ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানা। ছবি: রয়টার্স
ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানা। ছবি: রয়টার্স

ফরাসি শ্রমমন্ত্রী অলিভিয়ের দুসপ্ট ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানা অভিবাসন সংক্রান্ত একটি সম্ভাব্য বিল সংসদে তোলার কথা বলেছেন। খসড়া প্রস্তাবে অনিয়মিতদের বহিনষ্কার পদ্ধতি ত্বরান্বিত করা এবং সংকটে থাকা সেক্টরভিত্তিক পেশার বিপরীতে নিয়মিতকরণের কথা বলা হয়েছে। ২০২৩ সালের শুরুতে এই বিল নিয়ে সংসদে বিস্তারিত আলোচনা ও ভোটাভুটি হওয়ার কথা রয়েছে।

ফরাসি দৈনিক লো মোন্দকে বুধবার দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বর্তমান ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানা বলেন, “সংক্ষেপে আসন্ন অভিবাসন বিল নিয়ে বলতে হলে আমি বলব, এখন আমাদের খারাপ লোকদের সাথে খারাপ এবং ভাল মানুষদের সাথে ভাল আচরণ করতে হবে।”

এই বক্তব্যের মাধ্যমে ফ্রান্সের আসন্ন অভিবাসন ও আশ্রয় বিলের সম্ভাব্য চিত্র ফুটে উঠেছে। এমানুয়েল মাক্রোঁ দ্বিতীয় মেয়াদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী এলিজাবেথ বর্ন নেতৃত্বাধীন সরকার ডান ও কট্টর ডানপন্থি ও বামপন্থিদের মিশ্র অভিবাসন প্রস্তাবনায় এক প্রকার ব্যস্ত সময় পার করছে। 

আরও পড়ুন>>>ফ্রান্সে পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী অভিবাসীদের বহুভাষী প্ল্যাটফর্ম

অভিবাসন বরাবরই ফরাসি রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। নির্বাচনের আগে সবসময় অভিবাসন নিয়ে চাপ থাকায় এবার মেয়াদের শুরুতেই নতুন বিল এনে ডান ও বাম রাজনৈতিক ব্লকের প্রশ্নবানে জর্জরিত হওয়ার সম্ভবানা এড়াতে চাইছে বর্তমান সরকার।

লো মোন্দকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জেরাল্ড দারমানার সাথে আরও উপস্থিত ছিলেন ফরাসি শ্রমমন্ত্রী অলিভিয়ের দুসপ্ট। এই সাক্ষাৎকারে আশ্রয় ও অভিবাসন সংক্রান্ত একটি সম্ভাব্য বিলের মূল বিষয়গুলো উন্মোচন করলেও নির্দিষ্ট বিষয় ধরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।

পড়ুন>>প্যারিসে মানব পাচারের দায়ে অভিবাসন সংস্থার প্রাক্তন সভাপতির কারাদণ্ড

প্রস্তাবিত খসড়া বিলের উপর আগামী বছরের শুরুতে সংসদে বিস্তারিত আলোচনা ও ভোট হওয়ার কথা রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রস্তাবনার রদ বদল হওয়ার একটি সম্ভাবনা থাকে। 

ভারসাম্যের চেষ্টা

খসড়া বিলের প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাক্রোঁর নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার অনেকটা ভারসাম্যমূলক একটি বিল পাশের চেষ্টা করছেন। 

পড়ুন>>ফ্রান্সে আশ্রয়ভাতা আত্মসাতের অভিযোগ, অভিযুক্ত ১২

সম্প্রতি এক আলজেরীয় অনিয়মিত অভিবাসী একটি ফরাসি শিশুকে হত্যার ঘটনার পর ডান ও কট্টর ডানপন্থি দলগুলো অনিয়মিত অভিবাসীদের ফ্রান্স থেকে ডিপোর্ট ও বহিষ্কার নিয়ে বেশ সরব। এটিকে নিশানা করে সরকার ফ্রান্সত্যাগের আইনি নোটিশ (ওকিউটিএফ) পাওয়া লোকেদের কীভাবে তাদের নিজ দেশে দ্রুত ফেরত পাঠানো যায় সেই লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তুল ধরেছে।

অপরদিকে, বাম শিবির (সোশ্যালিস্ট, সবুজ দল, আনঁসুমিজ ও কমিউনিস্ট) দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মিতদের বৈধতা প্রদানের পক্ষে সরব। সেক্ষেত্রে শ্রমিক সংকটে থাকা সেক্টর ও পেশাগত কাজের চাহিদার উপর ভিত্তি করে বেশ কিছু শর্ত সাপেক্ষে নিয়মিতকরণের কথাও প্রস্তাব করা হয়েছে।

 সাক্ষাৎকারে আলোচিত খসড়া বিলের প্রধান বিষয়গুলো ইনফোমাইগ্রেন্টস বাংলার পাঠকদের সুবিধার্থে নীচে তুলা ধরা হলো: 

নোটিশ পাওয়া অভিবাসীদের ‘অপরাধী’ তালিকায় যুক্ত করার প্রস্তাব

নতুন খসড়া আইনে সরকার ওকিউটিএফ বা ফ্রান্স ত্যাগের আইনি নোটিশ পাওয়া অনিয়মিত অভিবাসীদের জাতীয় অপরাধ বিষয়ক ‘ওয়ান্টেড’ আসামির তালিকার যুক্ত করার কথা ভাবছে। জেরাল্ড দারমানা বলেন, “আমরা ওকিউটিএফ পাওয়া সব অভিবাসীদের কেন্দ্রীয় এফপিআর তালিকায় নিবন্ধন করব।”

আরও পড়ুন>>“আমার মা জানলে ঘুমাতেন না”

এফপিআর তালিকাটি ফরাসি জাতীয় পুলিশ, জেন্ডারমেরি এবং কাস্টমস কর্মকর্তারা পলাতক থাকা নির্দিষ্ট কিছু লোক সন্ধান, নিরীক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, “এটির উদ্দেশ্য কেউ অনিয়মিত অবস্থায় বসবাস করছেন কী না সেটি খুঁজে বের করা নয়। বরং এই তালিকার সাহায্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফরাসি ভূখণ্ডত্যাগের হার গণনা করা সম্ভব হবে।”


প্রস্তাবিত এই পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার নোটিশ পাওয়া অনিয়মিত অভিবাসীদের উপর কড়া নজরদারি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ফ্রান্স প্রতিবছর আনুমানিক এক লাখ ২০ হাজার ওকিউটিএফ নোটিশ ইস্যু করে। যদিও এই বড় সংখ্যার বিপরীতে মাত্র ১০ শতাংশ অভিবাসীর বহিষ্কার বাস্তবায়ন করা হয়। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “অভিবাসীদের করা বিভিন্ন আপিল আবেদনের কারণে প্রায় ৫০ শতাংশ ওকিউটিএফ স্থগিত থাকে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার ফলে এগুলো সহজে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। বর্তমানে ১২টি ধাপে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। আমরা এটিকে মাত্র চারটি পর্যায়ে আপিলের সুযোগ রেখে অনিয়মিতদের বহিষ্কার বা ডিপোর্ট প্রক্রিয়া সহজ করতা চাই।”

পড়ুন>>ফ্রান্সে নতুন একটি প্রশাসনিক আটককেন্দ্র চালুর ঘোষণা

পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান আইনে ফ্রান্সে ১৩ বছর বয়সের আগে আসা অভিবাসীদের ‘বহিষ্কার’ না করার আইনের পরিবর্তন চান। এই আইনের ফলে কোন অভিবাসী গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেও তিনি যদি ১৩ বছর বয়সের আগে ফ্রান্সে প্রবেশ করেন সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ডিপোর্ট না করার আইনি বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে। 

আশ্রয় আইনের সংস্কার

প্রস্তাবিত খসড়া বিলটিতে আশ্রয় আইনের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বড় সংস্কারেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ফরাসি জাতীয় আশ্রয় বিষয়ক আদালত (সিএনডিএ) তে মামলা শুনানিগুলো একক বিচারকের অধীনে করা। বর্তমান আইনে একাধিক বিচারকের সমন্বয়ে একটি কলেজিয়াল বোর্ডে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। নতুন আইন পাশ হলে শুধুমাত্র আলোচিত আশ্রয় আবেদনের আপিলের ক্ষেত্রে আগের নিয়ম অনুসরণ করা হবে। 

জেরাল্ড দারমানা আরও বলেন, “আপিল আবেদনের সময় কমিয়ে আনতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানির আয়োজনের সম্ভাবনাকে সাধারণীকরণ করা হবে।”

আরও পড়ুন>>‘এখানে অভিবাসীর চেয়ে দালালের সংখ্যা বেশি’

খসড়া বিলে কোনো আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয় আবেদন যদি অফপ্রা (শরণার্থী ও রাষ্ট্রবিহীন ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য ফরাসি দপ্তর) থেকে প্রত্যাখ্যান হয় সেক্ষেত্রে উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৫ দিনের মধ্যে আপিল করার বাধ্যবাধকতা রাখা হবে। 

১৫ দিনের সময়সীমা পার হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ওকিউটিএফ নোটিশ বা ফরাসি ভূখণ্ডত্যাগ করার আইনি বাধ্যবাধকতা জারি করা হবে। 

আশ্রয়প্রার্থীদের প্রথম ছয় মাস কাজ করার নিষেধাজ্ঞার অবসান

নতুন বিলে সরকার অভিবাসী কর্মীদের পেশাদার খাতে একীকরণকে সহজতর করতে চায় বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন শ্রম মন্ত্রী অলিভিয়ার দুসপ্ট। 

ফরাসি শ্রমমন্ত্রী অলিভিয়ের দুসপ্ট। ছবি: রয়টার্স
ফরাসি শ্রমমন্ত্রী অলিভিয়ের দুসপ্ট। ছবি: রয়টার্স


চলতি বছরের প্রথমার্ধে ফ্রান্সে বেকারত্বের হার ছিল ৭.৫ শতাংশ। অপরদিকে শুধুমাত্র অভিবাসী কর্মীদের এই হার ছিল ১৩ শতাংশ। 

মন্ত্রী বলেন, “অভিবাসীদের ইন্টিগ্রেশন ও ফরাসি সমাজে একীকরণের ক্ষেত্রে চাকুরিকে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।”

পড়ুন>> ফ্রান্সে আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণ ক্ষমতা বাড়বে প্রায় ছয় হাজার

বর্তমানে আইনে ফ্রান্সে আসা কোনো আশ্রয়প্রার্থী একজন মালিক খুঁজে পেলেও প্রথম ছয় মাসে কাজের অনুমতি আনার সুযোগ নেই। এই আইনটি বাতিলের কথাও উল্লেখ রয়েছে খসড়া আইনে। 

শ্রমমন্ত্রীর মতে, “আশ্রয়প্রার্থীদের ফ্রান্সে আসার প্রথম ছয় মাসে কাজের অনুমতি নিয়ে বৈধভাবে কাজ করার সুযোগ না থাকায় তাদেরকে অফি প্রদত্ত আশ্রয় ভাতার (এডিএ) উপর নির্ভর করতে হয়। এটি একটি বড় সীমাবদ্ধতা।”

নির্দিষ্ট খাতের পেশার অভিবাসীদের ‘বৈধতা’ প্রদান

ফরাসি শ্রমমন্ত্রী বর্তমানে শ্রমিক সংকটে থাকা অভিবাসীদের বৈধতা প্রদানের সুযোগ দিতে চান। 

করোনা মহামারির পর থেকে নির্মাণ খাত সহ বহু সেক্টর প্রয়োজনীয় শ্রমিক খুঁজে পেতে সংগ্রাম করছে। যদিও এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে কোনো খাতের জন্য এই বিশেষ সুবিধা প্রযোজ্য হবে সেগুলো বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়নি। 

পড়ুন>>শ্রমিক ঘাটতি মেটাতে শরণার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে চায় ফরাসি কোম্পানিগুলো

ফরাসি শ্রমবাজারের অনেক খাত বাধ্য হয়ে বিপুল সংখ্যক অনিয়মিত শ্রমিকদের রাখতে বাধ্য হচ্ছে। পাশাপাশি বহু মধ্যস্বত্বভোগী এজেন্ট অনিয়মিত অভিবাসীদের এসব সেক্টরে চাকুরিতে প্রবেশ করিয়ে মুনাফা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ আছে।

অলিভিয়ের দুসপ্ট আরও বলেন, “খসড়া আইনটি পাশ হলে পেশাদার সংস্থা ও কোম্পানিগুলো বিদেশিদের সহজে নিয়োগ দিতে পারবেন। নতুন বিলের মাধ্যমে তাদের সমাধান প্রদানের চেষ্টা করছি।”

রেসিডেন্ট পারমিট নবায়নে ফরাসি ভাষার দক্ষতা

পাশাপাশি সার্কুলার ভালস এর আওতায় বর্তমানে কাজের মাধ্যমে অনিয়মিতদের বৈধতা প্রদানের যেই নিয়ম আছে সেটি আরও সহজ করার পরিকল্পনা করছে সরকার। 

অলিভিয়ের দুসপ্ট জানান, “নতুন বিলে সরকার একটি সংস্কারের দরজা খুলতে চায়। ফরাসি শ্রমিক ইউনিয়নগুলোও দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছিল।”

পড়ুন>>কেন ফ্রান্স থেকে সকল অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বহিষ্কার অসম্ভব?

বর্তমানে বৈধতার জন্য নিয়োগকর্তার মাধ্যমে কাজের অনুমতির জন্য আবেদন করতে হয়। যার ফলে বহু নিয়োগকর্তা কর্মীদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ সহ নানা প্রশাসনিক ঝামেলার সুযোগ নেয়। খসড়া বিলে অভিবাসীরা যেন নিজে এই আবেদন করতে পারে সেই সুযোগ রাখতে চায় সরকার।

শ্রমমন্ত্রী এই প্রস্তাবনার সাথে একমত পোষণ করে জেরাল্ড দারমানা বলেন, “আমরা হয়তো পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিবাসীদের রেসিডেন্ট পারমিট দিচ্ছি না। কিন্তু আমরা দীর্ঘমেয়াদি কার্ড নিয়ে বসবাস করা অভিবাসীদের নবায়নের প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করার প্রস্তাব করতে যাচ্ছি। যেসব অভিবাসীরা এখানে কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না এবং যাদের কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নয় তারা এই সুযোগ পাবেন। 

আরও পড়ুন>>ইইউ দেশগুলোর স্থানীয় নির্বাচনে অভিবাসীদের ভোটাধিকার

তিনি আরও বলেন, “কয়েক লক্ষ অভিবাসী রেসিডেন্ট পারমিট স্বয়ংক্রিয় নবায়নের সুবিধাভোগী হবেন। তবে এক্ষেত্রে তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট ফরাসি ভাষার দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে।”

উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত বিলটি কোন চূড়ান্ত অভিবাসন নীতির বহিঃপ্রকাশ নয়। কেবলমাত্র, ফরাসি সংসদে পূর্ণাঙ্গভাবে পাশ হওয়ার পর এটিকে আইনিভাবে চূড়ান্ত বলা যাবে। 


এমএইউ/এআই






 

অন্যান্য প্রতিবেদন