পশ্চিম আফ্রিকার সেনেগাল ও মরক্কোসহ বিভিন্ন উপকূল থেকে স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছানোর চেষ্টা করে হাজার হাজার অভিবাসী প্রাণ হারিয়েছেন৷ এই বিশাল রূটে চলা অনেক অভিবাসী নৌকা উপকূলে পৌঁছার আগেই নিখোঁজ হয়ে যায়৷ দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও ভুক্তভোগীদের পরিবারগুলো নিহত অথবা নিখোঁজ আত্নীয়দের কোন সন্ধান পান না৷
২০২১ সালের শেষের দিকে আফ্রিকার দেশ গিনি থেকে মরোক্কোয় যান ১৫ বছর বয়সি কিশোর মামাদু এবং তার চাচাত ভাই কান্দিয়া৷ তাদের লক্ষ্য ছিল মরোক্কো থেকে ২৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত স্পেনের দ্বীপপুঞ্জে প্রবেশ করে ইউরোপে যাওয়া৷
কিন্তু সেই কিশোর মামাদুর স্বপ্ন পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে৷ দুই কিশোর একসাথে যাত্রার কথা থাকলেও নৌকায় উঠার সময় পাচারকারীরা তাদের দুটি ভিন্ন নৌকায় তুলে দেয়৷ কিছুদূর যাওয়ার পর মরক্কো উপকূলে সমুদ্রে নিখোঁজ হন কিশোর মামাদু৷ অপরদিকে ভয়ংকর এক যাত্রা পেরিয়ে স্পেনের তেনেরিফ দ্বীপে পৌঁছাতে সক্ষম হোন অপর কিশোর কান্দিয়া৷
আরও পড়ুন>>স্পেন সীমান্তের কাছে ২৫ অভিবাসীকে আটক করল মরক্কো
তবে মামাদুর অপেক্ষায় এখনো দিন গুনছেন তার পরিবার৷ তাদের বিশ্বাস হয়ত একদিন ফিরে আসবে মামাদু৷ মামাদুর আরেক চাচাত ভাই রাবিলো ডায়ালো কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান যে, তাদের ভাই নেই৷
তবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তারা অন্তত মামাদুর লাশ খুঁজে পেতে চান যেন তাকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে দাফন করা সম্ভব হয়৷
মামাদু এবং কান্দিয়ার রওয়ানা হওয়ার এক মাস আগে মরক্কোতে পৌঁছেছিলেন রাবিলো৷ মামাদু এবং কান্দিয়ার সাথেই ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার ইচ্ছা ছিল রাবিলোর৷
পড়ুন>> মরক্কোতে দুই সন্দেহভাজন মানবপাচারকারী আটক
রাবিলো ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান, ‘‘সেই সময় আমার কাছে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না৷ মরোক্কো লাইওন শহর থেকে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে যেতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ইউরো খরচ হয়৷’’
যার ফলে রাবিলো ডায়ালো তার মৃত চাচাতো ভাইয়ের সমুদ্র যাত্রার সময় উপস্থিত থাকতে পারেননি৷
যেভাবে নিখোঁজ হন মামাদু
মরক্কোতে একজন অনিয়মিত অভিবাসী হওয়ায় রাবিলো তার চাচাত ভাই মামাদু নিখোঁজে পরে গিনি দূতাবাসের কাছে যাওয়ার সাহস করেনি৷
তিনি সেই পাচারকারীদের কাছে গিয়েছিলেন যারা তার দুই চাচাতো ভাইয়ের জন্য নৌকাযাত্রার আয়োজন করেছিলেন৷
পরবর্তী তথ্য অনুসারে রাবিলো জানতে পারেন, ১ ডিসেম্বর মরোক্কো উপকূলে একটি নৌকাডুবি হয়েছিল৷ নৌকাটির কিছু যাত্রী বেঁচে গিয়েছিল এবং অন্যরা মারা গিয়েছিল৷
আরও পড়ুন>>অভিবাসন আইন সহজ করলো স্পেন
নৌকা ডুবে যাওয়ার আগে একজন তরুণ বমি করছিল এবং সমুদ্রে নৌকার বারবার নড়াচড়ার কারণে খুব অসুস্থ্য লাগছিল বলে জানতে পারেন রাবিলো৷
পাচারকারীরা জানান, উক্ত তরুণ এক পর্যায়ে পানিতে পড়ে যায়৷ কিন্তু রাবিলো নিশ্চিত হতে পারেন না এটি তার চাচাত ভাই মামদু কি না৷ কারণ একই বয়সের শত শত তরুণ প্রতিদিন ক্যানারু রুটে যাত্রা করেন৷
তার মতে, নিখোঁজ অভিবাসীদের শত শত পরিবার তাদের আত্মীয়ের সন্ধানে অপেক্ষায় থাকেন৷ কেউ জানে না কার ভাগ্যে কী ঘটেছে৷
পড়ুন>> স্পেন: মেলিলা সীমান্তে নজিরবিহীন সংঘর্ষে নিহত অন্তত ২৩ অভিবাসী
স্প্যানিশ এনজিও ক্যামিনান্দো ফ্রন্টেরাস অনুসারে, শুধুমাত্র ২০২২ সালের প্রথমার্ধে মরক্কো এবং মৌরিতানীয় উপকূল থেকে স্পেনে পৌঁছানোর চেষ্টা করার সময় ৯৭৮ জন নিখোঁজ হয়েছে৷
আছেন নারীরাও
ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ থেকে আফ্রিকান উপকূলগুলিকে আলাদা করা স্থানটি বিশাল৷ এখানে কোন নৌকা ডুবে গেলে বেশিরভাগ অভিবাসীদের মৃতদেহ পাওয়া যায় না৷ শুধুমাত্র নৌকায় থাকা এবং স্প্যানিশ বা মরোক্কান উপকূলরক্ষীদের হাতে উদ্ধার হওয়াদের মৃতদের পাওয়া সম্ভব হয়৷
অনেক পুরুষ ও তরুণ অভিবাসীর সাথে নারী অভিবাসীরও মরোক্কো থেকে ক্যানারিতে প্রবেশ করতে গিয়ে নিখোঁজ হচ্ছেন৷
ক্যামেরুনের নাগরিক অ্যালায়েন্স ম্যাপেগ্যাং৷ তার মেয়ে ইয়ামেনি ২০২০ সালে এক বন্ধুর সাথে মরক্কো গিয়েছিলেন৷ কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মেয়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার পর জীবনের নির্ঘুম দিন পার করছেন এই মা৷
মরোক্কোতে এক বছর কাজ করার পর ২২ বছর বয়সি তরুণী ইয়ামেনি ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷
আরও পড়ুন>>‘ডিজিটাল ভিসা’ চালুর পরিকল্পনা স্পেনের
২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি একটি অস্থায়ী নৌকায় তার যাত্রা করার কথা ছিল৷ কিন্তু ইয়ামেনির এক বন্ধু জানান অন্য ঘটনা৷
তার মতে, একটি গাড়ি তাদেরকে কাসাব্লাঙ্কা থেকে সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যাচ্ছিল৷ কিন্তু পথে গাড়ি থামলে ইয়ামেনিকে বের হতে বলা হয়৷ পরবর্তীতে তাকে একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে অন্যান্য অনেক তরূণী ছিল৷ সেখানে যাওয়ার পর তার ফোন বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছিল৷ তারপর থেকে তার প্রেমিক বা তার মা কেউই ইয়ামেনির সাথে আর যোগাযগো করতে পারেন নি৷
অ্যালায়েন্স ম্যাপেগ্যাং উদ্বেগ প্রকাশ করে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘আমি সন্দেহের মধ্যে আছি৷ আমার মেয়েকে খুঁজে পেতে আমার সত্যিই সাহায্য দরকার৷ আমি পাচারকারীদের সাথে যোগাযোগ করেছি৷ কারণ আমি মরক্কোতে এমন কাউকে চিনি না যিনি আমাকে সাহায্য করবেন৷’’
নেই সরকারি উদ্যোগ, ভরসা এনজিওগুলো
অ্যালায়েন্স ম্যাপেগ্যাং এবং রাবিলো ডায়ালোর মতো ভুক্তভোগীদের পরিবারগুলোকে সাহায্য করার জন্য এনজিও ক্যামিনান্দো ফ্রন্টেরাস সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তাদের উদ্যোগকে বহুগুণ বাড়িয়েছে৷
পড়ুন>> অনিয়মিত অভিবাসন ঠেকাতে স্পেন-মৌরিতানিয়া চুক্তি স্বাক্ষর
ক্যামিনান্দো ফ্রন্টেরাসের প্রতিষ্ঠাতা হেলেনা ম্যালেনো গারজন ইনফোমাইগ্রেন্টসকে ব্যাখ্যা করেন, ‘‘২০০৭ সাল থেকে সমুদ্রে দুর্দশাগ্রস্ত নৌকাগুলিকে সতর্ক করার জন্য আমাদের একটি টেলিফোন প্লাটফর্ম সক্রিয় রয়েছে৷ এই প্লাটফর্মে প্রাপ্ত তথ্যগুলো আমরা উদ্ধার পরিষেবাগুলির সাথে সমন্বয় করি৷"
তিনি আরও যোগ করেন, "আমরা কতগুলি মৃতদেহ নিখোঁজ হয়েছে, কতগুলি পাওয়া গেছে তাও পর্যবেক্ষণ করি৷ এটির সাহাযে অনেক তথ্য আমরা নিখোঁজদের পরিবারগুলোকে দিতে সক্ষম হই৷ উদাহরণস্বরুপ, অমুক তারিখের নৌকার ব্যাপারে আমাদের বেশ কিছু তথ্য রয়েছে৷’’
সম্প্রতি এনজিওটি একটি পারিবারিক সহায়তা প্লাটফর্মও তৈরি করেছে৷ এছাড়া ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে সহায়তার জন্য একটি নির্দেশিকাও তৈরি করা হয়েছে৷
আরও পড়ুন>>ফ্রান্স, স্পেন, গ্রিসের কাছে সহযোগিতার আহ্বান উদ্ধারকারী জাহাজের
হেলেনা ম্যালেনো গারজন বলেন, ‘‘আমরা পরিবারগুলিকে কর্তৃপক্ষের কাছে যাওয়ার পরামর্শ প্রদান করি৷ কখনও কখনও আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করার জন্য তাদের সাথে যাই৷ মরক্কো এবং স্পেনে মৃতদেহ শনাক্ত করতে আমরা পরিবারের সাথে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সহায়তা করি৷’’
কিন্তু এ ব্যাপারে মরক্কো এবং স্প্যানিশ সরকার উভয়ের উদ্যোগ এখনও অপর্যাপ্ত৷
রাবাত এই ইস্যুতে আগ্রহী নয় বলে মনে হচ্ছে এবং স্পেনে সীমান্তে নিহত বা নিখোজদের সনাক্ত কর্তে একটি জাতীয় ব্যবস্থার অনুপস্থিতির ফলে পরিবারগুলোকে স্থানীয় থানার উপর নির্ভর করতে হয়৷ যা পুরো ব্যবস্থাকে অসম করে তোলে৷
পড়ুন>>মরক্কো পুলিশের গুলি নিহত সাব-সাহারান আফ্রিকার অভিবাসী
আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির মতো বেশ কিছু সংস্থা সরকারগুলোর চেয়ে অনেক ভালো কাজ করেন৷ তারা অভিবাসীদের মৃতদেহ খুঁজে পেতে পরিবারগুলোকে সাহায্যের চেষ্টা করে৷
হেলেনা ম্যালেনো গারজন সীমান্তে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের প্রতি বৈষম্যের নিন্দা জানান৷
মূল প্রতিবেদন জুলিয়া দ্যুমো। ইনফোমাইগ্রেন্টস বাংলায় ভাষান্তর মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ।
এমএইউ/আরআর