ছয় বছর আগে কিশোর বয়সে গাম্বিয়া থেকে পালিয়ে আসেন সিডি সাইদিখান নামের এক অভিবাসী। এখন জার্মানিতে রয়েছেন তিনি। তরুণ অভিবাসীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে এবং আত্মবিশ্বাস জোগাতে সাহায্য করছেন৷ অভিবাসীদের ভরসা দেয়ার পাশাপাশি অভিবাসনের কঠোর বাস্তব দিকগুলিও তুলে ধরছেন তিনি। পরবর্তীতে রাজনীতির আঙিনাতেও পা রাখতে চান।
গাম্বিয়ায় থাকার সময় সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সাইদিখান। কিশোর বয়সেই তিনি স্থানীয় রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার নেয়া কয়েকটি সাক্ষাৎকার যখন "ভাইরাল হলো", তখনই সমস্যার শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জামেহের নেতৃত্বাধীন সরকারের নজরে পড়েন তিনি। 'কুখ্যাত' প্রেসিডেন্টের রোষ থেকে বাঁচতে প্রতিবেশী দেশ সেনেগালে পালিয়ে যান সাইদিখান।
১৬ বছর বয়সে সেনেগাল, তারপর মালি, বুরকিনা ফাসো, নাইজার হয়ে লিবিয়া পৌঁছান। সেখানে এক মাস কাটিয়ে তিনি ইউরোপে পালিয়ে আসেন।
তিনি ইনফোমাইগ্র্যান্টসকে বলেন, "আমরা ভূমধ্যসাগর হয়ে আসার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। নৌকা ডুবে ৪০ জনেরও বেশি লোক মারা যায়।" একটি বাণিজ্যিক জাহাজ তাদের সাহায্যে করতে এগিয়ে আসে। সাঁতার কাটতে না পারলেও সাইদিখান বেঁচে যান।
তার কথায়, "কয়েকজন ভাগ্যবানের মধ্যে আমিও ছিলাম। আমরা ইটালিতে পৌঁছাই।" ২০১৬ সালে জার্মানি পৌঁছান তিনি। উত্তর-পশ্চিম জার্মানির একটি ছোট শহর ওল্ডেনবার্গ থেকে ফোনে কথা বলছিলেন সাইদিখান। তখনই দেখা গেল, তার ইংরেজিতেও জার্মান শব্দ মিশে গিয়েছে। ভাষা রপ্ত করছেন তিনি। মাত্র ২৩ বছর বয়সি তরুণ অনেককেই ভরসা দিচ্ছেন।
সংহতির চাপ
জার্মানিতে অভিবাসীদের যুব ক্ষমতায়ন প্রশিক্ষক, কর্মী, পরামর্শদাতা তিনি। টেলিভিশনের পর্দায় তাদেক দেখা যায়। আরো অনেক কাজ করেন সাইদিখান।
"আপনি এটা করতে পারেন"-সোশ্যাল মিডিয়া ভিডিওতে নতুন অভিবাসীদের জন্য এই লাইনটি উল্লেখ করেই পডকাস্ট চালান তিনি৷
তার অনেক প্রকল্পের মধ্যে একটি পডকাস্ট হলো 'উই মাইগ্রেন্টস'। এটি নিয়মিত ৪০ হাজার শ্রোতাদের কাছে পৌঁছায়। তিনি বলেন, "অভিবাসীদের প্রকৃত তথ্য় জানাতে হবে। একপেশে তথ্য নয়। তাদের জানতে হবে মানুষ কী বিষয়ে কথা বলছে।"
অভিবাসন সংক্রান্ত সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে সাইদিখান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলেন। তার কথায়, ''আপনি যদি জার্মান ভাষায় কথা না বলেন, তাহলে আপনার এ দেশে সমস্যা হবে৷ তবুও এমন অনেক লোক রয়েছে যারা বিষয়টি জানতে চান তবে এখনও ভাষা বা সিস্টেম শেখার সুযোগ পাননি। তারা 'ইন্টিগ্রেশন'-এর চাপে রয়েছেন, যা সমস্যাও তৈরি করতে পারে।''

তার কথায়, "আমি যখন এসেছিলাম তখন রীতিমতো চাপে ছিলাম। কারণ আমি জানতাম সদ্য একটি নির্বাচন হয়েছে (২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর)। আমি জানতাম, হয়তো অনেক কিছু পরিবর্তন হতে পারে। আইন পরিবর্তন হতে পারে। আমার আশ্রয় আবেদন নাকচের সম্ভাবনাও ছিল।"
কী করেছিলেন তিনি?
তার বক্তব্য, "সুতরাং প্রথম বছরে আমি (জার্মানিতে) এসে আট মাসের মধ্যে আমার 'হপ্টশুলআবশ্লুস' (স্কুল শেষ করার শংসাপত্র) নিই। সরাসরি প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করি। কোনো চিন্তা করিনি। শুধু নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম যাতে আশ্রয়ের দাবি নাকচ করা হলে আমি নির্বাসিত হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারি।"
ব্রেমেনের বন্ধুরা
ইন্টিগ্রেশন এবং আশ্রয়ব্যবস্থার সমস্যাগুলির মতো বিষয়গুলি প্রায়ই পডকাস্টে অতিথিদের সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। অভিবাসীদের প্রভাবিত করে এমন সমস্যাগুলি সাধারণত গুরুত্ব পায়। তার কথায়, '' পডকাস্টের কয়েকজন অতিথি নিজের কথা ভাগ করে নিতে সবসময় প্রস্তুত থাকেন এমন নয়। অভিবাসীরা যখন নিজেদের কথা বলেন, তখন তাতে আবেগ মিশে থাকে। কিন্তু একজন অভিবাসী হিসাবে, তাদের মতো করেই আমি সবার সঙ্গে মিশি যাতে তারা স্বাভাবিকভাবে নিজের কথা বলতে পারেন।"
সাইদিখানের একটি প্রকল্পের লক্ষ্য হলো, তরুণ অভিবাসীদের মাসে একবার একসঙ্গে রান্না করে খাওয়াদাওয়া করা। যাতে আশ্রয় বা কোনো আমলাতান্ত্রিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা না করে সেই সময়টুকু অন্তত মজা করা যায়।
'বাডিস অফ ব্রেমেন'-এর এই রান্নার দলটি ফ্লুশত্রাউম থেকে গড়ে উঠেছে। ব্রেমেনের তরুণ শরণার্থীদের পরামর্শ এবং সহায়তা দেওয়ার একটি জায়গা ছিল এটি। তার কথায়, ''একদিন ছিল সেনেগালের খাবার। পরের দিন কেউ বলবে আমি রান্না করব। আফগানিস্তান, বা সিরিয়ান বা লেবাননের খাবার বানানো হবে তখন।"

তার প্রিয় খাবার হলো বেনাচিন। পশ্চিম আফ্রিকার খাবারটি চাল, টমেটো, পেঁয়াজ, মাংস, শাকসবজি এবং মশলা দিয়ে তৈরি। একটি আফগান খাবারও তার প্রিয়। তবে নাম মনে নেই। খাবারের স্বাদ একটু-মিষ্টি। এই ভাল লাগাটুকুই এই রান্নার দলে ভাগ করে নেনে তারা।
জার্মানি 'ভালো কাজ করছে'
সিডি সাইদিখান চান, ইউরোপে আসার কথা ভাবছেন যারা, তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যেন সব তথ্য জেনে নেন। তার কথায়, "আমি এমন মানুষদের দেখেছি যারা নিয়মিত স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত। এখানে আসতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। ইটালিতে যাওয়ার পরেও প্রচুর লোক মারা গিয়েছে। তাদের অনেকে মনে করে ইউরোপ যেন স্বর্গ, যাতে কোনো না কোনোভাবে সবাই বেঁচে যাবে।"
তার মত, "অন্য অনেক ইউরোপীয় দেশের তুলনায় জার্মানির একটি ভাল অভিবাসন নীতি রয়েছে।"
তিনি বলেন, "গৃহহীন যে অভিবাসীরা রাস্তায় ঘুমান, তাদের নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করতে গত বছরের আগস্টে ইটালিতে যাই। জানতে পারি জার্মানি অন্য দেশের চেয়ে অনেক ভালো। ইটালিতে আমি অনেক অভিবাসীকে দেখেছি যারা বসবাসের অনুমতি পেলেও রাস্তায় ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছে।"
স্পষ্টবাদী এবং আবেগপ্রবণ সাইদিখান রাজনীতিবিদ হিসাবে দক্ষ প্রার্থী। এটাই এখন সাইদিখান চান। তবে প্রথমে তিনি জার্মান ভাষায় দক্ষ হতে চান। ইতিমধ্যে দুটি অন্য ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন সাইদিখান।
সাইদিখানের একজন তরুণ সহকর্মী গাম্বিয়ান আবু বাহ রেডিও স্টেশন ব্রেমেন সোয়াইকে বলেন, ''সাইদিখান মানুষকে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে উৎসাহ দেন। তিনি নিজেও জীবনে হাল ছাড়েননি। তিনি যা করতে চান, তা করেই ছাড়বেন।"
মারিও ম্যাকগ্রেগর/আরকেসি