তিন সপ্তাহ সমুদ্রে অপেক্ষার পর অবশেষে দক্ষিণ ফ্রান্সের তুলোন শহরে ভিড়েছে ভূমধ্যসাগরে মানবিক উদ্ধার কাজে নিয়োজিত জাহাজ ওশান ভাইকিং৷
জাহাটিতে মোট দুইশ ৩০জন অভিবাসী রয়েছেন৷ এদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ, ইরিত্রিয়া, সিরিয়া, মিশর, পাকিস্তান আফ্রিকার দেশ ও মালির নাগরিক৷
১১ নভেম্বর শুক্রবার দক্ষিণ ফ্রান্সের বন্দর শহর তুলোনে নোঙ্গর করে জাহাজটি৷
এই প্রথম ভূমধ্যসাগরের কোনো উদ্ধারকারী জাহাজ ইটালির বন্দরে ভিড়ার অনুমতি না পেয়ে ফরাসি বন্দরে আশ্রয় নিল৷
ইটালির এই আচরণের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ফ্রান্স৷ রোমের এই আচরণকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে ইটালি থেকে সাড়ে তিন হাজার আশ্রয়প্রার্থী গ্রহণের সকল চুক্তি বাতিল করেছে প্যারিস৷
ওশান ভাইকিকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে চলতি সপ্তাহের মঙ্গলবার থেকে ইটালি ও ফ্রান্সের মধ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে৷
আরও পড়ুন>>‘বহিষ্কার’ ও ‘বৈধতা’ দুটিই বৃদ্ধির পরিকল্পনা ফ্রান্সের নতুন অভিবাসন নীতিতে
দক্ষিণ ফ্রান্সের ‘ভার’ প্রেফেকচুর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘‘জাহাজটি সকাল ৮:৫০ মিনিটে বন্দরে ভিড়েছে এবং এরপরই অভবাসীরা নামতে শুরু করে৷’’
এএফপির একজন সাংবাদিক তুলোনের সামরিক বন্দরে বাসগুলো ঢুকতে দেখেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন।
এসওএস মেডিট্রেনির মুখপাত্র মেরিল সোটি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘‘জাহাজটি নোঙর করার আগে একজন ফরাসি ডাক্তার জাহাজে এসেছিলেন৷ প্রথমে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও ঝুঁকিতে থাকা লোকেদের নামানো হবে৷ তারপর নারী, শিশু এবং পরিবারগুলোকে নামতে দেওয়া হবে৷’’
পড়ুন>>সাড়া নেই ইটালির, ফ্রান্সের পথে ‘ওশান ভাইকিং’
২৩০ অভিবাসীর এই দলকে তুলোনের সামরিক বন্দরের বাইরে নির্মিত একটি অস্থায়ী ‘অপেক্ষাকেন্দ্র’ বা ওয়েটিং এরিয়াতে রাখা হবে৷
এটি তুলোনের পশ্চিমে অবস্থিত ইয়ের শহরের গিয়েন্সের উপদ্বীপে অবস্থিত৷ অস্থায়ীভাবে রুপান্তরিত এই আবাসনকেন্দ্রটি প্রায় বিশ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে বলে এক ডিক্রিতে জানিয়ছে স্থানীয় ‘ভার’ প্রেফেকচুর৷
ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানা বলেছেন, ‘‘৫৭জন শিশুসহ ওশান ভাইকিং-এ বেঁচে থাকা অভিবাসীরা প্রশাসনিক আবাসন কেন্দ্র ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না৷ আমরা আপাতত আহতদেরকে এই কেন্দ্রে রাখতে যাচ্ছি৷ কৌশলগতভাবে তাদেরকে মূল ভূখন্ডের বাইরে একটি উপদ্বীপে রাখা হবে৷’’
আরও পড়ুন>>আশ্রয় আবেদন যাচাইয়ে সুপারমার্কেটের অদক্ষ কর্মী নিয়োগ যুক্তরাজ্যে!
অপরদিকে ফ্রান্সে ওশান ভাইকিংয়ের জাহাজ আগমন নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল রাজনৈতিক বিতর্ক৷ কট্টর ডানপন্থি মারিন লো পেন সরকাররে বিরুদ্ধে অভিবাসী চাপে ‘শিথিলতা’ প্রদর্শনের অভিযোগ করেছেন৷
তবে বাম ও পরিবেশবাদী সবুজ দলগুলোর সম্মিলিত নতুন রাজনৈতিক জোট ‘লা নুপ্স’ সরকাররে এই মানবিক সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে৷ তাদের মতে, ফরাসি মূল্যবোধ অনুযায়ী এটি একটি সঠিক সিদ্ধান্ত৷
শীর্ষে বাংলাদেশিরা
এসওএস মেডিট্রেনির মুখপাত্র মেরিল সোটি এএফপিকে বলেন, ‘‘জাহাজে থাকা অভিবাসীদের লিবিয়ার উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং অনেকেই যুদ্ধরত বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে৷’’
পড়ুন>>“আমার মা জানলে ঘুমাতেন না”
চলতি সপ্তাহে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এনজিওটি জানায়, ‘‘ওশান ভাইকিং জাহাজের ২৩৪ জন অভিবাসীর মধ্যে ২৩ শতাংশ বাংলাদেশি এবং ১৭ শতাংশ ইরিত্রিয়ার নাগরিক৷’’
অন্যান্যদের মধ্যে ১১ শতাংশ মিশরীয়, ১১ শতাংশ পাকিস্তানি এবং ১০ শতাংশ অভিবাসী আফ্রিকার দেশ মালির নাগরিক৷

২৩৪ অভিবাসীর মধ্যে চারজন অসুস্থ্য ব্যক্তিকে গতকাল হেলিকপ্টার যোগে ফ্রান্সের কর্সিকা দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে বাস্তিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ বাকিরা আজকে দক্ষিণ ফ্রান্সে অবতরণ করল৷
আরও পড়ুন>>ফ্রান্সে পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী অভিবাসীদের বহুভাষী প্ল্যাটফর্ম
এসব অভিবাসীদের মধ্যে যারা যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে এসেছেন তাদেরকে আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার করা হবে৷ পরবর্তীদের সবাইকে শরণার্থী ও রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত ফরাসি দপ্তর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশ্রয় আবেদনের যোগ্য কি না সেটি যাচাই করবে৷
ফরাসি সরকার আগামী বছরের শুরুতে একটি নতুন আশ্রয় ও অভিবাসন বিল আনার পরিকল্পনা করছে৷ প্রস্তাবিত এই বিলে বলা হয়েছে, যারা ফ্রান্সে আশ্রয় পেতে ব্যর্থ হবে তাদেরকে সরাসরি প্রশাসনিক আশ্রয়কেন্দ্রে অথবা অপেক্ষমাণ এলাকা থেকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে৷
তবে আজ অবতরণ করা অভিবাসীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যক্তিকে ফ্রান্সে রাখা হবে না৷ ইউরোপীয় স্থানান্তর নীতির ভিত্তিতে তাদেরকে নয়টি দেশে স্থানান্তরিত করা হবে৷
পড়ুন>>ফ্রান্সে আশ্রয়ভাতা আত্মসাতের অভিযোগ, অভিযুক্ত ১২
জার্মানির উদ্ধৃতি দিয়ে ফরাসি মন্ত্রণালয় বলেছে, জার্মানি প্রায় ৮০জনকে গ্রহণ করবে৷ এছাড়া, লুক্সেমবার্গ, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, লিথুয়ানিয়া, মাল্টা, পর্তুগাল এবং আয়ারল্যান্ডও নির্দিষ্ট সংখ্যক আশ্রয়প্রার্থীদের স্বাগত জানাবে৷
এদিকে ইটালির নতুন কট্টর ডান সরকারের ভূমিকার তীব্রভাবে সমালোচনা করেন জেরাল্ড দারমানা৷
আন্তজার্তিক সমুদ্র আইন অনুযায়ী ইটালির জাহাজটিকে আশ্রয় দেয়া উচিৎ ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি৷ তাঁর মতে, ‘‘ইটালি অত্যন্ত অমানবিক আচরণ করেছে৷’’

তিনি বর্তমানে ইটালি থেকে সাড়ে তিন হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে গ্রহণ করার যে নীতি সেটির উপর স্থগিতাদেশ ঘোষণা করেছেন৷ দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে আগাম হুমকি দিয়েছে়েছেন।
এমএইউ/আরআর (এএফপি, ইনফোমাইগ্রেন্টস ডেস্ক)