শরণার্থী ইস্যুতে ইউরোপের সবচেয়ে উদার দেশ হিসেবে পরিচিত সুইডেন৷ ডানপন্থি রক্ষণশীল জোট সরকার ক্ষমতায় এসে দেশটির অভিবাসন নীতিতে বড় পরিবর্তন আনছে৷ ফলে অভিবাসনপ্রত্যাশী ও আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সুইডেনে আশ্রয় পাওয়ার প্রক্রিয়াটি আরো জটিল হয়ে উঠছে৷
শরণার্থীদের সঙ্গে উদার আচরণের জন্য খ্যাতি ছিল সুইডেনের৷ কিন্তু দেশটির নতুন সরকার সেখানেও পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে৷
জানুয়ারির শেষ দিকে দেশটির অতি-ডানপন্থি রাজনৈতিক দল সুইডেন ডেমোক্র্যাটসের (এসডি) উপনেতা হেনরিক ভিঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন সুইডিশ অভিবাসন এবং আশ্রয়নীতি বিষয়ক মন্ত্রী মারিয়া মালমের স্টেনেরগার্ড৷
তারা যৌথভাবে ঘোষণা দেন, শিগগিরই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সুইডেনে আসায় নিরুৎসাহিত করতে প্রচারাভিযানে নামবেন তারা৷

অভিবাসন নীতি কঠোর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ হিসেবে সরকারের উপর অতি-ডানপন্থি এসডির প্রভাবকে দায়ী করা হচ্ছে৷ পাশাপাশি প্যান-ইউরোপিয়ান প্রবণতার অংশ হিসেবে জাতীয়তাবাদী ও অভিবাসনের বিরোধিতা করা দলগুলোকেও জোট আলোচনা ও সরকারেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে অভিবাসন ইস্যুতে উদার অবস্থানে ছিল সুইডেন৷ ১৯৭৫ সালে দেশটিতে একটি আইন পাস করা হয়, এতে বলা হয়, তিন বছর ধরে সুইডেনে বসবাসরত অভিবাসীরা পৌর নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন এবং সরকারি অফিসে চাকরির আবেদন করতে পারবেন৷ আইনটি অভিবাসীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার একটি প্রয়াস ছিল৷
অভিবাসন বিরোধী প্রবণতার শুরু যেভাবে
মধ্যপ্রাচ্যে ‘আরব বসন্ত’ এবং উত্তর আফ্রিকায় অভ্যুত্থানের শুরু হলে বিপুল পরিমাণ মানুষকে আশ্রয় দিতে হয়েছিল ইউরোপকে৷ ২০১৫-১৬ সালের দিকে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী আসে ইউরোপে৷ তখন থেকে সুইডেনে অভিবাসন-বিরোধী একটি প্রবণতা তৈরি হতে শুরু করে৷
সুইডিশ ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান পলিসি স্টাডিজের (এসআইইপিএস) সিনিয়র গবেষক বার্ন্ড পারুসেল বলেছেন, ‘‘২০১৫ সাল থেকে সুইডেনে অভিবাসন একটি বিষয়গত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কারণ তখনও সুইডেনে প্রচুর আশ্রয়প্রার্থী ছিলেন, তারাও সুইডিশ সমাজের সঙ্গে তখনও পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি৷’’
মোট জনসংখ্যার তুলনায় সুইডেনের চেয়ে বেশি শরণার্থী আরো কোনো দেশ গ্রহণ করেনি৷ ২০১৮ সালে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) দেয়া একটি তথ্যেও তা প্রতীয়মান হয়৷
ভাঙলো সুইডিশ ঐতিহ্য
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে দেশটির বেশ কয়েকটি শহরে দাঙ্গা প্রমাণ করে যে অভিবাসীদের একীভূত করতে সুইডেনের যে ঐতিহ্য তা ব্যর্থ হয়েছে৷ দেখা গেছে, অভিবাসন বিরোধী অতি-ডানপন্থি এসডি সাধারণ নির্বাচনে ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছে।ফলে মধ্য ডানপন্থি মডারেটের নেতৃত্বে উদার এবং খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে তিন দলীয় জোট সরকার গঠিত হয়৷ তখন নিজেদের নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সংসদে প্রভাব বাড়াতে এসডিকে জোটে নেয়া হয়৷ আর অভিবাসনকে গুরুত্ব দিয়ে সম্পাদিত টিডো চুক্তির দেশ পরিচালনায় এসডিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখায় সুযোগ করে দেয়৷
কার্লস্টাড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক টোবিয়াস হ্যুবিনেট বলেন, ‘‘১৯৯৮ সালে গঠিত রাজৈনৈতিক দল এসডি বরাবরই অভিবাসনকে তার রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার বড় অংশ হিসেবে নিয়েছ৷ আর শরিক সরকারের মধ্য দিয়ে তাদের ইচ্ছেপূরণের বিষয়টি বাস্তবতা পেয়েছে৷ কারণ, তারা তাদের অভিবাসন নীতি বাস্তবায়নের সুযোগ পেল৷‘‘
১৯৬০ সাল থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বকে বিশেষত লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবীয় এবং এশিয়ার দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে আসছে সুইডেন৷ হুবিনেট বলেন, ‘‘এটি সেই ঐতিহাসিক বিষয় যাকে এসডি একেবারে বদলে ফেলতে চায়৷’’
সুইডেনের এই বদলকে অভ্যন্তরীণ ও বৃহত্তর প্যান-ইউরোপীয় প্রবণতার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে৷ ২০২২ সালের এপ্রিলে সুইডেনের কিছু অংশে গ্যাং ভায়োলেন্স বা গোষ্ঠীভিত্তিক সহিংসতার বেড়ে গেলে অপরাধীদের সঙ্গে অভিবাসীদের একটি যোগসাজশ আছে বলে অনেকে ধরে নেন৷ তবে এটিকে অতিসরলীকরণ বলে মনে করেন বার্ন্ড পারুসেল৷
অভিবাসীদের নিরুৎসাহিত করতে প্রচার
গ্যুটেবোর্গ, মালমো, স্টকহোমের মতো শহরগুলোর যে অংশে অভিবাসীরা থাকেন, সেখানে সুইডিশ নাগরিকরা থাকতে চান না৷ এ প্রসঙ্গে হুবিনেট বলেন, ‘‘সুইডেন সম্ভবত ইউরোপের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি বিচ্ছিন্ন৷’’
সম্ভাব্য আশ্রয়প্রার্থীদের সুইডেনে আসা নিরুৎসাহিত করতে এবং ঠেকাতে, বিভিন্ন দেশে অবস্থিত সুইডিশ মিশনের সঙ্গে কাজ করতে অভিবাসন মন্ত্রণালয়৷ সুইডেনে অভিবাসন বিরোধী অবস্থান সবাইকে জানান দিতে চায় তারা৷
ওই প্রেস কনফারেন্সে স্টেনারগার্ড আরো বলেন, ‘‘এই সরকার অভিবাসন নীতিতে বড় পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিল। তাই আমাদের অনেক পরিবর্তন আনতে হবে৷’’
দেশটির উদারনীতির কারণেই ২০১৫ সালে অনেক বেশি সংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশী সুইডেনে প্রবেশ করেছিল বলেও মনে করেন দেশটির অভিবাসন মন্ত্রী৷
প্রগতিশীল দেশ হিসেবে সুইডেনের যে অবস্থান, বর্তমান সরকারের নীতি স্পষ্টতই তার বিপরীতমুখী বলে জানান কার্লস্টাড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক টোবিয়াস হুবিনেট৷
তিনি বলেন, ‘‘এলজিবিটিদের অধিকার রক্ষা, প্রাণী অধিকার রক্ষা, জলবায়ু এবং শরণার্থীদের অধিকার রক্ষায় সুইডেনের যে অবস্থান তা দ্রুতই হারিয়ে যাবে৷
অতি ডানপন্থি এসডিকে সরকারের নেয়ার কারণে হুবিনেট মনে করেন, ‘‘সুইডেন মরতে বসেছে৷’’
সোনিয়া সিয়েসনিক/টিএম