আয়ারল্যান্ডকে চলতি বছরের মধ্যে ৮০ হাজারেও বেশি নতুন আশ্রয়প্রার্থীকে গ্রহণের প্রস্তুতি নিতে হবে। দেশটির ইন্টিগ্রেশন মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ডাবলিনে প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ করেছে তিন শতাধিক বিক্ষোভকারী।
আয়ারল্যান্ডের ইন্টিগ্রেশন মন্ত্রী জো ও'ব্রায়েন সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ২০২৩ সালে কমপক্ষে ৮০ হাজার নতুন আশ্রয়প্রার্থী ও অভিবাসীকে নেয়ার জন্য আয়ারল্যান্ডের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
গত বছর আয়ারল্যান্ডে ৮৩ হাজার ৮১৪ জন নতুন অভিবাসী এসেছেন যাদের মধ্যে ৭০ হাজারেও বেশি ইউক্রেনীয় রয়েছেন। আশ্রয়প্রার্থী ও অভিবাসী চাপে সংকটের মুখে রয়েছে দেশটির বর্তমান আশ্রয় ব্যবস্থা। এ নিয়ে সরব জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরও।
ও'ব্রায়েনের বরাত দিয়ে আইরিশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট জানিয়েছে, “চলতি বছরও অনুরূপ সংখ্যার জন্য পরিকল্পনা করা ‘বুদ্ধিমানের কাজ’ হবে।”
আরও পড়ুন>> জীবন বাঁচিয়ে ফৌজদারি মামলার কোপে উদ্ধারকারীরা
তিনি বলেন, “আমি মনে করি না এই বছর যুদ্ধ শেষ হতে চলেছে। আমি মনে করি আমাদের পরিকল্পনা এই ভেবে করা উচিত যে এই বছরও যুদ্ধ চলবে।”
গ্রিন পার্টির সাংসদ ও'ব্রায়েনকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইন্টিগ্রেশনের উপর বিশেষ মনোযোগ দিতে বর্তমান পদে নিযুক্ত করা হয়। তিনি তার রাজনৈতিক কেরিয়ারের আগে দীর্ঘদিন ইন্টিগ্রেশন, অভিবাসন এবং গৃহহীনতার নিয়ে পেশাদার কাজ করেছেন।
চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ
নতুন ঘোষণার পাশাপাশি আইরিশ সরকার অভিবাসীদের জন্য একটি তথ্য প্রচারও জারি রেখেছে। ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য অভিবাসীদের আয়ারল্যান্ডে না আসতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
বেশ কিছু আইরিশ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশটির আশ্রয় কাঠামো আগত অভিবাসীদের সংখ্যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। অনেক অভিবাসীকে তাঁবুতে এবং হোটেলের আবাসনে রাখা হচ্ছে।
পড়ুন>> ইউরোপের সীমান্তে পুশব্যাক বন্ধ করা হবে: ফ্রন্টেক্স প্রধান
সম্প্রতি, আয়ারল্যান্ডের হোটেল মালিক সমিতির সদস্যরা আইরিশ টাইমসকে বলেছেন, তারা মার্চ মাসের মধ্যে অভিবাসী, আশ্রয়প্রার্থী এবং শরণার্থীদের পর্যায়ক্রমে হোটেল থেকে সরানোর আশা করছেন। যাতে তারা গ্রীষ্মে পর্যটকদের জন্য তাদের হোটেলগুলি আবার খুলতে পারেন।
১১ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে,আইরিশ টাইমস জানিয়েছে, বর্তমানে সারা দেশের হোটেল এবং গেস্ট রুমগুলি সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে প্রায় ১৪ হাজার শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীকে আবাসন দিচ্ছে।
আইরিশ ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি আইটিআইসি-র প্রধান নির্বাহী ইওগান ও'মারা ওয়ালশ আইরিশ টাইমসকে বলেছেন, “অনেক হোটেল তাদের চুক্তি পুনরায় নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ এসব কাঠামো দীর্ঘদিন ধরে শরণার্থীদের আবাসনের জন্য উপযুক্ত নয়।”
ও'মারা ওয়ালশ বলেছেন, “সরকারের উচিত, দ্রুত একটি ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে আসা। হোটেলগুলিতে থাকার ব্যয় সরকার বহন করলেও পর্যটকরা অবশ্যই আশ্রয়প্রার্থীদের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে। যা একটি এলাকার অন্যান্য ব্যবসায়ীদের জন্যেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।”
অভিবাসীবিরোধী বিক্ষোভ
গত সপ্তাহান্তে রাজধানী ডাবলিনে অন্তত ৩৫০ জন নাগরিক অভিবাসী বিরোধী মিছিল করেছে।
ইইউ থেকে বেরিয়ে যেতে ব্রিটেনের পক্ষে প্রচারণা চালানো কট্টর ডানপন্থি ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ নাইজেল ফারাজ ১৮ জানুয়ারি টুইটারে লিখেন, “আইরিশরা কথা প্রতিবাদ করছে। বিপুল সংখ্যক পুরুষ আশ্রয়প্রার্থীর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে তরুণ প্রজন্ম।”
আরও পড়ুন>>আয়ারল্যান্ডে নিয়মিত হচ্ছেন অনথিভুক্ত বাংলাদেশিরা
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা ‘আয়ারল্যান্ড আইরিশদের জন্য’ এবং ‘আইরিশদের জীবন গুরুত্বপূর্ণ’ এমন স্লোগান দিয়েছে।
একজন ব্যক্তি গার্ডিয়ানকে বলেন, বিক্ষোভটি বর্ণবাদ নিয়ে নয়। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এখান তাদের [অভিবাসীদের] জন্য কোনো জায়গা নেই। তিনি এটি মানবেন না।"
অন্যান্য অনেক দেশের মতো, আয়ারল্যান্ডও করোনা মহামারী পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়েছে৷ আবাসন এবং গৃহহীনতার সংকট রয়েছে৷ ফলে ইউক্রেনীয়দের এবং অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীদের স্থান দিতে নাভিশ্বাস উঠছে৷
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, অভিবাসীরা অগ্রাধিকারমূলক আচরণ পায় এমন অভিযোগকে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক মহল থেকে উসকে দেয়া হয়েছে।
দেশটিতে অল্পবয়সী পুরুষ শরণার্থীর সংখ্যাও কিছু প্রতিবাদকারীদের ভাষ্যে সমস্যা হিসেবে উঠে এসেছে। তাদের দাবি, এর ফলে তারা ‘নিরাপদ"’নয়।
পড়ুন>> আয়ারল্যান্ডের বিতর্কিত আশ্রয় পদ্ধতি বন্ধে এনজিওগুলোর জোট
বিক্ষোভে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন বলেছেন, অনেক অঞ্চলের ক্ষেত্রে রাতে মেয়েরা বাইরে যেতে ভয় পায় কারণ তাদের ধারণা এত বেশি সংখ্যক যুবক ঘুরে বেড়ানো তাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
যদিও আয়ারল্যান্ড অভিবাসীদের জন্য নিজেকে একটি স্বাগত এবং উন্মুক্ত দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। দেশটির নিজস্ব অভিবাসনের ইতিহাসের কারণে এটি হয়ে থাকতে পারে।
কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কয়েক হাজার আইরিশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডসহ সারা বিশ্বের নানা জায়গায় অভিবাসী হয়েছে।
বর্তমানে, আয়ারল্যান্ড প্রায় ৭৩ হাজার অভিবাসীর বাসস্থান। তাদের মধ্যে প্রায় ৫৪ হাজার ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থী এবং ১৯ হাজার অন্যান্য দেশ থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থী ও অভিবাসী।
২০২১ সালের তুলনায় অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) মন্তব্য করেছেন, “আয়ারল্যান্ডের বর্তমান আশ্রয় ব্যবস্থা উদ্বেগজনক।”
বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ইউএনএইচসিআর এর আয়ারল্যান্ড প্রধান এন্ডা ও'নিল টুইট করে বলেন, আশ্রয় ব্যবস্থা ভেঙে পারে বলে মনে হচ্ছে। দ্রুত কোনো উদ্যোগ না নেয়া হলে অনেক আশ্রয়প্রার্থী গৃহহীন হয়ে পড়বেন।
ও'নিল সরকারের ঊর্ধ্বতন স্তর থেকে একটি জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন>> শরণার্থী ভিসার নিয়মে বদল আয়ারল্যান্ডের
সমতা, একীকরণ এবং যুবকল্যাণ দপ্তরের আইরিশ মন্ত্রী, রডারিক ও’গর্মানও গত সপ্তাহে স্বীকার করেছেন, আগামী কিছু দিনের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলি ভর্তি হয়ে যাবে।
ও’গর্মান আরও যোগ করেছেন, উপযুক্ত আবাসন খোঁজার ক্ষেত্রে সরকারকে শিশুদের এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিবারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীরা খাবার খেতে বিশেষ ভাউচার বা টিকিট পাবেন এবং বাসস্থানে জায়গা খালি হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।”
মন্ত্রী আশা করছেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে নতুন আবাসন পাওয়া যাবে৷ মার্চ এবং এপ্রিল থেকে একটি নতুন সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ এই সময়ে অনেক হোটেল সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি নবায়ন করতে অস্বীকার করে পর্যটকদের জন্য হোটেলগুলি খুলে দিতে পারে।
এমএইউ/আরকেসি