সার্বিয়ার একটি অভিবাসী শিবিরের সামনে সীমান্তে যেতে ব্যবহৃত ট্যাক্সির সারি। ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস
সার্বিয়ার একটি অভিবাসী শিবিরের সামনে সীমান্তে যেতে ব্যবহৃত ট্যাক্সির সারি। ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস

বলকান রুটের সার্বিয়া-হাঙ্গেরি সীমান্তের পাদদেশে আটকে থাকা অভিবাসীদের কাছে একসময় পাচারকারীদের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কারণ এই অঞ্চলের অনানুষ্ঠানিক শিবির থেকে শুরু করে সরকারি ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে বেশিরভাগ কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ মানবপাচারকারীদের হাতে। উত্তর সার্বিয়া থেকে ইনফোমাইগ্রেন্টসের সাংবাদিক মার্লেন পানারার বিশেষ প্রতিবেদন।

সার্বিয়ার উত্তর সীমান্ত অতিক্রম করা অভিবাসীদের নিয়মিত দ্বৈত কাঁটাতারের বেড়া, নজরদারি ক্যামেরা এবং হিংসাত্মক পুশব্যাকের মতো কঠিন ধাপ পার হতে হয়। শক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা অতিক্রম করতে না পেরে এক সময় ক্লান্তি ভর করে অনেক অভিবাসীর উপর। 

এমনই একজন অভিবাসী সিরিয়া থেকে আসা হাশেম (ছদ্মনাম)*। উত্তর সার্বিয়ার প্রধান অভিবাসী কেদ্রের প্রবেশদ্বারের বাইরে তার দেখা পায় ইনফোমাইগ্রেন্টস। ২০২১ সালে এই অঞ্চলে এসে পৌঁছানো এই অভিবাসী দিনের বেশিরভাগ সময় সিরীয়দের সঙ্গে কাটান।

২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর, উত্তর-পশ্চিম সার্বিয়ার এই শহরে হাজার হাজার অভিবাসী আসছেন। সবার লক্ষ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাঙ্গেরি সীমান্ত দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে পৌঁছানো।

সিরীয় অভিবাসী হাশেমও একই চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে ২০ বারের অধিক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত, হাঙ্গেরিকে সার্বিয়া থেকে পৃথককারী দ্বৈত কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে আসা এই যুবকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। 

আরও পড়ুন>>ভিসার নিয়ম বদলাতে সার্বিয়াকে ইইউ, জার্মানির কড়া বার্তা

২০১৭ সাল থেকে সার্বিয়া হাঙ্গেরি সীমান্তের বেড়া ১৬০ কিলোমিটারের বেশি বাড়ানো হয়েছে। হাঙ্গেরির সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিয়মিত এখানে টহল দেয়। সৈন্যদের সহায়তার জন্য স্থাপন করা হয়েছে কন্ট্রোল স্ক্রিনে সংযুক্ত থার্মাল ক্যামেরা। এই অঞ্চলে সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাঙ্গেরিতে অনুপ্রবেশ একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছে।  

সার্বিয়ার বেশ কয়েকটি অভিবাসী অভ্যর্থনা কেন্দ্রে সক্রিয় এনজিও অ্যাসাইলাম সিকারস প্রোটেকশন সেন্টার (এপিসি) অনুসারে, গত বছরের বসন্ত থেকে হাঙ্গেরি কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন ৬০০ থেকে এক হাজার লোককে সহিংস পুশব্যাকের মাধ্যমে ফিরিয়ে দিয়েছে।

“অভিবাসীদের চেয়ে দালালের সংখ্যা বেশি”

হাঙ্গেরি্র সীমান্ত প্রাচীরের পেছনে সার্বিয়ায় আটকে পড়া অভিবাসীদের জন্য শেষ পর্যন্ত একটাই সমাধান থাকে সেটি হল দালাল বা মানবপাচার চক্রের সদস্যদের কাছে যাওয়া। 

এনজিও কালেক্টিভ এইডের সদস্য বেটি ওয়াং বলেন, “গত বছর থেকে অভিবাসীদের পক্ষে নিজে নিজে এই সীমান্ত অতিক্রম করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এটি এখন অনেক জটিল হয়ে উঠেছে। এটি বলা যায় বর্তমানে কেউই টাকা না দিয়ে সীমান্ত পার হয় না। এখানে মানবপাচারকারীরা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করে।।”

পড়ুন>>শীতে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা!

এই অধিকারকর্মীর মতো, “অনানুষ্ঠানিক ক্যাম্পের মতো কর্তৃপক্ষের পরিচালিত শিবিরগুলোতেও  অনেক 'ছোট হাত' কাজ করে। অনেক অভিবাসী, যাদের কাছে সীমান্ত পার হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নেই তারা এই পাচার চক্রের সঙ্গে থেকে ভবিষ্যতের পারাপারে অর্থ প্রদান করে।”

উত্তর সার্বিয়ায় অবস্থিত হাঙ্গেরি সীমান্তের একটি অংশ। ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস
উত্তর সার্বিয়ায় অবস্থিত হাঙ্গেরি সীমান্তের একটি অংশ। ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস


উত্তর সার্বিয়ার সোমবোর নামক আশ্রয়কেন্দ্রটিতে ১২০ জনের ধারণক্ষমতার বিপরীতে বর্তমানে প্রায় ৮০০ জন আশ্রয়প্রার্থী বসবাস করছেন। মাত্র এক মাস আগে এই শিবিরে আসা আশ্রয়প্রার্থী ওয়ায়েল (ছদ্মনাম)* ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “এখানে অভিবাসীদের চেয়ে পাচারকারীর সংখ্যা বেশি।”

২২ বছর বয়সি এই সিরীয় যুবক তুরস্কে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করে যাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে তার লক্ষ্য অন্য অভিবাসীদের সঙ্গে হাঙ্গেরি সীমান্তে গিয়ে একটি বিচক্ষণ এবং কম সুরক্ষিত পথ খুঁজে বের করা। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি তৃতীয় পক্ষ থেকে পাওয়া একটি জিপিএস ব্যবহার করবেন বলে জানান। 

আরও পড়ুন>>টিউনিশিয়া ও বুরুন্ডির নাগরিকদের ভিসামুক্ত সুবিধা বাতিল করল সার্বিয়া

তিনি ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “তুরস্ক থেকে বুলগেরিয়া যাওয়ার জন্য আমার অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখানে আসার পর আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই। এমনকি যারা আমাকে পার হতে সাহায্য করেছিল তাদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ঋণ করেছিলাম। তারা বিশ্বাস করে এই অর্থ দিয়েছিল। কেন্দ্রের বাইরে একটি ছোট দোকানের সামনে। হাঙ্গেরি সীমান্তে লোকজনকে পাচারে সহায়তা করা তেমন লাভজনক নয়। কারণ আপনাকে সব টাকা পাচারচক্রের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। কিন্তু এই কাজ আমাকে একদিন না একদিন সীমান্ত পার হতে সহায়তা করবে।”

একবার ঋণের অর্থ শোধ হয়ে গেলে এবং সার্বিয়া ছেড়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করতে পারলে ওয়ায়েল অস্ট্রিয়া যেতে চান। সেখানে তার ভাই থাকে।

ওয়ায়েল আরো যোগ করেন, “আমি মনে করি আমরা কোনো ভুল কাজ করছি না। আমি নিজেকে রক্ষা করছি। সাধ্য অনুযায়ী সীমান্তের ওপারে লোকদের যেতে সাহায্য করছি। 

নেটওয়ার্কের অন্য সদস্যরা সীমান্ত বেড়া পাড়ি দিতে ব্যবহৃত মই এবং অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে সীমান্ত এলাকায় ট্যাক্সি স্থানান্তরের ব্যবস্থা করে। মই বা অস্থায়ী সিঁড়ি ছাড়া এখন প্রাচীর পেরিয়ে যাওয়া খুব কঠিন।

পড়ুন>>সার্বিয়া-হাঙ্গেরি সীমান্তশিবিরে তিন হাজার অভিবাসী

অভিবাসী কেন্দ্রের সামনে অভিবাসীদের সীমান্তে সারি সারি ট্যাক্সি চোখে পড়বে। মূল প্রবেশপথের সামনে যারা ভিড় করে তাদের সবার বসানোর জন্য রাস্তাটি খুব সরু। একটি ছোট কাঠের প্রান্তে গাড়ির একটি দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়। ইনফোমাইগ্রেন্টস একই ছবি দেখেছে সার্বিয়ার পূর্বের সুবোটিকার অভিবাসী কেন্দ্রের সামনে। 

তাঁবুর জন্য পঁচিশ ইউরো

উপচে পড়া কেন্দ্রগুলিতে মানবপাচার চক্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচতে বেশিরভাগ অভিবাসীরা এই শহরগুলি থেকে দূরে হাঙ্গেরি সীমান্তের অনানুষ্ঠানিক শিবিরগুলিতে বসতি স্থাপন করতে পছন্দ করে। 

কিন্তু সেখানেও, যাতায়াতের অসুবিধা এবং বিপর্যয়কর জীবনযাত্রার কারনে অভিবাসীরা অর্থের বিনিময়ে পাচারকারীদের দেওয়া বিভিন্ন সেবা নিতে বাধ্য হন।

হাঙ্গেরির খুব কাছের একটি গ্রাম হরগোসে অবস্থানরত অভিবাসীরা এর উদাহরণ হতে পারে। ২৩ বছর বয়সি এক আলজেরীয় অভিবাসী নিশ্চিত করেন, এখানে একটি তাঁবুতে ঘুমাতে জনপ্রতি ২৫ ইউরো বা আড়ায় হাজার টাকা দিতে হয়। 

আরও পড়ুন>>সার্বিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসীর রহস্যজনক মৃত্যু

এই অভিবাসী জানান তার এই অর্থ প্রদানের সামর্থ্য না থাকায় ক্যাম্পের কাছে একটি ছোট মরুভূমির পাশে রাত কাটান।

কাছাকাছি আরেক গ্রাম সর্পসকি করস্তুর -এ, পাচারকারীদের নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তিশালী। এক বছর ধরে এই গ্রামের বাসিন্দাদের স্থানীয় জলাশয়ের তীরে পা রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

উত্তর সার্বিয়ায় অবস্থিত 'হরগোস' গ্রাম হাঙ্গেরির সীমান্তে অবস্থিত। শহরের কেন্দ্র থেকে একটু দূরে সেখানে দুটি অনানুষ্ঠানিক ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস
উত্তর সার্বিয়ায় অবস্থিত 'হরগোস' গ্রাম হাঙ্গেরির সীমান্তে অবস্থিত। শহরের কেন্দ্র থেকে একটু দূরে সেখানে দুটি অনানুষ্ঠানিক ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস


সেখানে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী অভিবাসী শিবির। যেখানে প্রায় ২০০ জন লোক একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় ক্রমাগত নজরদারির মধ্যে বাস করেন। 

এই শিবিরটিতে পাহারার জন্য বেশ কয়েকজন লোক নিয়োগ করেছে পাচারচক্র। এদের মধ্যে কেউ শহরে খাবার কিনতে অন্য জন পাহারার দায়িত্ব পরিবর্তন করেন। 

পড়ুন>>সার্বিয়ায় অভিবাসীদের গুলি বিনিময়ের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৮৫

এই গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা বেকা জানান, “এই লোকদের পাহারা মূলত সীমান্ত বেড়ার সরাসরি ফলাফল। এই প্রাচীরগুলো একটি বিপর্যয়। সীমান্তে কড়াকড়ির ফলে পাচারকারীরা এসব অস্থায়ী শিবিরে লোকেদের অবরুদ্ধ থাকতে বাধ্য করছে। ফলে পাচারকারীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।”

“যত বেশি দেওয়াল, তত বেশি পাচারকারী”

৫ অক্টোবর সার্বিয়া পুলিশ একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাসকারী ২৯৯ জনকে উচ্ছেদ করে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পোস্ট করা অভিযানের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশকে অভিবাসীদের বহিষ্কার করছে। সামরিক ইউনিফর্মে থাকা সদস্যরা তাঁবুর ভিতরে তল্লাশি চালিয়ে আশ্রয়প্রার্থীদের জিনিসপত্র খালি করে।

বেকা আরো বলেন, “এই ধরনের অভিযান এখানে প্রতি মাসে হয়, লোকেরা আবার ফিরে আসে।”

উত্তর সার্বিয়ার একটি গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা বেকা ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কথা। ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস
উত্তর সার্বিয়ার একটি গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা বেকা ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কথা। ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস


সার্বিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার ভুলিন ৯ অক্টোবর গ্রিস সফরে বলেন, সার্বিয়া সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েক মাস ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধী গ্যাংগুলো ২০১৫ সাল থেকে মানবপাচার এবং অস্ত্র ও মাদক পাচার থেকে প্রচুর মুনাফা লাভ করেছে। 

আরও পড়ুন>>অনিয়মিত অভিবাসন ঠেকাতে মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর নতুন ব্যবস্থা

অ্যাসাইলাম সিকার্স প্রোটেকশন সেন্টার (এপিসি)-এর পরিচালক রাডোস জুরোভিচ বলেছেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কর্তৃপক্ষ মরিয়া হয়ে অভিযানে সংগ্রামে নেমেছে। প্রকৃতপক্ষে, যতদিন মানুষ পারাপারে বাধা দেওয়ার জন্য এই বেড়া থাকবে, ততদিন সেখানে পাচারকারী থাকবে। তাই সীমান্ত কঠোর করার এই নীতিগুলো সম্পূর্ণরূপে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেবে। আপনি যত বেশি দেওয়াল তৈরি করবেন, তত বেশি পাচারকারী সৃষ্টি হবে।”

চলতি বছরের ৯ জুলাই, হাঙ্গেরির রাষ্ট্রপতি ভিক্টর অরবান একটি বিশেষ বর্ডার গার্ড ইউনিট প্রতিষ্ঠার জন্য ডিক্রিতে সই করেছেন। ডিক্রি অনুযায়ী এই ইউনিটের সদস্য সংখ্যা চার হাজার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া, এই ডিক্রির বেশ কয়েকদিন পর হাঙ্গেরি সরকারের অফিসিয়াল সাইটে প্রকাশিত একটি ডিক্রিতে সার্বিয়া সীমান্তে দ্বৈত সীমান্ত বেড়া আরো দীর্ঘ করার ঘোষণা দেয়া হয়। 


মূল প্রতিবেদন সার্বিয়া থেকে মার্লেন পানারা। ইনফোমাইগ্রেন্টস বাংলায় ফরাসি থেকে ভাষান্তর মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ। 



এমএইউ/আরকেসি





 

অন্যান্য প্রতিবেদন