জার্মানিতে আশ্রয় নেয়া ইউক্রেনীয় শরণার্থী৷ ছবি: ডিপিএ
জার্মানিতে আশ্রয় নেয়া ইউক্রেনীয় শরণার্থী৷ ছবি: ডিপিএ

বছরখানেক আগে বিনা প্ররোচনায় ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া৷ সেই যুদ্ধের ফলে ৪০ লাখ উদ্বাস্তু ইউক্রেনীয় নাগরিকের আশ্রয় হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে৷ কিন্তু যুদ্ধ ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা এসব শরণার্থীদের অকৃতজ্ঞ, বিপজ্জনক, হিংস্র এবং পরজীবী হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷

একদিকে যুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তু হওয়া এসব মানুষকে অনেক দেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছে পরম মমতায়, আবার তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা খবর, ঘৃণা ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণাও চালাচ্ছে কেউ কেউ৷ বিষয়টিকে সামনে এনেছেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগের জুলিয়া স্মিরনোভা। তিনি বলেন, ‘‘শরণার্থীদের দায়ী করে এসব প্রতিবেদন ছিল মিথ্যা৷’’

সংস্থাটি গত অক্টোবরে টেলিগ্রামের মাধ্যমে ছড়ানো রাশিয়ান ভাষার এক আলোচনা বিশ্লেষণ করেছে৷ আলোচনায় দাবি করা হয়েছে, ইউক্রেনের শরণার্থীরা কথিত নাৎসিদের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ অপরদিকে, ইউরোপের বাকি অংশে শরণার্থীদের অকৃতজ্ঞ, সহিংসতা প্রবণ এবং বিপজ্জনক হিসেবে দেখানো হচ্ছে৷

দাবি: ইউক্রেনীয়রা কিয়েভের ‘নাৎসি শাসন’ থেকে পালাচ্ছে

হামলা শুরুর আগে থেকে রাশিয়ান গণমাধ্যমে বলা হতো, ইউক্রেনে নাৎসি শাসন চলছে৷ তারা ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছু মুছে ফেলতে চায়৷ হামলা শুরুর পর বলা হচ্ছে, ইউক্রেনীয়রা নাৎসি শাসন থেকে পালিয়ে যাচ্ছে৷ 

যদি তাই হয়, তাহলে অন্তত ইউক্রেনীয়দের মধ্যে যারা রাশিয়ান ভাষাভাষী তারা রাশিয়া গিয়ে আশ্রয় নেয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু ইউএনএইচসিআর বলছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার আগ্রাসেনর কারণে ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়েছে।

সংবাদমাধ্যম নিউজফ্রন্টের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একজন ইউক্রেনীয় সেনা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘‘আমরা ভূমি মুক্ত করছি, কিন্তু সেখানে কোনো মানুষ নেই৷’’ তারপর বলা হয়, ইউক্রেনীয়রা ‘‘নাৎসি শাসন’’ থেকে বাঁচতে পুনরুদ্ধার করা জমি ছেড়ে পালাচ্ছেন৷

ইউক্রেনীয়রা ‘নাৎসি শাসন’ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে বলে যে খবর গণমাধ্যমে আসে, সেটিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে৷ ছবি: নিউজ-ফ্রন্ট
ইউক্রেনীয়রা ‘নাৎসি শাসন’ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে বলে যে খবর গণমাধ্যমে আসে, সেটিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে৷ ছবি: নিউজ-ফ্রন্ট

ফ্যাক্ট চেকের পর জানা গেছে, এটি একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য৷ নিউ ইয়র্ক টাইমস দুটি নিবন্ধে এই উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেছে৷ কিন্তু কোনোটিতেই পালিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে নাৎসি শাসনের উল্লেখ করা হয়নি৷ একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইউক্রেনীয়দের মধ্যে যারা রাশিয়ার অনুগামী ছিলেন তারা রাশিয়া পালিয়ে যায়৷ অপর নিবন্ধে বলা হয়েছে, রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর আগেই পূর্ব ডনবাস অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ পশ্চিম ইউক্রেন বা ইউরোপের অন্যান্য দেশে পালিয়ে যায়৷ বরং সেখানে এমন কথাও বলা হয়েছে যে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী যুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো ইউক্রেনের অসংখ্য বেসামরিক জনগণকে হত্যা করেছে৷

এছাড়াও, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছে, অনেক ইউক্রেনীয় শরণার্থী (যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তথ্যমতে কয়েক লাখ) তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাশিয়ায় গেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ান বা রুশপন্থি সেনারা ইউক্রেনের রুশ-অধিকৃত এলাকা থেকে দেশটির বেসামরিক নাগরিকদের বাসে করে নিয়ে এসেছে। এমনকি, পশ্চিমে পাড়ি জমাতে রাশিয়াকে একটি ট্রানজিট হিসাবেও ব্যবহার করেছে অসংখ্য ইউক্রেনীয়রা৷

দাবি:যে দেশে আশ্রয় নেয় সেই দেশের নাগরিকদের ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে ইউক্রেনীয়রা 

ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগের স্মিরনোভা বলেন, প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোও দর্শক ও পাঠকদের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণাকে বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করেছে৷ ‘‘মিডিয়া স্পুফিং’’ নামের কৌশল খাটিয়ে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের মানহানিও করা হয়েছে৷

আশ্রিত দেশের নাগরিকদের ইউক্রেনীয়রা ব্ল্যাকমেইল করে বলেও অভিযোগ তোলা হয়েছে৷ আরো কিছু গণমাধ্যমের সঙ্গে ডয়চে ভেলের নামে প্রচারিত একটি ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, ইউক্রেনের এক যুবক বহু জার্মান নারীকে ব্ল্যাকমেইল করেছে।

ফ্যাক্ট চেক করে পাওয়া গেছে এই তথ্যটিও মিথ্যা। ফেডারেল ক্রিমিনাল পুলিশ অফিসে এমন অভিযোগ আসেনি বা এমন কোনো মামলা নথিভুক্ত হয়নি৷ ফন্ট এবং লেআউটে ছোটখাটো বিচ্যুতি চিহ্নিত করে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে ভিডিওটি ডয়চে ভেলের নয়, এটি সাজানো৷

দাবি:ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা ‘অকৃতজ্ঞ’ এবং ‘অসভ্য’

ভাড়া দিতে না পারায় একটি ইউক্রেনীয় শরণার্থী পরিবারকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল পুলিশ৷ এমন প্রচারটিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে৷

২০২২ সালের ডিসেম্বরের শুরুর দিকের কথা৷ রাশিয়ান, পোলিশ এবং জার্মান সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ইউক্রেনের একটি শরণার্থী পরিবারকে জোর করে একটি বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে৷ ক্রাকোভের ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পুলিশ অগ্নিনির্বাপণকারীদের সহায়তায় জোরপূর্বক তাদের বের করে দিতে চেয়েছেন৷ ওই ভিডিওতে পোলিশ এবং স্প্যানিশ ভাষার কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

কিয়েভভিত্তিক সাংবাদিকতা প্ল্যাটফর্ম স্টপ ফেক-এর গবেষণায় জানা গেছে যে, ইউক্রেনে রাশিয়ান আক্রমণের চার মাস আগে অর্থাৎ ২০২১ সালের অক্টোবরের শুরুতে পুরো ভিডিওটি ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছিল। তাই ইউক্রেনের যুদ্ধ শরণার্থীদের সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই।

দাবি: ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা ‘অপরাধী, হিংস্র’

প্রচারণাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বলা হয়, ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যুক্ত হয়ে পড়েছেন৷ তাদের কারণে ভুক্তভোগী হচ্ছেন স্থানীয়রা৷ আর এজন্য ব্যবহার করা হয়েছে রোম, প্যারিস বা বার্লিনে কোনো একজন ব্যক্তিকে ইউক্রেনীয়রা মারধর করছে এমন ফুটেজ৷ ফলে অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে শেয়ার করেন এসব ভিডিও৷ ফলে মিথ্যে গল্পটাও সত্য হিসাবে প্রচারিত হয়৷

ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ান বংশোদ্ভূত শরণার্থী সাহায্যকারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে যে প্রচারণা চালানো হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটিও মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে৷

একটি টিকটক ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন নারী রাশিয়ান ভাষায় ঘটনার বর্ণনা করছেন৷ তিনি তার দর্শকদের উদ্দেশে বলছেন, শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসা ১৬ বছরের একটি রাশানভাষীকে জার্মানির কোলোনের কাছে ইউসকিরচেনে ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা মারধর করেছিল এবং আঘাতের কারণে তার মৃত্যু হয়৷

ফ্যাক্ট চেক করে দেখা গেছে এটিও একটি মিথ্যা প্রচার৷ জানা গেছে, টিকটকের ওই নারী এই গল্পটি একজন পরিচিতের কাছ থেকে শুনেছিলেন৷ আর শুনেই তিনি তা টিকটক ভিডিও করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।

এ ধরনের কোনো হামলার কথা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ৷ হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে এমন ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি৷ পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে আরেকটি ভিডিওতে ক্ষমা চান ওই নারী৷

টিএম/এডিকে

 

অন্যান্য প্রতিবেদন