রুয়ান্ডায় অভিবাসী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের পাঠিয়ে দেয়ার নীতি নিয়ে বিতর্ক চলছে৷ যুক্তরাজ্য সরকারের আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠানোর পরিকল্পনা আইনসম্মত বলে জানাল যুক্তরাজ্যের হাইকোর্ট৷
হাইকোর্ট রায় দিয়েছে, যুক্তরাজ্য থেকে কয়েকজন আশ্রয়প্রার্থীকে রুয়ান্ডায় পাঠানোর ব্রিটিশ সরকারের যে পরিকল্পনা, সেটি আইনসম্মত। এই পরিকল্পনা শরণার্থী কনভেনশন বা মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে না।
প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক ছোট নৌকায় রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী আগমন বন্ধ করার বিষয়ে বারবার সরব হয়েছেন৷ আদালতের এই রায়টি অত্যন্ত জরুরি বার্তা দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
অনিয়মিত অভিবাসন যুক্তরাজ্যের জন্য বহমান রাজনৈতিক সমস্যা৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার পর সীমান্তে আরো কড়া নজরদারি জারি রেখেছে যুক্তরাজ্য৷ এই বছর শুধুমাত্র ছোটো নৌকায় করে ইউরোপীয় প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে চ্যানেল পাড়ি দেওয়া ৪০ হাজারের বেশি অভিবাসীদের কীভাবে সামলানো করা যায় তা নিয়ে আলোচনা চলছে সব মহলে৷
অভিবাসীদের আগমন মোকাবেলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের রক্ষণশীল সরকার এপ্রিল মাসে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত রুয়ান্ডায় অভিবাসীদের পাঠানোর একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করে৷
আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডা পাঠাতে দেশটির সঙ্গে গত এপ্রিলে একটি চুক্তি করে যুক্তরাজ্য সরকার৷ এ নিয়ে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা সমালোচনা করলেও ব্রিটিশ সরকারের দাবি, এতে অনিয়মিত পথে অভিবাসন বন্ধ হবে এবং মানবপাচার নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয়া সম্ভব হবে৷ তবে এই চুক্তির পরও ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন থামেনি৷
এদিকে নির্বাসনের ফ্লাইটগুলি যুক্তরাজ্যের আদালতে এবং ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে একাধিক আইনি চ্যালেঞ্জের কারণে বাধার মুখে পড়ে৷
আশ্রয়প্রার্থীদের একটি ছোট গ্রুপের প্রথম ফ্লাইট গত জুনে যুক্তরাজ্য থেকে যাত্রা করার কথা ছিল৷ কিন্তু স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের শেষ মুহূর্তের নিষেধাজ্ঞার পরে এটি বাতিল করা হয়৷
এই চুক্তির অধীনে যুক্তরাজ্য কিছু অভিবাসীকে পূর্ব আফ্রিকার দেশে স্টোওয়ে বা নৌকায় করে যুক্তরাজ্যে আসার পরিকল্পনা করেছে, যেখানে তাদের আশ্রয়ের দাবিগুলি যাচাই-বাছাই করা হবে৷ আশ্রয় মঞ্জুর হওয়া আবেদনকারীরা যুক্তরাজ্যে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে রুয়ান্ডায় থাকবেন৷
এপ্রিল মাসে হওয়া চুক্তির অধীনে ব্রিটেন রুয়ান্ডাকে ১২০ মিলিয়ন পাউন্ড (১৪৬ মিলিয়ন ডলার) প্রদান করেছে৷ তবে এখনো কাউকে দেশে পাঠানো হয়নি৷ ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ হিউম্যান রাইটস এই পরিকল্পনাটিতে ‘সত্যিকারের ঝুঁকি’ রয়েছে এমন রায় দেয়৷
ব্রিটেন সরকারের যুক্তি, চ্যানেলের ব্যস্ত শিপিং লেনের এই বিপজ্জনক পথে অভিবাসীদের শামিল করা মানবপাচারকারী দলকে বাধা দেবে এই চুক্তি৷
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলির যুক্তি ছিল, হাজার হাজার মাইল দূরে এমন একটি দেশে মানুষকে পাঠানো বেআইনি, অকার্যকর এবং অমানবিক৷ তারা রুয়ান্ডার দুর্বল মানবাধিকার রেকর্ডেরও উল্লেখ করেছিল যার মধ্যে সরকার বিরোধীদের নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ রয়েছে৷
রুয়ান্ডায় গণহত্যার ইতিহাসও রয়েছে৷ ১৯৯৪ সালে আট লাখের বেশি লোককে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে৷ যুক্তরাজ্য সরকার যুক্তি দিয়েছে, দেশটি তখন থেকে স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য কাজ করে চলেছে৷ সমালোচকরা বলেন, রাজনৈতিক দমন-পীড়নের পরিবর্তে স্থিতাবস্থা ফেরানো হয়েছে সে দেশে৷
সাবেক প্রধানমন্ত্রী জনসন এই নীতিকে ‘অবৈধ ক্রস-চ্যানেল পাচারের’ সমস্যা সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছিলেন৷ জনসনের পর তার উভয় উত্তরসূরি, প্রথমে লিজ ট্রুস এবং তারপর ঋষি সুনক নীতিটি মেনে চলার অঙ্গীকার করেন৷
সুনকের স্বরাষ্ট্রসচিব সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান বলেন, অভিবাসী বহনকারী একটি বিমান কিগালির উদ্দেশে রওনা দিতে দেখতে পারা তার ‘স্বপ্ন:৷
টাইমস অফ লন্ডনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে স্বরাষ্ট্রসচিব ব্র্যাভারম্যান চ্যানেল ক্রসিংকে ‘আমাদের দক্ষিণ উপকূলে আক্রমণ’ বলে উল্লেখ করেন৷ তার কথায়, ‘ব্রেক্সিট ভোটের অংশ ছিল অভিবাসন, আমাদের সীমানা নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের দেশে কারা আসে সেই প্রশ্নে সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে আনার বিষয়টি দেখা উচিত৷ কিন্তু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়া যায়নি৷
শনিবার প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে, ব্র্যাভারম্যান বলেন, মানবাধিকার সম্পর্কিত ইউরোপীয় কনভেনশন এবং জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন, উভয়ই রুয়ান্ডা নীতিতে বাধা দিয়েছে৷
কী পরিস্থিতি?
চলতি বছর ৪৪ হাজারেরও বেশি অভিবাসী চ্যানেল দিয়ে ব্রিটেনে এসেছেন এবং বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছেন৷ গত সপ্তাহে প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মাঝে একটি নৌকা ডুবে চার জন প্রাণ হারান৷
জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইটালিসহ অনেক ইউরোপীয় দেশের তুলনায় কম আশ্রয়প্রার্থী গ্রহণ করে যুক্তরাজ্য৷ তবে সারাবিশ্ব থেকে হাজার হাজার অভিবাসী চ্যানেল পার হওয়ার আশায় প্রতি বছর উত্তর ফ্রান্সে আসেন৷ কেউ কেউ যুক্তরাজ্যে পৌঁছাতে চায় কারণ সেখানে তাদের বন্ধু বা পরিবার আছে৷ ইংরেজিতে কথা বলা বা কাজ খুঁজে পাওয়া সহজ বলে মনে করেন অনেকে৷
সরকার অনুমোদিত নয় এমন পথ পেরিয়ে আসা সমস্ত অভিবাসীদের বিতাড়িত করতে চায় যুক্তরাজ্য৷
অভিবাসীদের প্রবাহ বৃদ্ধি এবং যুক্তরাজ্যের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, করোনা মহামারি সবমিলিয়ে কেন্দ্রগুলিতে আটকে রয়েছেন একাধিক মানুষ৷ এই কেন্দ্রগুলিতে ডিপথেরিয়া এবং অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে৷
আরকেসি/আরআর (এপি. রয়টার্স, এএফপি)