দক্ষিণ-পূর্ব স্পেনে অভিবাসী শ্রমিকদের একটি শিবিরে আগুনে পুড়ে গেছে অন্তত ৫০০ শ্রমিকের বাসস্থান৷ তবে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি৷ দুর্ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে অন্তত ২০০ অভিবাসী শ্রমিককে৷ সোমবারের এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কারণ জানতে শুরু হয়েছে তদন্ত৷
সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানিয়েছে, প্রায় ৫০০ অভিবাসী শ্রমিকের ওই শিবির প্রায় পুরোটাই পুড়ে গেছে৷ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা ছবিতেও দেখা গেছে অস্থায়ী খুপরি এবং প্লাস্টিকের ঘরগুলো পুড়ে গেছে৷ কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় পুরো এলাকা৷
দক্ষিণ-পূর্ব স্পেনের আলমেরিয়ার অঞ্চলের এল ওয়ালিলির ওই শিবিরটি অবশ্য ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ৷ এটি বসবাস অনুপযোগী ও বিপজ্জনক হওয়ায় ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল স্থানীয় নিখার সিটি কাউন্সিল৷ যেদিন ভাঙার কথা ছিল, সেদিনই আগুন লাগে৷
১৫ বছরের পুরনো এই শিবিরের বেশিরভাগ অভিবাসীরাই ছিলেন মরক্কো এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার৷ ওই এলাকার গ্রিনহাউসগুলোতে ব্যবহার করা প্লাস্টিকের ত্রিপল দিয়ে ঢাকা ছিল শিবিরের অনেক ঘর৷ আর ওই গ্রিনহাউসগুলোতে কাজ করতেন পুরুষ শ্রমিকরা৷
স্থানীয় দাতব্য সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় ক্যাম্পে থাকা অভিবাসীদের বাস যোগে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়৷ এপি জানিয়েছে, অন্তত ৬০ জনকে কাছের একটি গুদামঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডক্টরস অফ দ্য ওয়ার্ল্ডের স্থানীয় শাখার সভাপতি (মেডিসিনস দু মোন্দে), কারমেন ডমিঙ্গেজ এপিকে জানান, নতুন আবাসন নির্মাণকালে অস্থায়ী বাসস্থানের জন্য ক্যাম্পটি তৈরি করা হয়৷
ওই শিবিরে গত দুই বছর ধরে থাকতেন সেনেগালের নাগরিক আবদুলাই৷ তাকে উদ্ধৃত করে এপি জানিয়েছে, ‘এখন সবাই রাস্তায়৷ বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা৷ আমাদের সামনে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে৷‘‘
এমন বাস্তবতায় আবহাওয়া পরিস্থিতি অনুকূলে না আসা পর্যন্ত অভিবাসী শিবিরটি না ভাঙতে সিটি কাউন্সিলের কাছে আবেদন জানিয়েছে স্থানীয় দাতব্য সংস্থাগুলো৷ অভিবাসীদের স্থানান্তরে কর্তৃপক্ষের উপযুক্ত পরিকল্পনা নেই বলে দাবি করেছে মানবাধিকার সংস্থা এপিডিএইচএ৷
বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি
তুর্কি বার্তাসংস্থা আনাদোলু জানিয়েছে, আগুন লাগার পরই নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি অভিবাসীদেরও উচ্ছেদও শুরু হয়৷ এপি জানিয়েছে, কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি স্পষ্টভাবে জানতে চাইলেও কোনো সাড়া মেলেনি৷

আনাদোলু বলছে, কয়েক বছর ধরে এই শিবিরই অভিবাসী শ্রমিকদের বাড়ি হয়ে উঠেছিল৷ ওইসময় উচ্ছেদ পরিচালনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে কয়েক ডজন পুলিশ কর্মকর্তাও সেখানে উপস্থিত ছিলন, আকাশে টহল দিচ্ছিল হেলিকপ্টার৷
আবদুল নামের এক অভিবাসীকে উদ্ধৃত করে স্প্যানিশ দৈনিক এল পাইস জানিয়েছে, তার সব জিনিসপত্র প্লাস্টিকের ব্যাগে জড়ো করা ছিল৷ সেসব সঙ্গে নিয়েই তিনি ক্যাম্প থেকে পালিয়েছিলেন। ওই শিবিরে ২০১৫ থেকে বসবাস করছেন বলেও দাবি করেছেন আবদুল৷
আনাদোলু আরও লিখেছে, সেনেগালের এক রাজনীতিবিদ ওই সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন৷ সেরিগেন এমবায়ে নামে ওই ব্যক্তি স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, আগুনের ঘটনা কাকতালীয় নয়৷
'অভিবাসীদের শোষণ করা হয়'
সেরিগেন এমবায়ে বলেন, "এটি স্পষ্টতই একটি কৌশল ছিল৷ যাতে বিপদগ্রস্ত হয়ে লোকজন শিবির ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়৷।''
এ ঘটনা অমানবিক উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ’’অভিবাসীদের শোষণ করা হয়েছে৷ তারপর প্রয়োজন শেষে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে৷''

এল পাইস জানিয়েছে, শিবির থেকে সরিয়ে নেওয়া বাসিন্দাদের দুই মাস পর্যন্ত জরুরি আশ্রয়ের নিশ্চয়তা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ৷
এপিডিএইচএর মুখপাত্র ফার্নান্দো প্লাজাকে উদ্ধৃত করে আনাদোলু জানিয়েছে, তার বিশ্বাস এল ওয়ালিলি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে৷ হাইওয়ের কাছে হওয়ায় এবং পর্যটকদের যাতায়াতের পথে পড়ায় এটি দৃশ্যমান বলেো মনে করেন তিনি৷
স্প্যানিশ নিউজ সাইট এল সালতো দিয়ারিওকে ফার্নান্দো প্লাজা বলেন, ‘‘যারা বাড়িঘর হারিয়েছে, কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি পুরোপুরি সহানুভূতিশীল নন৷‘‘
অভিবাসী শ্রমিকদের সরিয়ে যেখানে রাখা হয়েছে তা কর্মক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে৷ এল সালতো দিয়ারিও বলছে, শ্রমিকদের যাতায়াতে এটি বড় সমস্যা৷ কারণ লোস গ্রিওস জায়গাটা বেশ দূরে৷
প্লাজা আরও বলেছেন, ’’অন্যান্য শিবিরগুলোতে আসলে এল ওয়ালিলির চেয়ে দ্বিগুণ অভিবাসী শ্রমিক বাস করে৷ সেগুলো এখনও কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। তবে আলমেরিয়ার জাতীয় উদ্যানের কাছে বলে এই শিবিরটি নিয়ে কর্তৃপক্ষ চিন্তিত ছিল৷’’
দক্ষিণ স্পেনের একটি অভিবাসী শিবিরে ঘুরে গ্রিনহাউসে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনযাপন প্রত্যক্ষ করেছেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফিলিপ অ্যালস্টন৷ তার মতে, ‘‘বিশ্বের সবথেকে খারাপ পরিস্থিতি বললে ভুল হবে না। অনেকেই সেখানে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করেছেন এবং ভাড়া দিতে পারেন। কিন্তু কেউ তাদের ভাড়াটে হিসেবে কেউ গ্রহণ করবে না। তারা প্রতিদিন ৩০ ইউরোর মতো আয় করলেও সরকারি কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না।''
নেই কোনো পরিষেবা
এল সাল্তো দিয়ারিওকে স্প্যানিশ স্যাট ইউনিয়নের প্রতিনিধি মিকেল কারমোনা বলেন, খামারের কাছাকাছি না থাকলে কাজ হারানোর ভয় আছে।

অগ্নিকাণ্ড এবং উচ্ছেদে যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছে তাদের পাশে থাকতে ইউনিয়ন খামার শ্রমিকদের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।
এল সাল্তো দিয়ারিওর মতে, গত ২০ বছরে নিখারের আশেপাশের এলাকায় (যেখানে এল ওয়ালিলি অবস্থিত) গ্রিনহাউস চাষের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে৷ ২০২২ সালে এসে তা ৬ হাজার ৫০০ হেক্টরেরও বেশি৷ কিন্তু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও পর্যাপ্ত আবাসন কখনো ছিল না।
এল সালতো দিয়ারিওর কাছে শ্রমিকরা শোষণের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন মাদ্রিদের সেনেগালিজ রাজনীতিবিদ এমবায়ে৷
তিনি বলেন, "গোটা ইউরোপ জানে যে এখানে দাসপ্রথা অব্যাহত রয়েছে। তারা যে পণ্যগুলো স্পেন থেকে পায়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল থেকে, অনেক কিছু এই দাসপ্রথার ফসল।"
এমা ওয়ালিস/আরকেসি (এপি, আনাদোলু))