২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রিসের লেসবোস দ্বীপে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ফরাসি উদ্ধারকর্মী আর্নো বানো। ছবি: জুলি বুরদা
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রিসের লেসবোস দ্বীপে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ফরাসি উদ্ধারকর্মী আর্নো বানো। ছবি: জুলি বুরদা

২০১৭ সালে প্যারিসের কর্মব্যস্ত জীবন ছেড়ে ফরাসি সরকারের ন্যাশনাল সী রেসকিউ সোসাইটিতে উদ্ধারকর্মী হিসেবে যোগ দেন ফরাসি নাগরিক আর্নো বানো৷ এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে ইংলিশ চ্যানেল, মধ্য ভূমধ্যসাগর এবং এজিয়ান সাগরে ঝুঁকিতে থাকা অভিবাসীদের উদ্ধারে কাজ করেন তিনি৷ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছেন, এই কাজে তার অভিজ্ঞতা ও অনুপ্রেরণার গল্প৷

ফরাসি সরকারের ন্যাশনাল সী রেসকিউ সোসাইটির (এসএনএসএম) সাথে সমুদ্রে ঝুঁকিতে পড়া লোকেদের উদ্ধারের প্রশিক্ষণ শুরুর আগে আর্নো বানোর জীবন ছিল ভিন্ন রকম৷ 

হাজারো ফরাসি নাগরিকের ন্যায় প্যারিসের মতো বড় শহরে কর্মব্যস্ত দিন কাটতো তার৷ কিন্তু প্যারিস ত্যাগ করে কেন বেঁছে নিয়েছিলেন উদ্ধারকর্মীর কাজ? 

গত পাঁচ বছরে তার জীবন কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা স্মরণ করে আরনো বানো ইনফোমাইগ্রেন্টসেকে বলেন, ‘‘শুরুর দিনগুলোর কথা যদি বলি, সেই সময়ের আলোকে এটি আমার জন্য একটি উন্মাদ সিদ্ধান্ত ছিল৷’’

আরও পড়ুন>>‘ডিজিটাল ভিসা’ চালুর পরিকল্পনা স্পেনের

তিনি বলেন, ‘‘২০১৭ সাল থেকে সমুদ্রে হাজার হাজার অভিবাসী মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ উদ্ধারকর্মী হিসেবে যোগ দেয়ার আগে মাঝে মধ্যে আমি এনজিও এসওএস মেডিটারানের বিভিন্ন বিক্ষোভে যোগ দিতাম এবং সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ সহায়তা করতাম৷ সেসময় আমরা অনেকেই জানতাম না আমাদের কি করা উচিৎ৷’’

একসময় ভূমধ্যসাগরে কর্মরত এনজিওগুলোকে বিভিন্ন সময়ে অপরাধী সংগঠন হিসেবে সাব্যস্ত করার চেষ্টা হতে থাকে৷ সেই সময় অন্য অনেকের ন্যায় আর্নো বানোও নিজ উদ্যোগে পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷

আর্নো বানো বলেন, ‘‘যেহেতু ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমুদ্রে ঝুঁকিতে থাকা লোকদের উদ্ধার করতে আর যাচ্ছিল না, তাই আমি দায়িত্ব হিসেবে নিজেই একজন স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকারী হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি৷’’

পড়ুন>>অভিবাসন নিয়ে নতুন পরিকল্পনা ইটালির

আর্নো বানো মূলত প্যারিসে একজন ভূগোলবিদ হিসেবে ফরাসি সরকারের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ (সিএনআরএস)-এ কর্মরত ছিলেন৷ উদ্ধারকর্মীর কাজ শুরুর আগে তিনি ন্যাশনাল সী রেসকিউ সোসাইটিতে (এসএনএসএম) কর্মরত দুজন উদ্ধারকর্মীর সাক্ষাৎকার নেন৷

তিনি বলেন, ‘‘আমি সাক্ষাৎকারের পর জানতে পারি ফ্রান্সে স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধার দল রয়েছে৷ যারা আসলে পেশাদারদের মতোই প্রশিক্ষিত৷’’ 

এক পর্যায়ে স্ত্রী এবং তিন কন্যা সাথে নিয়ে তিনি প্যারিস অঞ্চল ছেড়ে নরমান্দি অঞ্চলের বন্দর শহর লো হাভে লে বসতি স্থাপন করেন এবং এসএনএসএম এর পুরো উদ্ধার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন৷

দীর্ঘ যাত্রা

এসএনএসএম-এ একজন উদ্ধারকর্মী হিসেবে যোগদানের রাস্তা বেশ দীর্ঘ৷ আর্নো বানো ফার্স্ট এইড ডিপ্লোমা, উপকূলীয় লাইসেন্স, ন্যাশনাল ওয়াটার সেফটি অ্যান্ড রেসকিউ সার্টিফিকেট (বিএনএসএসএ), রেডিও কমিউনিকেশন সার্টিফিকেট, সাঁতারু, জরুরী উদ্ধারকর্মীর মতো বেশ কিছু কোর্স সম্পন্ন করেন৷ 

আরও পড়ুন>>তীব্র আবাসন সংকটে অস্ট্রিয়ার নয়া আশ্রয়প্রার্থীরা

সমগ্র ফ্রান্সে এসএনএসএম এর আওতাভুক্ত মোট ৮,৮০০ জন স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকর্মী আছেন৷ যারা তাদের অবসর সময়ে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন উপকূলে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের উদ্ধারে সময় দেন৷ 

আর্নো বানো শুরুর দিকে লো হাভ অঞ্চলের উদ্ধার স্টেশনে কর্মরত ছিলেন৷ এই অঞ্চলে অভিবাসী নৌকা উদ্ধারের ঘটনা ঘটে না৷ অভিবাসী উদ্ধারের জন্য উত্তর ফ্রান্সের কালে ও ডানকের্ক অঞ্চলের উপকূলগুলো হটস্পট হিসেবে পরিচিত৷ 

পড়ুন>>চ্যানেলে অভিবাসী ঠেকাতে ফ্রান্স-যুক্তরাজ্য নতুন চুক্তি

লো হাভ শহরে প্রায় দেড় বছর প্রশিক্ষণের পর ২০১৯ সালে স্ত্রী ও কন্যাদের দিয়ে গ্রিসের লেসবোস দ্বীপে যান ভূগোলবিদ থেকে উদ্ধারকর্মীতে পরিণত হওয়া এই ফরাসি নাগরিক৷ 

তিনি বলেন, ‘‘আমরা গ্রিসে মরিয়া ক্যাম্প, কারা টেপে ক্যাম্পসহ বিভিন্ন সংবেদনশীল জায়গা অতিক্রম করেছি৷ আমি চাচ্ছিলাম আমার বড় দুই মেয়ে দেখুক ইউরোপের সীমান্তে কী ঘটছে৷’’

গ্রিসে ‘পদ্ধতিগত সহিংসতা’

সদ্য নতুন অভিজ্ঞতায় প্রবেশ করা এই উদ্ধারকারী এনজিও রিফিউজি রেসকিউ-এর দলে যোগ দেন 

রিফিউজি রেসকিউ লেসবস দ্বীপের উত্তরে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম স্কালা সিকামিনাসের থেকে ‘মো চারা’ নামে একটি উদ্ধারকারী নৌকা পরিচালনা করে৷ শতাধিক বাসিন্দার এই সুন্দর ছোট্ট বন্দর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তুরস্কের উপকূল স্পষ্টভাবে দেখা যায়৷

আরও পড়ুন>>‘বহিষ্কার’ ও ‘বৈধতা’ দুটিই বৃদ্ধির পরিকল্পনা ফ্রান্সের নতুন অভিবাসন নীতিতে

কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত, অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবেশপথে শত শত অভিবাসী প্রাণ হারান৷ 

গ্রিক কোস্ট গার্ডের অভিযান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, ‘‘তাদের অভিযান অনেক সহিংস ছিল৷ ইউরোপের সীমান্তে পদ্ধতিগত সহিংসতা সর্বদা কার্যকর থাকে৷’’

গ্রিসের লেসবোস দ্বীপের উত্তরে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম স্কালা সিকামিনাস উপকূলে এনজিও রিফিউজি রেসকিউ'র একটি উদ্ধার অভিযানের দৃশ্য। ছবি: জুলি বুরদা
গ্রিসের লেসবোস দ্বীপের উত্তরে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম স্কালা সিকামিনাস উপকূলে এনজিও রিফিউজি রেসকিউ'র একটি উদ্ধার অভিযানের দৃশ্য। ছবি: জুলি বুরদা


২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, একটি ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এনজিওগুলোকে স্কালা সিকামিনাস গ্রাম ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল৷

আর্নো বানো তখন মানবিক উদ্ধার জাহাজ সী-ওয়াচ ৪-এ চড়ে মধ্য ভূমধ্যসাগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন৷

তিনি মনে করেন, এজিয়ান সাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে খুব বেশি মিল নেই৷

দুই জায়গার পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘গ্রিসে, আমরা উপকূলে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছি৷ সেখানে প্রচুর নৌকাও ছিল৷ বিশেষ করে উপকূলরক্ষীদের টহল নৌকা৷ তারা সেখান থেকে অভিবাসীদের আটকের চেষ্টা করত৷’’

পড়ুন>>“আমার মা জানলে ঘুমাতেন না”

আর্নো বানো যোগ করেন, ‘‘কিন্তু মধ্য ভূমধ্যসাগরের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত৷ আপনি যেখানেই যান না কেন বিশাল জলরাশির সাথে আপনাকে একা লড়াই করতে হবে৷ সরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কিংবা সমন্বয় কেন্দ্রগুলি কখনই অভিবাসীদের সাহায্যে উত্তর দেয় না৷ পাশাপাশি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক লিবিয়ান কোস্ট গার্ডের উপস্থিতিও অভিবাসী ও উদ্ধারকর্মীদের মনে আতংক তৈরী করে৷’’

অন্তহীন যাত্রা

ইটালিতে জর্জা মেলোনির কট্টর ডানপন্থী সরকারের নির্বাচনে জেতা এবং নভেম্বরের শুরুতে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সমুদ্রে বেশ কয়েকটি মানবিক জাহাজ অবরোধের পর থেকে এনজিওগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে৷ উদ্ধার অভিযানে বেঁচে যাওয়াদের নিরাপদ বন্দরে নামার অনিশ্চয়তা স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

আর্নো বানো জানান, ‘‘আমাকে ইতিপূর্বে একটি নিরাপদ বন্দরের জন্য সমুদ্রে বারো দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল৷ এটি ছিল অন্তহীন এবং ভয়ংকর এক যাত্রা!’’

আরও পড়ুন>>ফ্রান্সে পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী অভিবাসীদের বহুভাষী প্ল্যাটফর্ম

তিনি জানান, তিনি সম্ভবত আর সামনের গ্রীষ্মে ভূমধ্যসাগরে যাবেন না৷ 

বর্তমানে তিনি উত্তর ফ্রান্সের ‘বিপর্যয়কর’ পরিস্থিতি খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন৷ কারণ তিনি ২০২১ সাল থেকে এই এলাকায় কর্মরত এসএনএসএম এর উদ্ধারকর্মীদের একজন পূর্ণকালীন প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন৷

তিনি উদ্ধারকারী রাষ্ট্রীয় ও এনজিওগুলোর স্বেচ্ছাসেবকদের সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ দিয়ে উত্তর সাগর ও ইংলিশ চ্যানেলে উদ্ধার কার্যক্রম জোরদার করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন৷ 

তার মতে, ‘‘যখন আপনি কারও জীবন বাঁচান, তখন কতজনের জীবন রক্ষা করছেন সেটি বিবেচ্য নয়৷ এটি অগণিতও হতে পারে৷ আপনি একজনকে বাঁচানোর মানে, পুরো মানবতাকে রক্ষা করার মতো দায়িত্ব পালন করা৷ 

পড়ুন>>২০২৩ সালেও আকাশপথে চ্যানেলে নজরদারি করবে ফ্রন্টেক্স

‘‘এই অভিযানগুলো ক্লান্তিকর৷ কিন্তু আমি এই অসহায়ত্বের অনুভূতি থেকে চোখ ফিরিয়ে না নিয়ে আমার চোখ খোলা রেখে সবকিছু নিয়ে বাঁচতে পছন্দ করি,’’ যোগ করেন আর্নো বানো৷ 


মূল প্রতিবেদন জুলি বুরদা। ফরাসি থেকে ইনফোমাইগ্রেন্টস বাংলায় ভাষান্তর মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ।


এমএইউ/আরআর

























 

অন্যান্য প্রতিবেদন