উত্তর ফ্রান্স থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসী পাচার নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত থাকার দায়ে ছয় ব্যক্তিকে দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেছে ফরাসি আদালত। অভিযুক্তরা গত গ্রীষ্মে চ্যানেল পাড়ি দিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন নৌ সরঞ্জাম উত্তর ফ্রান্সের দুয়ে শহরের একটি গোপন আস্তানায় মজুত করেছিল।
উত্তর ফ্রান্স উপকূল থেকে ইংল্যান্ডে মানবপাচারে যুক্ত ছয় ব্যক্তিকে মঙ্গলবার বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন উত্তর ফ্রান্সের দুয়ে শহরের আদালত।
অভিযুক্তরা ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সি পুরুষ। গ্যাংয়ের ছয়জনের মধ্যে হাফিদ বেলঘৌলে একজন ফরাসি নাগরিক। বাকি পাঁচ ব্যক্তিরা সবাই একসময় অনিয়মিত অভিবাসী ছিলেন।
আরও পড়ুন>>সন্তানদের ফিরে পেতে মায়ের আর্তনাদ
অবৈধ অভিবাসনের লক্ষ্য ভ্রমণ সংগঠিত করার অভিযোগে তাদের সাজা দিয়েছে আদালত। চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম ছোট নৌকায় এসব ভ্রমণ আয়োজন করে মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল
আদালতের রায়ে আবদু আদমে শাইকির, জানা মোহাম্মদ রেজা এবং পেশাওয়া হাসান নামে তিন ব্যক্তিকে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ফরাসি ভূখণ্ডে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে, ফরাসি নাগরিক হাফিদ বেলঘৌলকে একই মেয়াদের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সাজা হিসেবে সাজা ভোগের পর তাকে উত্তর ফ্রান্সের বোলোন-সুর-মের, কালে এবং ডানকের্ক এলাকায় প্রবেশে ও বসবাসে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে আদালত।
পড়ুন>>ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে অভিবাসী ‘পাচার’, ব্যক্তির কারাদণ্ড!
আরেক অভিযুক্ত ২৬ বছর বয়সি আফগান নাগরিক নাভিদ-উল্লাহ সাফিকে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং তিন বছরের জন্য ফ্রান্সে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তিনি মূলত পাচারের লক্ষ্যে অভিবাসীদের খুঁজে নেটওয়ার্কটির কাছে নিয়ে আসতেন।
তিনি দুয়ে শহরে একটি কাবাবের দোকানে কাজ করতেন। এই অভিবাসী নেটওয়ার্কের প্রধান অ্যালান মোহাম্মদ আলীর প্রস্তাবে উপকূল থেকে যাত্রা করা প্রতি নৌকার জন্য ১৫০০ ইউরোর দেড় লাখ টাকা আয়ের লোভে যোগ দিয়েছিলেন।
আদালত সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছেন ৩৩ বছর বয়সি ইরাকি নাগরিক অ্যালান মোহাম্মদ আলীকে। তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং সাজা শেষে ফ্রান্স থেকে নিজ দেশে বহিষ্কার করা হবে। পাশাপাশি তাকে ১৫ হাজার ইউরো বা ১৫ লাখ টাকা জরিমানাও দিতে হবে।
আরও পড়ুন>>১০ জন চ্যানেল অভিবাসীদের ৬ জন আশ্রয়ের যোগ্য
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন, তিনি কমপক্ষে ৩৫ হাজার ইউরো বা ৩৫ লাখ টাকা অভিবাসী পাচারের মাধ্যমে আয় করেছেন। তিনি এই নেটওয়ার্কের আরেক ইরাকি সদস্যের সাথে ফ্রান্সের লোয়ার আটলান্টিক ডিপার্টমেন্টে একজন রোমানিয়ানের ভাড়া করা একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন।
আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় প্রকাশের দশ দিনের মধ্যে আপিল করার সুযোগ রয়েছে।
গোপন ঘাঁটি
অভিযুক্তরা উত্তর ফ্রান্সের দুয়ে শহরের কেন্দ্রে একটি গ্যারেজে গোপন ঘাঁটি তৈরি করেছিল। এই স্থানটিতে প্রবেশে তারা বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তা ও কানাগলি ধাচের পথ দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করেছিল।
এটিতে যেতে প্রথমে একটি বিবাহের পোশাকের দোকান এবং একটি ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে আটকানো একটি বারান্দা অতিক্রম করতে হয়।
গত বছরের ২৯ জুলাই তুরস্কের নাম্বার প্লেট ব্যবহার করা একটি কাভার্ড ভ্যান এই অঞ্চলে প্রবেশ করলে ফরাসি পুলিশ সাথে সাথে গাড়িটির উপর নজরদারি করা শুরু করেছিল।
পড়ুন>>যুক্তরাজ্যে বিদেশী অপরাধীদের ‘ডিপোর্ট’ সহজ করতে নতুন আইন
তদন্ত দল যানবাহনের সাউন্ড সিস্টেম, টেলিফোন ট্যাপিং, ক্যামেরা এবং ট্রেসার স্থাপন করে প্রায় তিন মাস পর ২০২২ সালের অক্টোবরে ছয় অভিযুক্তকে আটক করতে সক্ষম হয়। আটকের সময় গোপন গ্যারেজটিতে মজুদ থাকা চারটি মোটর এবং ১৩৩টি লাইফ জ্যাকেট জব্দ করা হয়েছিল।
এই চক্রটি আটকের আগে তুরস্ক থেকে একটি বড় চালানের অপেক্ষায় ছিল বলে জানায় পুলিশ। চালানে ৫০টি নৌকা ও ইঞ্জিন আসার কথা ছিল।
উল্লেখ্য, উত্তর ফ্রান্স উপকূলে পাচারকারীদের কাছে পাচারের কাজে ব্যবহৃত রসদ যোগান দেয়া এখন এক প্রকার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকূলে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর টানা টহল ও গ্রেপ্তার অভিযানে পাচারকারীদের কাছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ব্যাপক সংকটি দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন>>বিদেশি পড়ুয়াদের কাজের সময় বাড়তে পারে ব্রিটেনে
১৬ কোটি টাকা অবৈধ মুনাফা
ফরাসি তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে, এই চক্রটি একটি সংঘবদ্ধ কাঠামোগত নেটওয়ার্ক। প্রসিকিউশন জানিয়েছে, পাচারকারীদের এই নেটওয়ার্ক মূলত অভিবাসী গ্রাহকদের সাথে ব্যবসা করেছে। উপকূলে পরিবহণ করা নৌকার সংখ্যা, অভিবাসীদের সংখ্যা এবং অভিবাসীরা অর্থ যে অর্থ প্রদান করেছে সেটি মিলিয়ে তদন্তকারীরা ধারণা করছে চক্রটি ১৬ লাখ ইউরো বা ১৬ কোটি টাকা অবৈধ মুনাফা করেছে।
আইনজীবী লোইক বুসি বলেন, “অভিযুক্তরা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একসময় তাদের দেশ থেকে পালিয়েছিল। আজ তারাই অন্যদের ঝুঁকি নিতে বাধ্য করছে। এটা অসঙ্গতিপূর্ণ।”
নিম্নমানের নৌকা ও লাইফ জ্যাকেটে অভিবাসীদের সমুদ্র পাড়ি দিতে ঠেলে দিয়ে মৃত্যু ঝুঁকি বাড়াতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করত চক্রটি।
পড়ুন>>যুক্তরাজ্যের শ্রমবাজারে অনিয়মিত অভিবাসীদের রুখতে ‘টাস্কফোর্স’
গ্যাংয়ের সদস্য ৪১ বছর বয়সি ফরাসি হাফিদ বেলঘৌল তার পিতামাতার সাথে তার ছয় সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। যদিও তিনি দুটি বৈধ কাজের মাধ্যমে মাসে তিন হাজার ইউরোর বেশি আয় করতেন, তারপরও অতিরিক্ত অর্থের লোভে এই চক্রের গাড়ি চালক হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন।
তিনি প্রতিবার অভিবাসী ও সরঞ্জাম উপকূল পর্যন্ত পরিবহনের জন্য টাকা পেয়েছিলেন। কিন্তু হাফিদ বেলঘৌলের ফ্রান্সে বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না।
এমএইউ/এআই (লা ভোয়া দ্যু নর্দ)