প্যারিসের শহরতলিতে একটি সেতুর নিচে বসবাস করছেন প্রায় ২০০ জন অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসী। অভিবাসন সংস্থা ইতুপিয়া৫৬ এর সহায়তায় তাঁবুতে ঘুমানো এসব কিশোর ও তরুণ অভিবাসীরা ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছেন দুর্দশার গল্প।
বেশ কিছুদিন ধরে প্যারিসের শহরতলীতে একটি সেতুর নীচে স্থাপিত একটি অস্থায়ী শিবিরে বসবাস করছেন প্রায় ২০০ অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক। ফরাসি কর্তৃপক্ষ তাদেরকে আপাতত কোনো সহায়তা না দিলেও এগিয়ে এসেছে আলোচিত অভিবাসন সংস্থা ইতুপিয়া৫৬।
প্যারিসের অদূরের শহরতলি ৯৪ ডিপার্টমেন্টের ইভরি সুর সেইন নামক এলাকার এই সেতুর নীচে তিল ধারণের জায়গা নেই।

জুন মাস থেকে এখানে অবস্থান করছে অনিয়মিত অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীরা। এখানে আর নতুন করে তাঁবু টাঙানোর সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে সেতু পেরিয়ে তাঁবুর অনেক অংশ বাইরে চলে গেছে। বৃষ্টি শুরু হলে পানি জমতে শুরু করে সেতুর বাইরের অংশে। বাড়তে থাকে অনিয়মিত তরুণ অভিবাসীদের কষ্ট।
১৬ বছর বয়সি মনা সর্দি, কাশিতে অসুস্থ। সাবধানে গাছের নিচে থুতু ফেলতে চলে যান এই অভিবাসী। বাইরের আবহাওয়ার সংস্পর্শে তার তাঁবু অনেকটা স্যাঁতসেঁতে।
তাঁবুর ভেতরে শুধুমাত্র একটি গোলাপী কম্বল। ক্যামেরুন থেকে আসা এই তরুণ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “আবহাওয়ার কারণে তাঁবুর মেঝে কখনই শুকায় না। আমি এভাবেই ঘুমাই। এই কম্বলটি ছাড়া রাতে শীত থেকে বাঁচার জন্য কিছুই নেই।

কয়েক মাস ধরে অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্কদের এই অস্থায়ী শিবিরটি মূলত স্থানীয় বাসিন্দাদের দৃষ্টির বাইরে বেড়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে মাত্র কয়েকজন শরীর চর্চারত লোক, সাইকেল চালক কিংবা দ্রুতগতির স্কুটার শিবিরের পাশ দিয়ে যায়। শিবিরটি একটি সাইকেল পাথ এবং একটি দ্রুত গতির গাড়ির লেন দিয়ে দুটি ভাগে বিভক্ত।
“মাথাব্যথায় রাতে ঘুমাতে পারি না”
মনার মতো এই শিবিরের বেশিরভাগ বাসিন্দাই তরুণ আফ্রিকান এবং আফগান নাগরিক। তাদেরকে ফরাসি প্রশাসন দ্রুত মূল্যায়নের পরে ফ্রান্সে নাবালক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি।
তাদের সবাই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি আপিল দায়ের করেছে এবং কিশোর আদালতের বিচারকের কাছে শুনানিতে উপস্থিত হতে অপেক্ষা করছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে নাবালক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ব্যর্থ হওয়াদের আপিলের ইতিবাচক রায় আসা পর্যন্ত কোন প্রকার সরকারি সহায়তা প্রদান করা হয় না।
সাধারনত ফ্রান্সে অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্কদের দায়িত্ব সামাজিক সহায়তা দপ্তর (এএসই) এর আওতায় থাকে। কিন্তু এএসই থেকে সকল প্রকার সুবিধা নিতে হলে একজন বিদেশি তরুণকে নাবালক স্বীকৃতি পেতে হবে।
অস্থায়ী এই শিবিরটি এ৪ নামক হাইওয়ের পাশে অবস্থিত। প্রতি রাতেই এই সেতুর নীচে তীব্রগতিতে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রতিধ্বনিত হয় গাড়ির উচ্চ শব্দ।
১৬ বছর বয়সি আরেক কিশোর ইব্রাহিম বলেন, “আমি আমার হাত দিয়ে কান ঢেকে রাখি, কিন্তু এটা সত্যি, আমি একদম ঘুমাতে পারিনা। আমার মাথাব্যথা আছে।”
আইভরি কোস্ট থেকে আসা এই তরুণ প্রতিদিন সকালে স্কুলে যায়। কিন্তু তার শিক্ষক বা সহপাঠীরা জানেন না তিনি প্রতিদিন কোন অবস্থায় ঘুমান।

ইব্রাহিম ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “আমার মা জানলে ঘুমাতেন না। আপাতত এটা কেউ জানে না। শুধু আমার স্কুলের সমাজকর্মীই জানে।"
অন্যান্য তরুণদের মতো ইব্রাহিমের আপিল প্রক্রিয়াও চলমান। তবে জটিল প্রশাসনিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও, তিনি এখানে বিরল অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্যতম যিনি আপিল চলা অবস্থায়ও পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
অ্যাসোসিয়েশন ফর সলিডারিটি উইথ আনকমপ্যানিয়েড ফরেন মাইনরস (এএসএমআইই) এর সহায়তায় প্যারিসের ১৯তম অ্যারোন্ডিসমেন্টে অবস্থিত হেক্টর গুইমার ট্রেডস হাইস্কুল তাকে এই অঞ্চলে সদ্য আগত শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত এই ক্লাসে ভর্তি করতে সম্মত হয়।
“তরুণেরা ভালো নেই, অনেকের কাশি হচ্ছে”
শিবিরে অবস্থানরতদের মধ্যে জুতা, মোজা শীতের কাপড় এবং স্যান্ডউইচ বিতরণ করতে আসেন অভিবাসন সংস্থা লে মিদি দু মি-এর প্রতিষ্ঠাতা আগাথে নাদিমি।
তরুণ অভিবাসী মনার অসুস্থতার কথা শুনে তিনি প্যারিসের একটি মেডিকেল সেন্টারে অ্যাপয়েন্টমেন্ট খোঁজার চেষ্টা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন।
তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “এখানে অনেক তরুণ আছে যারা আবারও স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। এই জায়গাটি একটি ব্রিজের নীচে, খুব কোলাহলপূর্ণ এবং এক্সপ্রেসওয়ের কাছাকাছি হওয়ায় বিপজ্জনক। এখানে অল্পবয়সিরা ভাল নেই, অনেকের কাশি হচ্ছে।”
তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, “আমি বুঝতে পারছি না যে কেন তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কাঠামোতে রাখা হচ্ছে না। অনেকেই আছেন যারা এখনও নাবালক স্বীকৃতির মূল্যায়ন ব্যবস্থার জন্য এখনও কোন আবেদন জমা দেননি।”
নাবালকদের জন্য প্যারিসে একমাত্র সরকারি আবাসন কেন্দ্রটি মাত্র চল্লিশ শয্যা বিশিষ্ট। এই তরুণদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য সংস্থাগুলোর অভ্যর্থনা ক্ষমতা খুবই সীমিত। লে মিডিস ডু মি বা টিআইএমএওয়াই-এর মতো সংস্থাগুলো শুধুমাত্র কয়েকজন অপ্রাপ্তবয়স্কদের রাখার ব্যবস্থা করতে পারবে।
বর্তমানে এই অস্থায়ী শিবিরে তরুণদের সার্বিক দেখভালের দায়িত্বে আছে অভিবাসন সংস্থা ইতুপিয়া৫৬। সংস্থাটির সদস্য প্রিসকাভাইন ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “তারা চরম ক্লান্তির মধ্যে রয়েছে। আমরা দ্রুত আশ্রয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। এখানে শালীন জীবনযাত্রার পরিস্থিতি সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যবশত সরকারের সহায়তা ছাড়া অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে থাকা এই জায়গায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে।”
মূল প্রতিবেদন বাহারা মাকোই এবং হাফিজ মিখাইল। ইনফোমাইগ্রেন্টস বাংলায় ফরাসি থেকে ভাষান্তর মোহাম্মাদ আরিফ উল্লাহ।
এমএইউ/এআই