(ফাইল ছবি) ফরাসি কট্টর ডানপন্থী বিরোধী রাজনৈতিক নেতা মারিন লো পেন আসন্ন অভিবাসন বিল নিয়ে বিদেশিদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন। ছবি: রয়টার্স
(ফাইল ছবি) ফরাসি কট্টর ডানপন্থী বিরোধী রাজনৈতিক নেতা মারিন লো পেন আসন্ন অভিবাসন বিল নিয়ে বিদেশিদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন। ছবি: রয়টার্স

ফ্রান্সের অভিবাসন বিলকে কেন্দ্র করে দেশটির কট্টর ডানপন্থি নেতা মারিন লো পেন ফ্রান্সে ‘নিষ্ক্রিয় বিদেশি নাগরিকদের’ কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, বিদেশিদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কাজ করে না। তার এই দাবির সত্যতা যাচাই করেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস।

আসন্ন ফরাসি অভিবাসন বিল নিয়ে ফ্রান্সে চলছে তুমুল বিতর্ক। সংসদ, রাজনৈতিক আড্ডাসহ সব জায়গায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে নতুন এই বিল। 

চলমান বিতর্কের মধ্যে কট্টর ডানপন্থি ন্যাশনাল র‍্যালিদ দলের প্রধান মারিন লো পেন ফরাসি গণমাধ্যম ফ্রান্স ইনফোকে বুধবার একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তিনি দাবি করেছেন, “আমাদের ৪০ শতাংশ বিদেশি নিষ্ক্রিয়। অতিরিক্ত অভিবাসন আনার আগে তাদেরকে কাজে লাগানো যাক৷”

আরও পড়ুন>>ফ্রান্স: ধর্মঘটের অধিকার ও নিয়মসমূহ

ঠিক কী বলেছেন মারিন লো পেন: তার বক্তব্যে মারিন লো পেন ‘অভিবাসী’ উল্লেখ না করে মূলত ‘বিদেশি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। 

কারা বিদেশি?

ফ্রান্সের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর ইনসের সংজ্ঞা অনুসারে, “একজন বিদেশি হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি ফ্রান্সে থাকেন এবং তার ফরাসি নাগরিকত্ব নেই। অর্থাৎ একজন বিদেশি শুধু একজন অভিবাসীই নয়, তিনি ফ্রান্সেও জন্মগ্রহণ করে থাকতে পারেন। যেমনটি প্রযোজ্য অপ্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে যারা অভিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন।”

পড়ুন>>ফ্রান্স: আল্পস-মারিতিমে রেকর্ডসংখ্যক অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসী

আইন অনুসারে, ফ্রান্সে দুইজন বিদেশি বাবা-মায়ের কাছে জন্ম নেয়া বেশিরভাগ শিশুই এক পর্যায়ে ফরাসি জাতীয়তার জন্য আবেদন করতে পারেন।

এটি করার জন্য উক্ত ব্যক্তিকে ১৮ বছর বয়সের আগে ফ্রান্সে বসবাস করতে হবে এবং ১১ বছর বয়স থেকে কমপক্ষে পাঁচ বছরের জন্য ফ্রান্সে বসবাস করেছেন সেটির প্রমাণ দিতে হবে। 

অভিবাসী কারা?

পরিসংখ্যান দপ্তর ইনসে অনুসারে, একজন অভিবাসী হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু বর্তমানে ফ্রান্সে বসবাস করছেন। অর্থাৎ বিদেশে জন্ম নেয়া একজন ব্যক্তি ফ্রান্সের জাতীয়তা পাওয়া সত্ত্বেও পরিসংখ্যানের খাতায় অভিবাসী ও ফরাসি উভয়ই হিসেবে বিবেচিত হবেন।

আরও পড়ুন>>ফ্রান্সে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আশ্রয় আবেদন বাংলাদেশিদের

নিষ্ক্রিয়/ সক্রিয় 

মারিন লো পেন তার বক্তব্যে নিষ্ক্রিয়তার কথা বলেছেন। একজন ‘নিষ্ক্রিয়’ ব্যক্তি হল এমন একজন ব্যক্তি যার চাকরি নেই এবং তিনি কোন চাকরির সন্ধান করছেন না। 

অপরদিকে, একজন সক্রিয় ব্যক্তি কর্মরত বা বেকার হতে পারেন। কিন্তু বেকার হলেও উক্ত ব্যক্তি নিয়মিত চাকরির সন্ধানে থাকেন। 

ফরাসি পরিসংখ্যান দপ্তর ইনসের সংজ্ঞা অনুযায়ী, “কারা নিষ্ক্রিয় সেটি শ্রম কনভেনশন স্বীকৃত। ১৫ বছরের কম বয়সি কিশোর, যুবক, ছাত্র এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মজীবীরাও এই তালিকায় রয়েছেন। কারণ তরুণরা পড়াশোনার পাশাপাশি সবাই কাজ করেন না। অপরদিকে অবসর গ্রহণের পাশাপাশি বয়স্করা আর কাজ করেন না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এই তালিকায় রয়েছেন।”

পড়ুন>>তুরস্ক থেকে ইরানে ‘ডিপোর্ট’; বাংলাদেশি অভিবাসীর নির্যাতনের গল্প

পরিসংখ্যান সংস্থাগুলি তাদের পরিসংখ্যানে এ কারণে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সের জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।  

ফ্রান্সের ৪০ শতাংশ বিদেশি কি নিষ্ক্রিয়?

ইইউর পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে ফ্রান্সে বিদেশিদের নিষ্ক্রিয়তার হার ছিল ৩৩.৫%। এই পরিসংখ্যানে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি লোকেদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

কলেজ এবং হাইস্কুলের যেসব ছাত্রছাত্রীরা তাদের পড়াশোনার সাথে সমান্তরালভাবে কাজ করে না তারাও এই হারের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই এই পরিসংখ্যানটি অত্যন্ত ‘সমস্যাযুক্ত’।

মারিন লো পেনের দাবিটি পুরো সত্য নয়। 

পড়ুন>>ফ্রান্স: নতুন ফরাসি অভিবাসন বিলের খসড়া চূড়ান্ত

কারণ ইনসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফ্রান্সে বসবাসরত অভিবাসীদের মধ্যে ২০২১ সালে নিষ্ক্রিয়তার হার ২৯,৮ শতাংশে নেমে এসেছে।

সমীক্ষায় নানা জটিলতা

আরেকটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া উচিত৷ সেটি হলো, এই পরিসংখ্যানগুলোতে অনিয়মিত পরিস্থিতিতে থাকা বিদেশিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাকি জনসংখ্যার মতো তাদেরকেও একইভাবে গণনায় যুক্ত করা হয়।

অনুমান করা হয়, ফ্রান্সে ৪ লাখ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত অনিয়মিত অভিবাসী বসবাস করেন। 

ইনসে যখন ‘চাকরি, বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থান’ বিষয়ক সমীক্ষা পরিচালনা করে তখন উত্তরদাতাদের কাছে রেসিডেন্স পারমিট বা বৈধতা আছে কীনা সেটি জানতে চাওয়া হয় না। 

আরও পড়ুন>>ইইউর স্বেচ্ছা অভিবাসী প্রোগ্রামে স্থানান্তর মাত্র ২০৭ আশ্রয়প্রার্থী

এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি যদি জানান, তিনি কাজে যুক্ত আছেন সেক্ষেত্রে তিনি অনিয়মিত পরিস্থিতিতে থাকলেও ঠিক কোন ক্যাটাগরিতে আছেন সেটি উল্লেখ করা হয় না। দেখা যাচ্ছে, সক্রিয় তালিকায়ও বিপুল সংখ্যক অভিবাসী অথবা বিদেশি থাকতে পারেন। 

এছাড়া অনিয়মিত পরিস্থিতিতে থাকা লোকেরা অনেক সময় সমস্যায় পড়তে পারেন এই ভয়ে এবং রাষ্ট্রীয় পরিষেবার প্রতি অবিশ্বাসের কারণে জরিপের সময় তাদের কার্যকলাপকে ঘোষণা করেন না।

পরিচ্ছন্নতা, খাবার বিতরণ ইত্যাদি সেক্টরে বিপুল সংখ্যক অনথিভুক্ত কর্মীরা মিথ্যা পরিচয় ব্যবহার করে কাজ করে থাকেন। এই লোকেরা তাদের নিয়মিতকরণের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হতে পারে বা আশ্রয় আবেদন করার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন এই ভয়ে নিজের পরিচয়পত্র দিয়ে কাজ করা থেকে বিরত থাকেন।

আরও পড়ুন>>২০২২ সালে ফ্রান্সে রেকর্ড আশ্রয় আবেদন

বর্তমান ফ্রান্সে আসা আশ্রয়প্রার্থীরা তাদের আবেদন জমা দেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে কাজ করতে পারে না।

সার্বিক ভাবে বলা যায়, গণহারে ফ্রান্সের ৪০ শতাংশ বিদেশি নিষ্ক্রিয় এটি দাবি করা সত্য নয়। কারণ অভিবাসী, বিদেশি ও অনিয়মিত অভিবাসীসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জরিপ জনিত পরিসংখ্যান নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এছাড়া ইউরোস্ট্যাটের সর্বশেষ পরিসংখ্যানেও এটি ছিল ৩৩.৫%। যদিও এটি ২০২০ সালের পরিসংখ্যান। 



এমএইউ/এআই






 

অন্যান্য প্রতিবেদন