ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপমুখী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের উদ্ধার ও নজরদারি বাড়াতে লিবিয়াকে একটি নৌযান দিয়েছে ইটালি৷ লিবিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে নৌযানটি হস্তান্তর করা হয়েছে৷ লিবিয়াতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রতি অমানবিক আচরণের অভিযোগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক এমনিতেই প্রশ্নবিদ্ধ৷ এর মধ্যেই ভূমধ্যসাগরে নজরদারি বাড়াতে দেশটিকে নৌযানটি দিল ইটালি৷
ইটালির উত্তর-পূর্বে ভেনিসের দক্ষিণে রোভিগো প্রদেশের ভিটোরিয়া শিপইয়ার্ডে গত সোমবার এস-এলসিজি মডেলের নৌযানটি হস্তান্তর করা হয়৷ এসময় উপস্থিত ছিলেন ইতালির উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি, লিবিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাজলা এলমানগৌশ এবং ইইউ কমিশনার ফর নেবারহুড অ্যান্ড এনলার্জমেন্ট অলিভিয়ার ভরহেইলি।
ইইউ-এর নেয়া প্রকল্প ‘লিবিয়ায় সমন্বিত সীমান্ত ও অভিবাসন ব্যবস্থাপনা’-এর আলোকে এই নৌযানটি দেয়া হয়েছে৷
২০০ মানুষ নিয়েও ডুববে না এই নৌযান
লিবিয়াকে দেয়া নৌযানটি দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ মিটার এবং ৬ মিটার চওড়া৷ এর ধারণ ক্ষমতা ২০০ জন৷ এরকম দুটি নৌযান ইটালিয়ান কোস্ট গার্ডরাও ব্যবহার করছে৷ বলা হচ্ছে, কাঠ ও অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি নৌযানটি ডুববে না এবং নিজের সমতা নিজেই রক্ষা করতে সক্ষম৷ নৌযানটির নকশা এবং নির্মাণের দায়িত্বে আছে ইটালির ভেনেটোকেন্দ্রিক একটি প্রতিষ্ঠান৷
২০২২ সালের জুনে নিলামের মাধ্যেম ভিট্টোরিয়া শিপইয়ার্ড এরকম তিন নৌযান তৈরিতে ইটালির কোস্টগার্ড এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি সই করে৷ প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৮ মিলিয়ন ইউরো৷ বাকি দুটি চলতি বছরের শেষ নাগাদ সরবরাহ করার কথা রয়েছে৷
২০১৭ সালে লিবিয়ার কোস্ট গার্ডের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে এই সমঝোতা স্মারকে সই করে ইটালি৷ ওই স্মারকে চারটি টহল নৌযানের বিষয়টি উল্লেখ ছিল৷ ওই সমঝোতা স্মারকের আলোকে লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা সমুদ্রে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বহনকারী নৌকাগুলিকে আটকাতে এবং তাদের লিবিয়ায় ফিরিয়ে নিতে সক্ষম৷ ওই বছরে লিবিয়ার সঙ্গে ইইউ-এর মধ্যে একাধিক চুক্তি সই হয়৷ চলতি সপ্তাহে নৌযান হস্তান্তর মূলত তারই একটি অংশ৷
তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইইউ-এর এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানায় বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা৷ বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনায় ইইউ-এর প্রতি আহ্বানও জানায় তারা৷
লিবিয়ায় শরণার্থীদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দাতা সংস্থাগুলোও৷ চুক্তিটি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরও তিন বছরের জন্য নবায়ন করা হয়৷ যা চলতি বছরে শুরুর দিকে শেষ হওয়ার কথা৷ কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে, ইটালীয় সরকার এ বছরের নভেম্বরে চুক্তিটি আবারও নবায়ন করতে পারে৷
মানব পাচার ঠেকাবে এই নৌযান: ইটালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মানব পাচারের বিরুদ্ধে লিবিয়ার তৎপরতা জোরদার করার অংশ হিসেবে নৌযানটি তাদের দেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ইটালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি৷
ভূমধ্যসাগরে জীবন বাঁচানোর জন্য প্রসঙ্গটি সামনে এনে তাজানি বলেন, ‘‘মানব পাচার রুখে দেয়া এবং মানুষ উদ্ধারের বিষয়টি চূড়ান্ত৷’’
ইটালির বৈশ্বিক ভূমিকা এবং আফ্রিকা মহাদেশে নিজেদের শক্তিশালী হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরে তিনি নিজের কথা বলেছেন। একইসঙ্গে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ একটি অগ্রাধিকার বলেও মন্তব্য করেন তাজানি৷
লিবিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘লিবিয়া থেকে ইটালিতে বিপুল পরিমাণে অনিয়মিত অভিবাসনপ্রত্যাশীরা আসছেন৷ এর মধ্যেই ভূমধ্যসাগরীয় দেশটি গোপন অভিবাসন রোধে কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে৷’’
গেল বছর লিবিয়ার মতো উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো থেকে মধ্য ভূমধ্যসাগর হয়ে এক লাখেরও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী ইটালির উপকূলে আসে৷ জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর দেয়া তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২ সালে মোট এক হাজার ৩৮৫ জন মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে৷
‘সহযোগিতা জোরদার’
দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা জোরদারে উদ্যোগ নেয়ায় ইটালি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন লিবিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাজলা এলমানগৌশ৷ তিনি বলেন, ‘‘মানব পাচার প্রতিরোধে আমরা প্রযুক্তিগত বৈঠক চালিয়ে যাব৷’’
অভিবাসন নীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ সীমান্তকে নিরাপদ করতে নানা কৌশল গ্রহণসহ বহুপাক্ষিক মতামতের প্রয়োজন রয়েছে৷ সুদূরপ্রসারী সমাধান গ্রহণে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও প্রয়োজন৷’’
উত্তর আফ্রিকার উপকূল থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ইটালির পথে যাত্রা বন্ধ করতে চায় দেশটির সরকার৷ এজন্য লিবিয়া এবং তিউনিসিয়ার পাশাপাশি মিশরের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর প্রচেষ্টাও জোরদার করছে ইটালি৷
আনসা/টিএম