উত্তর আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছান অসংখ্য অভিবাসনপ্রত্যাশী। তাদের আগমন বন্ধ করতে একটি 'অ্যাকশন প্ল্যান' ঘোষণা করেছে ইউরোপীয় কমিশন । অভিবাসনপ্রত্যাশীদের দায়িত্ব নিয়ে ফ্রান্স এবং ইটালির মধ্যে তিক্ত বিরোধের পরে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশন সেন্ট্রাল ভূমধ্যসাগরের জন্য একটি পরিকল্পনা নিচ্ছে। ২৫ নভেম্বর ইইউর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে এই নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা।
বিপজ্জনক অভিবাসন রুটে ‘তাৎক্ষণিক এবং চলমান চ্যালেঞ্জ’ মোকাবেলা করতে পদক্ষেপের রূপরেখা নিয়েছে কমিশন। ইউরোপে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়ছে এবং আশ্রয়ের জন্য সমন্বিত পদ্ধতির অভাব আরো বেশি জটিল হয়ে উঠছে। সমস্যা বাড়ছে অভিবাসন নিয়ে।
চলতি মাসের শুরুতে ২৩৪ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে নিয়ে একটি জাহাজ প্রথমে ইটালির বন্দরে নোঙর করার চেষ্টা করে। কিন্তু ইটালি স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তাদের পক্ষে এই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জায়গা দেওয়া সম্ভব নয়। তাদেরকে ইটালিতে নামতেই দেওয়া হয়নি। জাহাজটি সেখান থেকে ফ্রান্সের বন্দরে এসে পৌঁছায়। এরপর দুই দেশের কূটনৈতিক তিক্ততা শুরু হয়।
কমিশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মার্গারিটিস শিনাস সোমবার পরিকল্পনাটি উপস্থাপন করে বলেন, "প্রতিটি মামলা ধরে কিংবা প্রতিটি নৌকা বাছাই করে অভিবাসন পরিচালনা করতে পারি না।"
ইউরোপে আগমন বেড়েছে
২০২২ সালে সমস্ত রুটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনিয়মিত আগমন বেড়েছে। উত্তর আফ্রিকা এবং ইটালি বা মাল্টার মধ্যবর্তী ভূমধ্যসাগরীয় পথ দিয়ে এই বছর ৯০ হাজারের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী এসেছেন, যা ২০২১ থেকে ৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে৷
কমিশন বলেছে, বেশিরভাগ অভিবাসী লিবিয়া এবং টিউনিশিয়া থেকে চলে যায় এবং প্রাথমিকভাবে মিশর, টিউনিশিয়া এবং বাংলাদেশ থেকে আসে।
কর্ম পরিকল্পনার তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে। অনিয়মিত অভিবাসন হ্রাস করা, ভূমধ্যসাগরে অনুসন্ধান এবং উদ্ধার প্রচেষ্টা সমন্বয় করা এবং আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রহণের দায়িত্ব এবং খরচ ইইউ দেশগুলির মধ্যে ন্যায্যভাবে বিতরণ করা হয় তা নিশ্চিতের চেষ্টা করা।
মৌলিক উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে একটি হলো উত্তর আফ্রিকা থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ছেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করা, আংশিকভাবে টিউনিশিয়া, মিশর এবং লিবিয়াকে "আরো কার্যকর সীমান্ত এবং অভিবাসন ব্যবস্থাপনা দেয়া এবংঅনুসন্ধান ও উদ্ধার ক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য সহায়তা প্রদান করা।"
ফ্রন্টেক্স, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সংস্থার সঙ্গে একত্রে, কমিশন উত্তর আফ্রিকায় অভিবাসী চোরাচালান ও পাচারের বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা জোরদারের আশা করছে। লিবিয়া থেকে ইইউ পর্যন্ত আরো মানবিক করিডোর, এবং লিবিয়া থেকে লোকেদের তাদের মূল দেশে বা নিরাপদ গন্তব্যে ফিরে যেতে সহায়তা করার প্রচেষ্টাও ইইউ কমিশনের এজেন্ডায় রয়েছে।
ইইউর স্বরাষ্ট্র বিষয়ক কমিশনার ইলভা ইওহানসন বলেন, "এই বছর ইতিমধ্যে তিন হাজারের এরও বেশি লোককে স্বেচ্ছায় লিবিয়া থেকে [তাদের] মূল দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।"
লিবিয়ায় অভিবাসীদের সহায়তাকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিওগুলি পরিকল্পনার অধীনে ইইউ সমর্থন পাবে।
অনুসন্ধান এবং উদ্ধার প্রস্তাব
অ্যাকশন প্ল্যানে "সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আন্তরিক সহযোগিতা এবং সংহতি" বজায় রেখে অনুসন্ধান এবং উদ্ধারের (এসএআর) বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি ফ্রন্টেক্স, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের সঙ্গে সমন্বয় এবং রাষ্ট্র এবং ব্যক্তিগত উদ্ধারকারী জাহাজগুলির মধ্যে আরো ভালো সহযোগিতাকে বোঝায়।
ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্স (এমএসএফ), সি ওয়াচ, এসওএস মেডিটেরানি এবং অন্যরা কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ইইউ রাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এসএআর অপারেশনের অনুপস্থিতিতে হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে।
ভূমধ্যসাগরীয় উদ্ধার কার্যক্রম নিয়ে সমন্বিত পদ্ধতির প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে অনুসন্ধান এবং উদ্ধারের উপর ইউরোপীয় যোগাযোগ গ্রুপের পুনঃপ্রবর্তন। ইটালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও পিয়ান্তেডোসি এটিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তবে উদ্ধারকারী জাহাজের জন্য নতুন নির্দেশিকার বিষয়ে সতর্ক ছিল সি-ওয়াচ। তারা বলেছিল এটির প্রয়োজন নেই।
২০১৭ সালে ইটালি সরকার কমিশনের একটি কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে ভূমধ্যসাগরে এনজিওগুলির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে একটি কাঠামো প্রবর্তন করে। এর ফলে তাদের একটি আচরণবিধিতে সই করতে হয়, যা কার্যকরভাবে কিছু অপারেশন বন্ধ করতে বাধ্য করে। ওই অপারেশনগুলি সামুদ্রিক উদ্ধারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল।
যৌক্তিকতা নিয়ে উদ্বেগ
সোমবার ব্রাসেলসে বক্তৃতাকালে, ইওহানসন বলেন, সর্বশেষ কর্ম পরিকল্পনাটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে অগ্রসর হওয়া অভিবাসন এবং আশ্রয় সংক্রান্ত নতুন চুক্তির পরিবর্ত হিসেবে নেয়া হচ্ছে এমনটা কিন্তু নয়।
তার কথায়, "একটি সাধারণ ইউরোপীয় সমাধান রয়েছে। এটি গ্রহণ করা আমাদের মূল অগ্রাধিকার। "
সমালোচকরা বলেন, চুক্তিটি সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধ করার বিষয়ে জোর দিচ্ছে। তবে আইনি অভিবাসন রুট বা আশ্রয় সংক্রান্ত বিষয়গুলির ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।
ইইউতে অভিবাসন এবং সীমানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আইনের অধ্যাপক ভিয়োলেটা মোরেনো-ল্যাক্স বলেন, অনুসন্ধান এবং উদ্ধারের জন্য একটি সাধারণ ইউরোপীয় পদ্ধতির উন্নয়ন ব্যবস্থা সহ এই চুক্তির মূল লক্ষ্য হলো অনিয়মিত পারাপার প্রতিরোধ করা।
মারিও ম্যাকগ্রেগর/আরকেসি