পিআইকের গবেষকদের দাবি, দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অনেকের নিজ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে না
পিআইকের গবেষকদের দাবি, দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অনেকের নিজ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে না

জলবায়ু পরিবর্তন আন্তর্জাতিক অভিবাসনকে একদিকে ত্বরান্বিত করছে, অন্যদিকে বাধাগ্রস্ত করছে৷ জার্মানির নতুন এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে৷ জলবায়ু পরিবর্তন অভিবাসনকে উসকে দিলেও দুর্বল করে ফেলছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি৷ তাই অভিবাসন প্রক্রিয়া সীমিত হয়ে আসছে৷

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং খরার মতো দুর্যোগ যে হারে বাড়ছে তাতে জলবায়ু সংকট কতটা ভোগাতে পারে তা অনুমান করা অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছে৷ মানুষ বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে৷

আবহাওয়ার পরিস্থিতির অবনতি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া এবং মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুতি বাড়ছে৷ কিন্তু এসব কারণে আন্তর্জাতিক অভিবাসন বাড়ছে বলে মনে করছে না এই নতুন গবেষণা৷

জার্মানির পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ (পিআইকে)-এর মতে, এর একটি কারণ হল গ্লোবাল সাউথের অনেকের কাছে অভিবাসনের জন্য কোনো অর্থ নেই৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে বলেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷

পিআইকের গবেষকদের দাবি, দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অনেকের নিজ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে না৷ পিআইকের ফিউচারল্যাব সিকিউরিটি, এথনিক কনফ্লিক্ট অ্যান্ড মাইগ্রেশন প্রধান এবং গবেষক জ্যাকব শেউ বলেন, ‘‘সামগ্রিকভাবে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসন বেড়েছে৷ তবে অভিবাসনের হার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে দিচ্ছে৷ কিন্তু যারা অভাবী মানুষ এবং বসবাস করে দরিদ্র দেশে, তাদের আসলে অভিবাসনের উপায় নেই। তারা যেখানে আছে সেখানে থাকা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই৷’’


অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অভিবাসনের যোগসূত্র

গবেষণা অনুযায়ী, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে গেলে, কমে যায় জাতীয় আয়৷ আর তা প্রভাবিত করে অভিবাসন প্রক্রিয়াকে৷ গবেষণার সহ-লেখক ক্রিস্টিয়ান অটো বলেন, ‘‘ধনী এবং নিম্ন আয়ের দেশ থেকে তুলনামূলকভাবে খুব কম লোক অভিবাসন করে। দরিদ্র দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে এটা আংশিক৷ কারণ, অনেক লোক দেশ ছেড়ে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে না।’’

শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে মানুষ অভিবাসনে আগ্রহী কিনা তা যাচাই করা মূল উদ্দেশ্য নয় বলে জানান নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও সহ-লেখক অ্যান্ডার্স লেভারম্যান৷ তিনি বলেন, ‘‘বরং, জীবনের বাঁকবদল অভিবাসনকে কতটা উসকে দিতে পারে সেটা জানতে চেয়েছি আমরা৷৷’’

অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশগত পরিবর্তন যখন কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তখন অভিবাসনের হার বেড়ে যায়৷ সাব-সাহারান আফ্রিকার ক্ষুদ্র কৃষকদের কথা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়৷

১৯৯০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের আয়ের স্তর বিশ্লেষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন আন্তর্জাতিক অভিবাসনকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে এই গবেষণায়৷ অভিবাসনকে প্রাভাবিত করার ক্ষেত্রে আয়ের স্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ৷

জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও অভিবাসন প্রবাহ কেমন হতে পারে সেটাও বোঝার চেষ্টা করেছেন গবেষকরা৷ তবে তারা স্বীকার করেছেন যে, গবেষণায় ডেটা এবং অভিবাসনে যে মডেল ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্য দিয়ে প্রকৃত অভিবাসন প্রবাহের সঠিক চিত্র নাও পাওয়া যেতে পারে৷


জলবায়ু অভিবাসনের বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ

যদিও জলবায়ুর কারণে বাস্তুচ্যুতি একটি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক ঘটনা৷ তবে যারা অভিবাসন করে তাদের বেশিরভাগই নিজ দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে থাকে৷ তাদের ইউরোপ কিংবা অন্য কোথাও যাওয়ার লক্ষ্য বা সম্ভাবনা নেই। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য মতে, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা (আইডিপি) বিশ্ব জুড়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যার অর্ধেক৷ বর্তমানে জোর জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত লোকের সংখ্যা ৮ কোটি ৯৩ লাখ৷

অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (আইডিএমসি) বলছে, ২০২১ সালে প্রায় ২ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ নিজ দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আর সংঘাত বা সহিংসতার কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল ১ কোটি ৪৪ লাখ মানুষ৷

তবুও, জলবায়ু সংকটের কারণে অভিবাসনকে সীমান্ত দিয়ে আটকে রাখা যায় না৷ বিশেষ করে যখন এটি সংঘাতে রূপ নেয়, তখন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে৷১৯৯১ সালে গৃহযুদ্ধের পর সরকারের পতন হলে ১১ লাখ সোমালি কেনিয়া ও ইথিওপিয়ায় আশ্রয় নেয়৷ খরার কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের জের ধরে ওই রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়৷


জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়বে দীর্ঘমেয়াদে অভিবাসন

জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বাস্তুচ্যুতি গ্লোবাল নর্থের শিল্পোন্নত দেশগুলোকেও প্রভাবিত করছে৷ অক্সফামের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মূলত বিশ্বজুড়ে এসব দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য সবথেকে বেশি দায়ী৷ তাদের কারণে গ্লোবাল সাউথের দরিদ্র দেশগুলো ক্ষতির শিকার হচ্ছে

জলবায়ু সংকটের চিহ্নিত ১০টি হটস্পটের সবকটির অবস্থান গ্লোবাল সাউথ৷ অক্সফাম বলছে, ছয় বছর আগের তুলনায় এ অংশের তীব্র ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করা মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে৷

জলবায়ু সংকটের হটস্পট হিসেবে অক্সফাম তার গবেষণায় আফ্রিকার সোমালিয়া, কেনিয়া, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, জিবুতি, মাদাগাস্কার এবং জিম্বাবুয়ের পাশাপাশি আফগানিস্তান, গুয়াতেমালা এবং হাইতির কথা উল্লেখ করেছে৷ সমীক্ষা অনুযায়ী, গত দুই দশকে বিরূপ আবহাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা৷ অক্সফাম জানিয়েছে, এই দশটি দেশের অনেক মানুষ খাদ্য সংকটের মুখে পড়ার তীব্র শঙ্কা রয়েছে৷

জলবায়ু পরিবর্তনে অভিবাসন কম হওয়ার কারণ হিসেবে গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশের কম আয়কে ইঙ্গিত করেছেন পিআইকে গবেষকরা৷ তবে এটি দীর্ঘমেয়াদী বিশ্বব্যাপী অভিবাসনকে বাড়িয়ে রাখতে পারে বলে গবেষণায় জানানো হয়েছে৷ নিম্ম আয়ের দেশগুলোর পক্ষে জলবায়ু সংকট উত্তরণের গতি ধীর হতে পারে বলেও জানিয়েছে গবেষকরা৷

বেঞ্জামিন বাথকে/টিএম

 

অন্যান্য প্রতিবেদন