তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে গান শোনা বা অনুষ্ঠান করা অপরাধ। ২০২১ সালের আগস্টে কট্টর ইসলামপন্থিরা কাবুলে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে আফগানিস্তানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মিউজিক বন্ধ হয়ে গিয়েছে। স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে পর্তুগালে আশ্রয় পেয়েছেন। নির্বাসনে থাকার ফলে একাধিক সমস্যা সত্ত্বেও, তারা স্কুলকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। আফগান সংগীত ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে চান তারা।
উত্তর পর্তুগালের ব্রাগায় একটি বড় কনসার্ট হলের মঞ্চে, সাতজন কিশোর রবাব, সেতার, তবলা এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী আফগান যন্ত্র বাজিয়ে অনুষ্ঠান করছিল এই মাসখানেক আগে। তারা আফগানিস্তান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মিউজিক (আনিম) অর্থাৎ দেশের একমাত্র মিউজিক স্কুলে সংগীতশিক্ষার পাঠ নিচ্ছিল। ২০২১ সালে তারা পর্তুগালে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। চলতি বছরের নভেম্বরে দ্বিতীয় কনসার্ট ছিল তাদের। একটি বড় মানবিক সংস্থার দাতাদের উপস্থিতিতে তারা পারফর্ম করছিল।
১৪ বছরের হাদিয়া সন্তুর সহ তারের একটি যন্ত্র বাজাচ্ছিল। তার কথায়, "যখন আমি মঞ্চে থাকি আর দর্শক আমার প্রশংসা করে, সত্যি খুব আনন্দ পাই।" আনিমের পরিচালক আহমেদ সরমস্ত তার ছাত্রদের পারফরম্যান্স দেখছেন। তিনি বলেন, "তারা আমার সন্তানের মতো, আমি তাদের বড় হতে দেখেছি। কেউ কেউ ছয়, সাত বা দশ বছর আগে স্কুলে যোগ দিয়েছে।"
'তালেবানেরা স্কুলে ঢুকে যন্ত্রগুলো ভেঙে ফেলেছিল'
তালেবান কাবুলের দখল নেয়ার সময় আহমদ সরমস্ত তার ছাত্র ও কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার সময় "আতঙ্কের" কথা বলছিলেন। তার কথায়, "আমি অনেক দেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। পর্তুগালই প্রথম এবং একমাত্র দেশ যেটি যারা অনুরোধের উত্তর দিয়েছিল। পর্তুগাল শুধুমাত্র [আমাদের ছাত্র এবং কর্মচারীদের] আশ্রয় দিয়েছে এমন নয়। তারা এই দেশে আমাদের স্কুলটি নতুন করে তৈরি করার সুযোগ দিয়েছে। মোট ২৮৪ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল।"
সরমস্ত একজন বিশিষ্ট নৃতাত্ত্বিক সংগীতবিদ। তার লক্ষ্য হলো, সমৃদ্ধ আফগান সংগীত ঐতিহ্য রক্ষা করা। এ জন্য তিনি কাবুল থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা সত্ত্বেও এই মিউজিক স্কুলটি চালিয়ে যেতে চান।
লিসবনের একটি সাবেক সামরিক হাসপাতালে নয় মাস ছিলেন তারা। পরে পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষ আনিমের সদস্যদের দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম শহর ব্রাগাতে স্থানান্তরিত করে। এই স্কুলের ছাত্রী ১৩ বছরের জোহরা এবং ফরিদা কর্তৃপক্ষের দেয়া একটি অ্যাপার্টমেন্টে তাদের চাচার সঙ্গে থাকে। মিউজিক ইনস্টিটিউটের অন্য পরিবারগুলির সঙ্গে মিলেমিশে এখানে থাকে তারা। ২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর আফগানিস্তান থেকে পর্তুগালে নিয়ে আসা দুই ছাত্রী সম্পর্কে চাচাতো বোন।
সেই দিন, পরিবারের বাকি সদস্যরা তাদের সঙ্গে কাবুল বিমানবন্দরে গিয়েছিল। ফরিদা তার কম্পিউটারে প্রিয়জনদের ছবি দেখিয়ে বলছিল, "অসম্ভব চাপে ছিলাম আমরা। খুব আবেগপূর্ণ মুহূর্ত ছিল সেটা। প্রথমবার আমি আমার পরিবারকে ছেড়ে এসেছিলাম।"
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা সত্ত্বেও পর্তুগালে আসাই দুই কিশোরীর কাছে একমাত্র বিকল্প বলে মনে হয়েছিল। ফরিদা বলেন, "আমরা এতটাই ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল যে কোনো মুহূর্তে তালেবানরা আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়বে এবং চোখের সামনে আমাদের যন্ত্রগুলো ভেঙে ফেলবে। আমাদের প্রাণহানির ঝুঁকি ছিল, এই কারণে আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছিল।"
জোহরা বলে, "তালেবান তো মেয়েদের স্কুলে যেতে নিষেধ করে। তাই এটা স্পষ্ট ছিল তারা আমাদের মিউজিক স্কুলে যেতে দিত না। তালেবানরা আমাদের স্কুলে ঢুকে সেখানকার যন্ত্রগুলো ভেঙে দিয়েছিল।"
পর্তুগালে নতুন জীবন গড়ছেন
দুই কিশোরী এখন তাদের বেশিরভাগ অবসর সময়ে মহড়ায় ব্যস্ত থাকেন। ফরিদার জন্য একটি বেহালা এবং জোহরার জন্য একটি ট্রাম্পেট রয়েছে। তারা পেশাদার সংগীতশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। অভিনয় করতে চান, লিখতেও। ইতিবাচক কাজের জন্য আফগানিস্তান নয়, ইউরোপকেই অনেক ভাল বলে মনে হয় তাদের। তবে জন্মভূমির পিছুটান তো আছে।
জোহরা বলেন, “তালেবানরা চলে গেলে আমরা ফিরে যেতে চাই। দেশে সংগীত ফিরিয়ে আনব এবং আমরা যা শিখেছি তা শিশুদের শেখাব।”
১৮ বছরের কম বয়সি অন্যান্য আনিম ছাত্রদের মতো, তারা ব্রাগার হাই স্কুলে পড়েছেন। আপাতত, তারা শুধুমাত্র ইংরেজি, পর্তুগিজ, নাগরিক শিক্ষা এবং সংগীত শিক্ষার ক্লাসে অংশ নেয়। নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
জোহরার কথায়, "আমি পর্তুগিজ শিখছি মন দিয়ে। যদি ভাষা আয়ত্ত করতে পারি, তাহলে আরো অনেক বিষয় পড়তে পারব।"
প্রাপ্তবয়স্কদের কাছে নির্বাসন আরো তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। মোহাম্মদ কাম্বার নওশাদ, একজন তরুণ সুরকার এবং সঙ্গীতজ্ঞ। কাবুলের আনিমে তিনিও যুক্ত ছিলেন। ঘরে মা, স্ত্রী, তিন সন্তান এবং তার ভাইপো রয়েছে। সবমিলিয়ে প্রতি মাসে এক হাজার ৫০ ইউরো পান তিনি। তার কথায়, "আমরা এই টাকায় শুধু খেতে পারি, অন্য কিছু করতে পারি না। পর্তুগালে কোনো চাকরি নেই।"
এক বছরে, তার আর্থিক সহায়তা শেষ হয়ে যাবে এবং তাকে ৬০০ ইউরো ভাড়া দিতে হবে। কিছু অধ্যাপক বা ছাত্র ভাল সুযোগের কারণে পর্তুগাল ছেড়ে চলে গিয়েছে। এক বছর আগে পর্তুগালে আসা এই দলের প্রায় অর্ধেক সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স এবং সুইজারল্যান্ড বা ইউরোপের অন্যান্য দেশে চলে গিয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
মোহাম্মদ কাম্বার নওশাদ ইতিমধ্যে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন, তবে তিনি আশা করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্তুগালে তার অবস্থার উন্নতি হবে। তিনি এক মাসেরও বেশি সময় আনিমের একজন কর্মচারী ছিলেন। শিক্ষক এবং কন্ডাক্টর হিসাবে দায়িত্ব পালনের জন্য মাসিক হাজার ইউরো বেতন পান। সপ্তাহে বেশ কয়েকবার, তিনি স্কুলের কিশোরদের মহড়ার নেতৃত্ব দেন।
ব্রাগা কনজারভেটরিতে অনুশীলন করেন শিল্পীরা। কিন্তু আহমেদ সরমস্ত দ্রুত নিজেদের মহড়ার জায়গা পেতে চান। তার কথায়, "আমাদের অর্কেস্ট্রা দল বেশ বড়। ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের একটি সমাহার রয়েছে এখানে। আমাদের নিজস্ব গায়কের দল রয়েছে। তাই আফগান সংগীতের ঐতিহ্য বজায় রাখতে, সবকিছু সুরক্ষিত রাখতে এই সমস্ত দলের অনুশীলনের জন্য একটি জায়গা প্রয়োজন।"
ক্লায়রে দেবুয়সের/আরকেসি