷ তারা এখানে এসে নামমাত্র কোম্পানি খুলে৷ তারাই এসব কাজ বেশি করছে৷ এর বাইরে গুটিকয়েক রোমানিয়ান কোম্পানিও সাপ্লাই কোম্পানি হিসাবে কাজ করে৷ এর কারণ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনলে তারা তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিতে পারে৷’’

রাষ্ট্রদূত জানান, নতুন ওয়ার্ক পারমিট করাতে গেলে আগের কোম্পানির অনাপত্তিপত্র বা এনওসি প্রয়োজন হয়, সেটি বেশিরভাগ কোম্পানিই দিতে চায় না৷ কারণ এর ফলে পরবর্তীতে বিদেশি শ্রমিক আনার অনুমতি পেতে তাদের সমস্যা হতে পারে৷ ফলে এনওসি না থাকায় কাজও পরিবর্তন করতে পারেন না শ্রমিকেরা৷ তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের জটিলতায় পড়ে শ্রমিকেরা এক সময় ভিন্ন পথ বেছে নেয়৷’’

কোম্পানির কাছে শ্রমিকদের পারমিট এবং টিআরসির জন্য এতটা নির্ভরশীলতা তৈরি করার ব্যবস্থাকে অনেক অভিবাসীই তুলনা করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চালু থাকা ‘আকামা’ এবং ‘কফিলের’ সঙ্গে৷

তবে অনেক অভিবাসী রোমানিয়াকে তুলনামূলক কম খরচে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যাওয়ার নতুন রুট হিসাবে কাজে লাগাচ্ছেন, রয়েছে এমন অভিযোগও৷

বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সি এশিয়া কন্টিনেন্টাল গ্রুপের ব্যবস্থাপক আব্দুস সালাম অভিযোগ করেন, অনেক অভিবাসী রোমানিয়া যান গেম মারার চিন্তা মাথায় রেখেই৷ উদাহরণস্বরূপ তিনি তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রোমানিয়ার কনস্টানটা বন্দরে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর কথা বলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘একটা কোম্পানিতে আমাদের ওয়ার্কার ছিল ৫১ জন, এর মধ্যে ১৪ জন পালিয়ে গেছে৷ এদের জন্য জনপ্রতি আমাদের পাঁচ হাজার ডলার করে জরিমানা দিতে হয়েছে৷ কিন্তু বাকি যে ৩৭ জন রয়েছে, তারা নিজেরাও ভালো আছে, কোম্পানিও তাদের ওপর খুশি৷’’

পড়ুন: কেন রোমানিয়া ছাড়তে চান বাংলাদেশিরা?

গ্রেপ্তার, আটক, ফেরত

রোমানিয়ার সঙ্গে হাঙ্গেরি সীমান্ত দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের চেষ্টা করেন বেশিরভাগ অভিবাসী৷ সীমান্তের তিমিসোয়ারা শহর পরিণত হয়েছে অভিবাসীদের হটস্পটে৷ রক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানাভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার কর্মকাণ্ডকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি দালাল চক্র৷

হাঙ্গেরির ডানপন্থি সরকার গত কয়েক বছর ধরেই অবৈধ পথে অভিবাসন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ দেশটির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানের সরকারের গ্রহণ করা বেশ কিছু পদক্ষেপ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমালোচনার মুখে পড়েছে৷

অনিয়মিত উপায়ে হাঙ্গেরিতে প্রবেশের চেষ্টাকালে বাংলাদেশিসহ ৮২ জন দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীকে গত মাসে আটক করে রোমানিয়ার সীমান্ত পুলিশ। ছবি: রোমানিয়া সীমান্ত পুলিশ
অনিয়মিত উপায়ে হাঙ্গেরিতে প্রবেশের চেষ্টাকালে বাংলাদেশিসহ ৮২ জন দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীকে গত মাসে আটক করে রোমানিয়ার সীমান্ত পুলিশ। ছবি: রোমানিয়া সীমান্ত পুলিশ

অনিয়মিত পথে হাঙ্গেরি সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে অনিয়মিত পথে শেঙ্গেন অঞ্চলে ঢোকার চেষ্টার সময় তিন হাজার ৮৮৮ জন অভিবাসীকে আটক করেছে রোমানিয়া পুলিশ৷ তাদের মধ্যে বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসী রয়েছেন৷৷

আগস্টেই বৈধভাবে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে রোমানিয়া আসা তিন শ্রমিককে শেঙ্গেনে প্রবেশের চেষ্টার সময় আটক করে বহিষ্কার এবং দেশে ফেরত পাঠায় রোমানিয়া সরকার৷ রোমানিয়ায় প্রবেশে পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয় তাদের বিরুদ্ধে৷

বন্ধ হতে পারে রোমানিয়ার শ্রমবাজার

পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধের আশঙ্কা করছেন অনেকে৷ রোমানিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত দাউদ আলী জানান, এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে রোমানিয়া সরকার৷

ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তিনি বলেন, ‘‘আমাকে বিভিন্ন কর্নার থেকে বলা হচ্ছে, তোমাদের এত ভিসা দিচ্ছি কিন্তু তোমাদের লোকজন তো থাকছে না৷ ফেল এটা কন্টিনিউ করলে হয়তো একসময় বাংলাদেশিদের ভিসা দেয়ার সংখ্যা কমে যাবে বা একসময় বন্ধও হয়ে যেতে পারে৷’’

রোমানিয়ায় যে কোম্পানিতে কর্মীদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, সেগুলো যাচাইয়ের দায়িত্ব অনেকক্ষেত্রেই দূতাবাসের কাছে দেয়া হয় না৷ রাষ্ট্রদূত জানান, কোনো কোম্পানিতে ২৫ জনের কম কর্মী নিয়োগ দিলে দূতাবাসের অনুমতি প্রয়োজন হয় না৷ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি ৫০ জন লোক নিয়োগ দিলেও কাগজে-কলমে ২৫ জনের কম কর্মী নিয়োগ দেখিয়ে যাচাইবাছাইয়ের এড়িয়ে যায়৷ একজন লোককে নিয়োগ দিতেও দূতাবাসের অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতার নিয়ম করলে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হতে পারতো বলে মনে করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত৷

পড়ুন: বৈধ পথে এসেও রোমানিয়ায় প্রতারণার শিকার বাংলাদেশি শ্রমিকেরা (প্রথম পর্ব)

 

অন্যান্য প্রতিবেদন